বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা : সমাধান কোন পথে?
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ০৯:৩০ রাত
নিউজ ডেস্ক

আবু হামদান, নিজস্ব প্রতিবেদক

সম্প্রতি দেশে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত এক জরিপে এমন হতাশাজনক তথ্যই উঠে এসেছে। ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান: কোন পথে সমাধান’— শীর্ষক সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা গেছে, চলতি বছর প্রথম ৮ মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) ৩৬১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে অধিকাংশই নারী শিক্ষার্থী।

এছাড়া গত ৮ মাসে আত্মহত্যাকারীদের মাঝে স্কুল শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ জন এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী ৩০ জন। আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী— দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন; যাদের মধ্যে তরুণ এবং নারীদের সংখ্যা বেশি। সেই হিসাবে প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কেন? — এ ব্যাপারে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাওলানা মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় জড়িত এ অধ্যাপকের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ও তার প্রতিকার বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কেন? — এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এটা বয়সের দোষ। আত্মহত্যার শিকার শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ কিংবা মাদরাসায় পড়ার কারণে এ পথ বেছে নেয়নি। জীবনের এই সময়টায় বাচ্চাদের মনে নানান ধরনের চিন্তা ঘুরপাক খায়। সেখান থেকে এই অপরাধের ডালপালা গজায়। এ কারণে এই বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।

বিষয়টা যদি আরও সহজ করে বলি, এখন দেখবেন স্কুল পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইল। তা দেখে সহপাঠীদের কেউ কেউ মোবাইলের জন্য বাবা মায়ের কাছে আবদার জানায়। পরিবার তার আবদার রক্ষা না করলে সে অভিমানে আত্মহত্যার মতো অপরাধকে বেছে নেয়। শুধু মোবাইল নয়, এই বয়সে তাদের মনে অনেক জিনিসের বায়না থাকে, সেসব পূরণে ব্যর্থ হলে অভিমান করে বসে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। আলোচ্য গবেষণা পত্রে আত্মহত্যায় নিহত শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর বড় কারণ হিসেবে ‘অভিমান’ করাকে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, কলেজ পর্যায়ে প্রেমঘটিত বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি এমন—  অনেকে তার প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন মেলামেশার পর যখন সমাজে তার স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না, তখন হতাশায় সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের মনের মধ্যে পরিবারের ভয়, মান-সম্মান খোয়ানোর ভয় কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, কেউ কেউ নিজের কাছের মানুষের মাধ্যমে ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এরপর শুরু হচ্ছে ডিপ্রেশনের জীবন। মাদক কিংবা অন্য কোনো পন্থায় নিজের জীবনকে তিলতিল করে শেষ করছে। কেউ কেউ তাৎক্ষনিক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রেম ছাড়াও চাকরি জীবনের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে হতাশা তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যত অন্ধকার ভেবে অনেকে হতাশাগ্রস্থ হয়ে আত্মহত্যা করছে। আর প্রেমঘটিত কারণে মেয়েরাই বেশি আত্মহত্যা করে।

তবে সার্বিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রেরও কিছু দায় আছে বলে মনে করেন গাজীপুরের নবদিগন্ত স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যাপক মাওলানা আবু বকর। তার মতে, আগে মুক্ত পরিবেশ বেশি ছিল। ছেলে-মেয়েরা ইচ্ছামত খেলাধুলা, ঘোরাফেরা করতে পারতো, ফলে তাদের মনও ভালো থাকতো। ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপকতা ছিল।

তিনি বলেন, আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখিত বিষয়গুলিও আগে আমাদের সমাজে তুলনামূলক কম ছিল। এখন আধুনিকতার নামে নানাবিধ সংকট তৈরি হচ্ছে। আমাদের সন্তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিবেশ অনেকটাই সঙ্কুচিত। বেশিরভাগ সময়ই তরুণেরা একা একা কাটায়। এতে তাদের মানসিক চাপ ও হতাশা বেড়ে যায় অনেকটা। সুতরাং রাষ্ট্রের উচিত তরুণদের জন্য সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করা; যাতে তারা আনন্দে বাঁচতে পারে।

মাওলানা গোলাম রাব্বানী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতার পেছনে ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে, অনেকে জানেন-ই না আত্মহত্যা করা মহাপাপ। এই অপরাধ মানুষকে পরকালেও শান্তিতে থাকতে দেবে না। আবার কেউ জানলেও ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব না থাকার কারণে এই অপরাধকে ছোট করে দেখছেন।

গবেষণায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে—  এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুই ধরনের মাদরাসা রয়েছে। আলিয়া মাদরাসা ও কওমি মাদরাসা। আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে যেটা বললাম সেই মনোভাবই কাজ করে। আর কওমি মাদরাসায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা আপনি দেখাতে পারবেন। ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাবটা বেশি থাকার কারণে এখানে আত্মহত্যার হারও কম।

আলিয়া হোক কিংবা কওমি, তারা তো নূন্যতম ইসলামি জ্ঞান রাখেন। কুরআন হাদিসের জ্ঞান থাকার পরও তারা কেন আত্মহত্যা করেন? — এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা গোলাম রাব্বানী বলেন, আমাদের দেশে একটা কথা বলা হয়, অনেক সময় নসিহত করা যায় কিন্তু নসিহত পালন করা কষ্টকর হয়ে যায়। কুরআন- হাদিসে যেখানে হতাশ না হতে বলা হয়েছে, বারবার আল্লাহর রহমত তালাশ করার কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়গুলো জানার সাথেসাথে অন্তর দিয়ে অনুধাবন না করলে হতাশা বাড়তে থাকবে। কারণ মাদরাসায় পড়লেও তারা রক্ত-মাংসের মানুষ। 

যেভাবে কমানো যেতে পারে এ প্রবণতা

পরিবার বন্ধুবান্ধব এবং সামাজিক পরিবেশ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়া গেলে আত্মহত্যার হার অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন মাওলানা আবু বকর। তিনি বলেন, মানুষ আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে নানা ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায় তার মধ্যে। যেমন দীর্ঘক্ষণ একা একা থাকতে পছন্দ করে, তার প্রিয় জিনিসগুলো অন্যকে দিয়ে দিতে শুরু করে ইত্যাদি। অনেকে বিভিন্ন সময় আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। এসব লক্ষণ প্রকাশ পেলে পরিবারের উচিত তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। তাকে সময় দিয়ে তার সমস্যাগুলো উপলব্ধির চেষ্টা করে তা সমাধানে সহায়তা করা। প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নেওয়া।

মাওলানা গোলামা রাব্বানী বলেন, সর্বপ্রথম দায়িত্ব মা-বাবার। প্যারেন্টস সবসময় খেয়াল রাখবেন তার সন্তান কার সাথে মিশছে, কী করছে। হারাম রিলেশন ও প্রেমঘটিত বিষয়গুলো থেকে পরিবারকে আগলে রাখতে হবে। অনেকসময় অভিভাবকরা লাগামহীনভাবে তাদের ছেড়ে দেয়। অল্প বয়সেই মোবাইল হাতে দিচ্ছেন। সন্তান কার সাথে কথা বলে, মোবাইল-কম্পিউটারে কী ধরনের ভিডিও কনজিউম করে এসবের কিছুই খেয়াল রাখে না। যে কারণে দেখা যায়, বাচ্চার ভেতর উল্টাপাল্টা মানসিকতা কাজ করছে। সে একসময় একা হয়ে যায়, পথ হারিয়ে ফেলে। একদিন নিজেকেও হারিয়ে ফেলে। আমাদের সন্তানরা যেন পথ না হারায় সেদিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সবসময় বাচ্চাদের উৎসাহ প্রদান করা, সফলতার চেষ্টা করতে বলা। কেউ কোন কাজে অকৃতকার্য হলে তাকে তিরস্কার না করে নতুন করে সেই কাজ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া। ‘এখন হয়নি পরেরবার হবে।’ অনেকসময় পরীক্ষায় ফেল করার কারণে কেউ কেউ আবেগী হয়ে আত্মহত্যা করছে। এ সব বাচ্চাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। 

কেএল/