বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অবদান
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ০৬:৩৩ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| মুফতি আহমাদ রাফি জাকির ||

বিশ্বমানবতা যখন অশান্তি ও নৈরাজ্যকর পরিস্হিতির চরম মুহুর্ত অতিক্রম করছিলো, তখনই পৃথিবীতে শান্তি ও মুক্তির পয়গাম নিয়ে শুভাগমন করেছিলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহা-মানব,শান্তি ও মুক্তির অগ্রদূত, হযরত মুহাম্মদ সা.।  ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে, মক্কার সুখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে রাসুলে আরাবি সা. জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন শান্তি,মুক্তি-নিরাপত্তা ও কল্যাণের মূর্তপ্রতিক 'রাহমাতুল্লিল আলামিন'।

মানবতার মুক্তির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মদ সা.-কে  ন্যায়-ইনসাফ ও শান্তির বার্তাবাহক হিসাবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মানবজাতির নিকট সত্যপ্রচারে নিবিষ্ট হোন এবং তাদেরকে সরল,সঠিক ও চিরশান্তি-মুক্তির পথে পরিচালিত করেন। যাতে তারা জীবনে সফলতা অর্জন করে ইহকালিন শান্তি ও  পরলৌকিক সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হয়।

নবী করিম সা.-কে শান্তি,মুক্তি,প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্যে বিশ্ববাসির জন্য  'রাহমত' হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে,

'আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসির জন্য রহমতস্বরুপ প্রেরণ করেছি'। [ আম্বিয়া,আয়াত নং ১০৭]

মহানবী সা.-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও প্রদ্ধতি ছিলো সব'চে অনন্য। দল-মত-নির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ সবার মধ্যে শান্তিচুক্তি ও সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে সকলকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে, তিনি সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো। তিনি যুদ্ধবাজ আরবদেরকে শান্তির পতাকাতলে সমবেত করেন এবং বিবাদমান গোত্রগুলোকে একটি সু-সংহত জাতিতে রুপান্তরিত হয়।  তিনি 'হিলফুল ফুযুল' নামের ঐতিহাসিক শান্তি সংগঠনের মাধ্যমে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তের সেবা করা,অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, নির্যাতিত ও মাজলুমদের সহযোগিতা করা, শান্তি-শৃংঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রিয় সম্প্রীতি বজায় রাখা ছিলো এই শান্তি সংগঠনের প্রধান অঙ্গীকার।

মানবতার কল্যাণে এই স্বেচ্ছাসেবী  সংগঠনটি পৃথিবীর ইতিহাসে সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম সমাজ সেবামূলক ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। এভাবে নবুয়তি জীবনে মক্কায় অবস্থানকালে তিনি একটি সুস্থ-সুষ্ঠু সমাজের অবকাঠামোর প্রধান দিকগুলো মানুষের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো প্রচলিত দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা ও পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। মানবতার নবি হযরত মুহাম্মদ সা. 'হিলফুল ফুযুল' বা শান্তি সংগঠনের মাধ্যমে মক্কা থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদ করে, আদর্শ সমাজ গঠনে সচেষ্ট হন। মদিনায় হিজরতের পর তিনি সেখানে শান্তিপূর্ণ ইসলামি শরীয়া'হ মোতাবেক সমাজ ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় অবস্থানরত মুসলমান, ইহুদি,খ্রিস্টান, পৌত্তলিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ ইসলামি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করেন। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের আহ্বান করে বৈঠকে বসে তাঁদেরকে বিশ্বমানবতার ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবশ্যকতা তুলে ধরে সবার সমন্বয়ে একটি 'সনদ' বা  সংবিধান' প্রস্তুত করেন। মদিনায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরা এ সনদ মেনে শান্তিচুক্তিতে সাক্ষর করেন।

বিশ্বশান্তির অগ্রনায়ক হযরত মুহাম্মদ সা.- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, নাগরীকদের মধ্যে শান্তি,ভালবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রাখাসহ নানাদিক বিবেচনা করে মদিনার সনদ প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করেন। যা মানব ইতিহাসের প্রথম প্রশাসনিক সংবিধান 'মদিনা সনদ' নামে খ্যাত। মদিনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সেখানে বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে ইহুদিদের সঙ্গে তিনি শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন।

এভাবে মহানবী সা.- মদিনার জীবনে শান্তি-নিরাপত্তা বাস্তবায়নসহ, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা.-এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হলো হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে  পরাজয়মূলক দেখা সত্বেও কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার বৃহৎ স্বার্থে মহানবী সা.-এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষর প্রদান করেন।

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান অগ্রদূতের সাহসীকতা,ধৈর্যশক্তি  তখনকার লোকদের রীতিমতো যেমন বিমুগ্ধ-আপ্লুত করেছিল, পাশাপাশি  অনাগত মানুষদের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলো। মহানবী সা.-এর শান্তিপূর্ণভাবে 'ফাতহে মক্কা' (মক্কা বিজয়) ইসলামের ইতিহাসে এক অন্যতম গুরুত্ববহ অধ্যায় ছিলো। কার্যত তিনি যুদ্ধবিহিন, রক্তপাত ছাড়া, অনায়াসেই মক্কা বিজয় লাভ করেন। আদর্শ সমাজ গঠনে ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবীজী সা.-মক্কী ও মাদানী জীবনে -সর্বত্রই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, সংঘাত,কুফরি মতবাদ ও মুনাফিকির মুকাবিলা করতে হয়েছে। শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করার পরও যে জাতি আজিবন প্রিয় নবীজী সা.-কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, সে সকল গোত্রকে মক্কা বিজয়ের দিন অতুলনীয়ভাবে ক্ষমা প্রদর্শন করে পৃথিবীর ইতিহাসে মহত্ত্বের বে-নজির দৃষ্টান্ত স্হাপন করেন।

মক্কাবাসিকে পাহাড়সম উদারতার মনোভাব দেখিয়ে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। আপন ক্ষমা-মহত্ত্ব ও উদারতার দ্বারা মানুষের মন জয় করা, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস এই বিশ্বে একেবারেই দুর্লভ।

মহানবী সা.-এর ৬৩ বছরের মক্কা-মদিনার আদর্শিক জীবনে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্হায় শান্তি-শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতা ও পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত মহান নবুয়তি দায়িত্ব সুচারুভাবে সমাপন করে গিয়েছিলেন। তাঁর ইসলাম প্রচার যেমন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছিলো, তেমনিভাবে প্রতিরোধেমূলক যুদ্ধও করেছেন বিশ্ব মানবতার শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। জীবনে অনেক যুদ্ধে শত্রু মুকাবিলা করা সত্ত্বেও কোনাটাই আক্রমণাত্নক ছিলো না।

স্বয়ং রাসুল সা.-জীবনে ২৩টি বা ২৭ টি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সাহাবায়ে কেরামের নেতৃত্বে ৪৭ বা ৫৭ টি অভিযান পরিচালনা করেন। ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারের পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে সংলাপ, সমাঝোতা করে অসংখ্য চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেন। এগুলোর সবই  বিশ্বে শান্তি-স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অবধান রেখেছিলো।

আজ চতুর্মুখি সমস্যায় জর্জরিত বিশ্বের মানুষ তাদের  মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ, প্রতিনিয়ত ঝরছে নিরহ মানুষের রক্ত। যেখানে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি -সৌহার্দতা বিনষ্ট হচ্ছে,  রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষায় হযরত মুহাম্মদ সা.- জীবনাদর্শ ও সর্বজনীন শিক্ষার অনুসরণই বহুপ্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শের মডেল হিসেবে মেনে নেয়া যেতে পারে। পুরোপুরিভাবে নববী আদর্শ মান্য করার মাধ্যমেই  আবারো সারাবিশ্বে শান্তি-সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা সম্বব।

টিএ/