কালো জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের শিকার হলে বুঝবেন যেভাবে
প্রকাশ:
০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ০৮:৫৩ রাত
নিউজ ডেস্ক |
।।নাজমুল হুদা মাহী।। ব্লাক ম্যাজিক বা কালো যাদুর ইতিকথা: মানব সভ্যতার শুরু থেকেই যাদুবিদ্যা আর যাদুকর এই দুইয়ের প্রতিই মানুষের আগ্রহ সীমহীন। পৃথিবীর মানুষের লোকসংস্কারের একটা বড় অংশই হলো যাদুবিদ্যা। যাদুবিদ্যা মূলত অতিন্দ্রীয় আর প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করার বিদ্যা! কালো যাদুর ইতিহাস: কালো যাদু বা অন্ধকার যাদু হলো এমন এক ধরনের চর্চা যা অন্যের অনিষ্ট সাধনে কিংবা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে করা হয়। এটি অতিমানবিক ও অশুভ শক্তির সংশ্লিষ্টতা । কালো যাদু সাধারনত অতিমানবিক শক্তি দ্বারা করা হয় । তবে অনেকে বলেন এতে ভূত, প্রেত, আত্মা, প্রেতাত্মা ব্যবহার করা হয় । অর্থাৎ বলা হয় যে কালো যাদু দিয়ে ভুত, প্রেত, প্রেতাত্মা ইত্যাদি বশ করে তাদের দিয়ে নানা কাজ করা যায়। যারা কালো যাদু করে তাদের কালো যাদুকর বলা হয়। এগুলো বস্তুত তুকতাক প্রক্রিয়া। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ পাওয়া দুষ্কর যেখানে কালো যাদুর চর্চা হয় না। হিন্দু ও বৌদ্ধরা বহু প্রাচীন কাল থেকেই কালা যাদুর সাহায্য নিয়ে আসছে। হিন্দু তন্ত্রসাধনায় মূলত কালা যাদুরই চর্চা হয়ে থাকে। সভ্যতার শুরু থেকেই যাদুবিদ্যা আর যাদুকর বিষয়ে মানুষের প্রচণ্ড রকম অভিনিবেশ। যাদুবিদ্যা মূলত অতীন্দ্রিয় আর প্রাকৃতিক শক্তিকে নিজ আয়ত্বে নিয়ে আসার বিদ্যা! ইংরেজি ‘ম্যাজিক’ শব্দের উৎপত্তি ফারসি শব্দ মাজি থেকে! মাজিরা যে সব ক্রিয়া-কর্ম পালন করত, গ্রিকরা সেসবকে ম্যাজিক বলে অভিহিত করতেন! আর ম্যাজিকের সঙ্গে আত্মা বা ভূতের বিষয়টি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ভূত হলো এমন এক জিনিস, যা মৃত ব্যক্তির আত্মা। আর তা জীবিত ব্যক্তির সামনে দৃশ্য আকার ধারণ বা অন্য কোনো উপায়ে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম। ভৌতিক অভিজ্ঞতায় ভূতকে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কখনো অদৃশ্য বা অস্বচ্ছ বায়বীয় আবার কখনোবা বাস্তবসম্মত সপ্রাণ মানুষ বা জীবের আকারে। আর এসব ভূত বা প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভবিষ্যদ্বাণী বা কোনো কাজ করার বিদ্যাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক, নেক্রোম্যান্সি বা কালো যাদু বলে। খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনেরও আগের কথা। বহুকাল আগে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের প্রচলন ছিল না। তবে তাদের মধ্যে অদ্ভুত কিছু বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের চর্চা ছিল। এরা এক একটি গোত্র বিভিন্ন কাল্পনিক ভূত-প্রেত বা অশুভ আত্মার আরাধনা করত। যা আফ্রিকান ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো যাদু নামে পরিচিত। এমনকি এখনো এ বিদ্যার গোপন অনুসারীরা তাদের এ বিদ্যা দিয়ে মানুষের ক্ষতি সাধন করে থাকে। এ বিদ্যায় পারদর্শীদের ডাকা হয় ওঝা, আর আফ্রিকান ভাষায় এদের বলে কিনডকি। যাদুবিদ্যার প্রাচীন ইতিহাস যদি আমরা খুজে দেখতে চাই তাহলে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সেই প্যালিওলিথিক যুগের গুহামানবদের গুহাচিত্রের দিকে। অরিগেনেসিয়ার নামক গুহায় বেশ কিছু মুখোশ পরা মানুষ আর জন্তু জানোয়ারের ছবি দেখা যায়, যেখানে মানুষগুলোর হাতের আঙ্গুলের প্রথম গিট পর্যন্ত কাটা! যদিও নৃত্বাত্তিকেরা এদের কুষ্ঠরোগ আক্রান্ত মানুষ বলে বর্ননা করেছেন, তবে যাদুবিদ্যা বিশারদদের মতে মৃত্যুকে জয় করার জন্যই হাতের আঙ্গুল কেটে তা নিবেদন করার রীতি সে আমলে প্রচলিত ছিল। দেহের অংশ বিশেষ দিয়ে গুন (ব্লাক ম্যাজিক) করার রীতি বাংলাদেশেও দেখা যায়! প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ গুলোতেোও নানা আঙ্গিকের যাদুবিদ্যা চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায় সমসাময়িক ধর্মগুরু আর জনগনের ! মাজিয়ান ধর্মের ধর্মীর আচার অনুষ্টান গুলো পালনের নেতৃত্ব দিত যারা তাদের বলা হয় মাজি! এই মাজিরা মূলত: জ্যোতিষী, গনৎকার হিসাবে পরিচিত ছিল, এরা সূর্য, চন্দ্র, মাটি, পানি বাতাস প্রভৃতির উদ্দ্যেশে শিশু ও পশু বলি দিয়ে দেহ রক্ত শুদ্ধ করত! ইহুদিদের বাইবেল(ওল্ড টেস্টেমেন্ট) যাদুবিশ্বাসের উল্লেখ আছে, আল-কুরআনের সুরা বাকারা ২৬৯ আয়াত) একটি অংশের কথাও উল্লেখ করা যায় : "আরও স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, ইব্রাহীম (আঃ) যখন বলেছেন: হে আমার প্রভু, মৃতকে তুমি কিভাবে জীবিত করবে, তাহা আমাকে দেখিয়ে দাও। আল্লাহ ইরশাদ করলেন: তবে তুমি ইহা বিশ্বাস কর নাই, ইব্রাহীম উত্তরে বললেন, হ্যাঁ নিশ্চই (বিশ্বাস করি) তবে আমার অন্ত:করণ স্বস্তিলাভ করুক এই জন্য (প্রার্থনা); আল্লাহ বললেন: তাহলে তুমি চারটা পাখি গ্রহণ কর এবং সেগুলোকে নিজের প্রতি অনুরক্ত করে নেও, তাহার পরে সেগুলো আলাদা আলাদা চারটি পর্বতের উপর রাখবে তারপর ডাক দাও সেগুলোকে-দেখবে তারা ছুটে আসতেছে তোমার কাছে----" মেসোপটেমিয় সভ্যতা গুলো থেকে যাদুবিদ্যার প্রচুর ট্যাবলেট পাওয়া গিয়েছে, যেখানে তিন শ্রেনীর পুরোহিতের কথা বলা হয়েছে----বারু,এরা ছিল যাদুকর ও গুনিক, এরা মৃত প্রানীর যকৃৎ, নাড়ি ভুড়ি দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করতো। অসিপু নামের আরেক শ্রেনীর পুরোহিত ছিল ওঝা, এরা ভুত প্রেত তাড়াত! তবে যাদুবিদ্যায় যারা সবচাইতে বেশি ভূমিকা রেখেছে তারা হলো প্রাচীন মিশরীয়রা। চতুর্থ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হবার আগে থেকেই মিশরে ব্যাপক হারে যাদুবিদ্যার চর্চা শুরু হয়! ভুত প্রেতের প্রভাব থেকে শুরু করে রোগব্যাধীর নিরাময় এমন কি সাপে কাটলেও তার প্রতিকারের জন্য আলাদা আলাদা যাদুবিদ্যার আশ্রয় নিত এরা, আর এইসব কাজ করার জন্য আলাদা আলাদা ওঝা ছিল! এরা নিগ্রো আর এশিয়ার মৃত নারীর আত্মা সম্পর্কে খুব ভয় পেত, আর ভয় করতো নিজের আত্না হারানোর! তারা মনে করতো যাদুকরেরা ইচ্ছা করলে যাদুর সাহায্যের অন্যের আত্মাও চুরি করতে পারে! তৃতীয় রামেসেসের সময়ে হুই নামের এক যাদুকর সম্রাট রামেসেস ও তার পরিবারের সকল সদস্যদের মূর্তি বানিয়ে এর মাধ্যেম রামেসেসের বংশ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রও করেছিল একবার। ইহুদির মিশরে বন্দী অবস্থায় অবস্থানের সময়েই মিশরীয় যাদুবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল! অবশ্য তাদের নিজেদেরও আলাদা বৈশিষ্ট্যময় যাদু বিশ্বাস ছিল।তাদের বিশ্বাস মতে স্বর্গভ্রষ্ট আদম পৃথিবীতে যাদুবিদ্যাসংক্রান্ত একটা বিশেষ বই এনেছিলেন, যার নাম দ্যা বুক অব রাজিয়েল! আবার কারো কারো মতো স্বর্গভ্রষ্ট ফেরেশতা উজ্জা ও আজাইল একজন নারীকে যাদুবিদ্যার গান শিখিয়েছিলেন। ইহুদি যাদুকরেরা বাস্পস্নানের মাধ্যমে বলি আর উপহার দিয়ে অতিপ্রকৃত শক্তিকে বশ করার চেষ্টা করতো! এদের যাদু চর্চায় স্হূল যৌনাচার হত এছাড়া অল্পবয়স্ক বালকদের ব্যাবহার করতো অতিন্দ্রীয় শক্তির সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে। তারা মনে করতো যাদুবিদ্যার সবার পক্ষে আয়ত্বকর সম্ভব না, শুধু মাত্র বিশেষ দক্ষ ব্যাক্তিদের পক্ষেই এটা সম্ভব আর এই বিশেষ দক্ষ ব্যাক্তিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো কিং সলোমন! তার ' কি অফ সলোমান' বইটা পরবর্তীকালে যাদুবিদ্যার সর্বশ্রেষ্ট বই হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। ব্ল্যাক ম্যাজিক এর উৎপত্তি: আত্মাসংক্রান্ত ধারণা থেকেই উদ্ভব। পৃথিবীতে সেই আদি কাল থেকেই মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চর্চা ছিল। যুগ যুগ ধরে এই চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বহুকাল আগে পাশ্চাত্যের ধর্মহীন গোত্রের লোকেদের মধ্যে অদ্ভুত কিছু বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের চর্চা ছিল। এরা এক একটি গোত্র বিভিন্ন কাল্পনিক ভূত-প্রেত বা অশুভ আত্মার উপাসনা করত। আর নিজেদের প্রয়োজনে এই আত্মাকে ব্যবহার করত। এই বিশ্বাসের চর্চা ছিলো মূলত আফ্রিকানদের মধ্যে। আর তাই বিশ্বজুড়ে এটি আফ্রিকান ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো যাদু নামে পরিচিত। এমনকি এখনো এ বিদ্যার অনুসারীরা গোপনে তাদের এই যাদু চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত প্রাক-শিক্ষিত সংস্কৃতির সর্বপ্রাণবাদ ও পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে ভূত বা আত্মাসংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার প্রথম বিবরণ পাওয়া যায়। সে যুগে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রথা, অন্ত্যেষ্টি সংস্কার, ভূত তাড়ানো অনুষ্ঠান ও যাদু অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো। আর এসব আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মৃত আত্মার সন্তুষ্টি আনয়ন। মূলত আত্মাসংক্রান্ত সেই ধ্যান-ধারণা থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো যাদুর বিবর্তন। রোজাদের দাপুটে প্রথা আদিম সমাজে ঐইভাবে ধর্মের চর্চা না থাকলেও যেসব লোক আধ্যাত্মিক চর্চা করতেন, তাদের আলাদা দাপট ছিল। সাধারণ মানুষ এদের প্রচণ্ড রকম ভয়ের চোখে দেখতো। আদিম সমাজের এমনই এক ধরনের মানুষ ছিল যাদের উইচ-ডক্টর বা রোজা নামে ডাকা হতো। এরা এমন ব্যক্তি ছিলেন যারা ব্ল্যাক ম্যাজিক জানতেন। অতীন্দ্রিয় শক্তির বলে প্রেতাত্মাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আর প্রেতাত্মাদের দিয়ে সম্ভব-অসম্ভব যে কোনো কাজ করে ফেলতে পারতেন খুব সহজেই। সে কারণে ওই সময় রোজারা একাধারে চিকিৎসক, যাদুকর এবং পুরোহিতের ভূমিকা পালন করতেন। বর্তমানকালেও আদিম-সামাজিক ব্যবস্থায় বসবাসকারীদের মধ্যে উইচ-ডক্টর বা রোজাদের প্রভাব দেখা যায়। আদিম জাতিদের মধ্যে রোজাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হতো। রোজারা তাদের ডাকিনীবিদ্যা খাটিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলে দিতে পারত। চোর বা হত্যাকারী ধরা ও শাস্তি প্রদানে রোজাদের অপরিহার্য ভূমিকা ছিল। এ ছাড়াও তারা যাদুবিদ্যার সাহায্যে রোগ নির্ণয় এবং এর প্রতিকার করতো। তারা তাদের শিশুদের রোগাক্রান্ত করতে পারতো এবং মানুষের মৃত্যুও ঘটাতে পারতো। মানুষের মৃত্যু ঘটানোর জন্য তারা নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতো। কখনো মানুষের একটি ছোট আকৃতির পুতুল তৈরি করে তাতে পিন বিদ্ধ করতো। আবার কখনো কোনো লোকের চুল বা নখের টুকরো সংগ্রহ করে তা মাটিতে পুঁতে রাখতো। এগুলো যখন আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেত মানুষটিও ক্রমে মৃত্যুমুখে পতিত হতো। রোজারা প্রায়ই রোগের চিকিৎসার জন্য গাছ-গাছড়া, লতাপাতা ব্যবহার এবং রোগের সংক্রমণ দূর করার জন্য জল ব্যবহার করত। কখনো তারা যাদুকরী পাথরসহ জল ছিটিয়ে দিত। তারা যাদুকরী গান, প্রার্থনা এবং আশ্চর্য ভঙ্গিমায় নৃত্য করত। এর উদ্দেশ্য ছিলো সাধারণ মানুষের মনকে প্রভাবিত করা। রোজারা সব সময় রঙিন পোশাক পরিহিত থাকতো, মুখোশ ধারণ এবং মুখমণ্ডল চিত্রিত করত। কেউ কেউ পশুর চামড়াও পরিধান করত। বস্তুত মানুষকে মুগ্ধ করত। আর লোকজন মনে করতো যে তাদের সৌভাগ্যের পিছনে রোজাদের ক্রিয়ারই প্রভাব। শয়তানের প্রতীক: যেটায় একটা প্রেতাত্মাকে তিনি আটকে রেখে ছিলেন আর এটাকে দিয়ে সব কাজ করাতেন। তার মৃত্যুর পরে প্রকাশ্য জনসভায় আংটিটা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। গর্ভবতী নারীদের প্রসব বন্ধ করা থেকে শুরু করে যৌনাকাঙ্ক্ষা চিরতার্থ করার মতো বীভৎস সব যাদু বিধানের চর্চা হতো তখন। এ সময়ে বিশ্বাস করা হতো বশীকরণের মাধ্যমে মানুষকে দাস বানিয়ে রাখা যায়। যে কোনো বিপজ্জনক কাজে যাওয়ার আগে ‘প্রয়োজনীয় মন্ত্রপুত জামা’ পরে যাওয়ার রীতি ছিল, কুমারী মেয়ের বড় দিনের এক সপ্তাহ ধরে এই ধরনের জামা ঘরে বুনত। ‘বান’ ছেঁড়ার কথা বাংলাদেশে অপরিচিত নয়, মধ্যযুগের এই (Magical Arrow) ধারণাটার ব্যাপক প্রচার ছিল। বিশ্বাস করা হতো এভাবে মানুষের ক্ষতি করা সম্ভব! মধ্যযুগে রেনেসাঁর আলো যতই ছড়াক না কেন, ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানদের হাত থেকে কেউই রক্ষা পায়নি। যাদুবিদ্যার নানান প্রকার: যাদুবিদ্যার প্রচলন সব সময়ই কৌতূহলজনক। সেজন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজবিদ- নৃতাত্ত্বিকরা সমাজে প্রচলিত যাদু বিধানগুলো পর্যালোচনা করে এর শ্রেণি বিন্যাস করেন। যেমন স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের মতে যাদুবিদ্যার বিধানগুলো প্রধানত দুই রকমের হোমিওপ্যাথিক এবং কনটেজিয়াস ম্যাজিক। হোমিওপ্যাথিক ম্যাজিক সব সময়ই শত্রু ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে শত্রুর প্রতিমূর্তি [মোম, মাটি, কাঠ, কাপড়] বা ছবি ইত্যাদি তৈরি করে পুড়িয়ে বা ছুরি দিয়ে কেটে ধ্বংস করা হয়। ধারণা এই যে, মূর্তিটা যে যন্ত্রণা পাচ্ছে, শত্রুও তেমন যন্ত্রণা বা আঘাত পাচ্ছে। এটাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে। তবে এই যাদু আবার অনেক সময় মানুষের উপকার বা ভালোর জন্যও ব্যবহার করা হয়। যেমন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে এমন একটা যাদু বিধান আছে, কোনো নারীর সন্তান হচ্ছে না, তখন একটা কাঠের ছোট শিশু বানিয়ে নিঃসন্তান রমণীটির কোলে বসিয়ে আদর করে। এর ফলে তার সন্তান হবে এমন ভাবা হয়। কখনো কখনো রোগের চিকিৎসার জন্যও এই ধরনের যাদুর প্রয়োগ দেখা যায়। অন্যদিকে কনটেজিয়াস ম্যাজিক হচ্ছে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশেষ যেমন চুল, নখ, থুথু বা পরিধেয় বস্ত্রের মাধ্যমে যাদু করে মানুষের ক্ষতি বা উপকার করা। এক্ষেত্রে শত্রুর আঙ্গুলের নখ, চুল, ভ্রু, থুথু -এসব সংগ্রহ করে মোমের সাহায্যে শত্রুর হুবহু প্রতিরূপ তৈরি করা হয়। প্রতিমূর্তিটি ছয় দিন ধরে মোমের তাপে ঝলসাতে হবে এবং সাত দিনের দিন মূর্তিটি পুড়িয়ে ফেললে শত্রুর মৃত্যু হবে! যাদুবিদ্যার ধরন আর প্রকারভেদ নিয়ে অনেকে অনেক মত দিয়েছেন, তাদের সব মতবাদ একসঙ্গে করলে বলা যায় যাদুবিদ্যা প্রধানত তিন ধরনের। প্রথমত, সৃজনধর্মী যাদু বা হোয়াইট ম্যাজিক। ফসলের ভালো উৎপাদন, বৃষ্টি নামানো, গাছে ভালো ফল হওয়া প্রেম বা বিয়ে ইত্যাদির উদ্দেশ্যে এ যাদু ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয়ত প্রতিরোধক যাদু। এই যাদুকেও হোয়াইট ম্যাজিকের মধ্যেই ফেলা যায়। এটা বিপদ-আপদ এড়ানো, রোগব্যাধি দূর করা আর কালো জাদুর প্রভাব এড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। আর সর্বশেষ প্রকারটিই হচ্ছে ব্ল্যাক ম্যাজিক বা ধ্বংসাত্মক ম্যাজিক। এটি রোগব্যাধি সৃষ্টি, সম্পত্তি ধ্বংস, জীবন নাশের কাজে ব্যবহার করা হয়। ডাইনিবিদ্যায় এর প্রয়োগ বেশি দেখা যায়। সেই ঐতিহাসিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত এর প্রভাব দেখা যায় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর। যাদুবিদ্যার প্রাচীন ইতিহাস যদি আমরা খুঁজে দেখতে চাই তাহলে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সেই প্যালিওলিথিক যুগের গুহামানবদের গুহাচিত্রের দিকে। অরিগেনেসিয়া নামক গুহায় বেশ কিছু মুখোশ পরা মানুষ আর জন্তু জানোয়ারের ছবি দেখা যায়, যেখানে মানুষগুলোর হাতের আঙ্গুলের প্রথম গিঁট পর্যন্ত কাটা! যদিও নৃতাত্ত্বিকেরা এদের কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে বিজ্ঞ যাদুবিদ্যাদের মতে মৃত্যুকে জয় করার জন্যই হাতের আঙ্গুল কেটে তা নিবেদন করার রীতি সে আমলে প্রচলিত ছিল। দেহের অংশ বিশেষ দিয়ে গুণ [ব্ল্যাক ম্যাজিক] করার রীতি এদেশেও দেখা যায়। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতেও নানা আঙ্গিকের যাদুবিদ্যা চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। সমসাময়িক ধর্মগুরু আর জনগণের মধ্যে। যাদুবিদ্যার এই চর্চা কখনই থেমে থাকেনি। আজো গোপনে একদল ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করে যাচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতেও যাদুবিদ্যা আর ধর্মের একটা জটিল সংমিশ্রণ দেখা যায়। এখনকার সমাজেও এমন অনেক বৈদিক যাদুবিদ্যাগত প্রক্রিয়া এখনো চালু আছে। এ ছাড়া জাপানের প্রাচীন শিন্টো ধর্মের মধ্যে যাদুবিদ্যা চর্চার কথা জানা যায়। জাপানিরা বিশ্বাস করে, চালের মধ্যে ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রতিহত করার বিশেষ শক্তি আছে। এ ছাড়া রাস্তার সঙ্গমস্থলও তাদের কাছে বিশেষভাবে পবিত্র। এসব স্থানে তারা এখনো জননেন্দ্রিয়র প্রতীক চিহ্ন স্থাপন করে, বিশ্বাস করে এই প্রতীক অশুভ শক্তিকে দূরে সরিয়ে রাখবে! জাপানিদের মতো চীনাদেরও ভূতপ্রেত সম্পর্কে বেশ ভালোই ভয়ভীতি ছিল। মজার ব্যাপার হলো, চীনের ঘরবাড়ি ও পুল নির্মাণে একটা বিশেষ দেবতা চীনাদের প্রভাবিত করেছে। এই দেবতার নাম হলো শা। শা হলো একটা অপদেবতা। আর চীনারা বিশ্বাস করে এই অপদেবতা সব সময়ে সোজা রেখা বরাবর চলে। তাই এটাকে প্রতিহত ছাদে আঁকা হতো বক্রতা আর কোণ! গ্রিকদের জাদুবিদ্যার জন্য বিশেষ বর্ণমালার সৃষ্টি করেছিল। এগুলো লেখা হতো পবিত্র কালি দিয়ে। আর লেখার সময় বার বার পাঠ করা হতো। কালা যাদুর ক্ষতিকর দিক: আধুনিক উইচ ক্রাফট পশ্চিমা জগতেও বহাল তবিয়তে আছে৷ বার্লিনে এক অ্যামেরিকান নারী পেশা হিসেবে যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করছেন৷ যাদুর এই প্রক্রিয়ার পারিশ্রমিক ১০০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে৷ কালা যাদু প্রয়োগ করার কারণে যে ক্ষতিগুলি হয়ে থাকে বলে অনেকে বিশ্বাস করে থাকেন, তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি ক্ষতির কথা নীচে উল্লেখ করা হল: (১) স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে নিত্য কলহ হয়েই চলেছে, এমনকি কখনও তা মারামারির পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে, অথচ কেউ কাউকে ছেড়ে যাচ্ছে না, তা হলে বুঝতে হবে, কেউ কালা যাদু প্রয়োগ করেছে। (২) স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে এমন কিছু ঘটে গেল, যার জন্য হঠাৎ ডিভোর্স ফাইল করে বসলেন তাঁরা, এগুলি অনেক সময় কালা যাদুর প্রয়োগের জন্য হয়ে থাকে। (৩) স্ত্রী তাঁর স্বামীকে ভয়ঙ্কর ঘৃণা করতে থাকেন। তাঁকে হেয় করতে থাকেন ক্রমাগত। এটাও কালা যাদুর জন্য হতে পারে। (৪) সব সময় মাথা ধরে রয়েছে, নানা ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে, কিছুতেই সারছে না— কেউ কালা যাদু প্রয়োগ করেছে বলে ঘটতে পারে। (৫) বিনা কারণে কিছু দিন ধরে শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হয়েছে বা কথা বলতে গেলে বা গান করতে গেলে গলা ধরে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা গায়কদের সঙ্গে হয়ে থাকে। তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ পেশাদার কালা যাদুর এক্সপার্ট দ্বারা এই ক্ষতি করাতে পারে। (৬) হঠাৎ করে কানে কম শোনা কালা যাদুর জন্য হয়ে থাকে। হঠাত্ দাঁতে ব্যথা হওয়া, রক্ত পড়া, দাঁতে ক্ষয় কালা যাদু দ্বারা আক্রান্ত হলে হয়। হঠাত্ চোখে কম দেখা বা নাড়ীর গতি বেড়ে যাওয়া, এইগুলি কালা যাদুর মধ্যেই পড়ে। (৭) নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে বা পরে ঋতুমতী হওয়া, এটাও পেশাদার কালা যাদুর ওঝার দ্বারা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, অনেক মহিলার নির্দিষ্ট বয়সের সাত অথবা আট বছর আগেই ঋতু বন্ধ হয়ে যায়। এটাও কালা যাদুর জন্য ঘটে থাকে। (৮) গৃহপালিত পশু মারা যায় বাণ মারার জন্য। ঠিক একই কারণে গরুর দুধ হয় না, গোয়ালে গরু ঢুকলেই লাফাতে থাকে বা বেরিয়ে আসতে চায়। হামেশাই এইগুলি ঘটতে থাকলে বুঝতে হবে, কেউ কালা যাদু করেছে। ৯) অনেকে ঘুমের মধ্যে কোনও স্বপ্ন দেখতে পান না, ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা মানুষের অবচেতন মনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।কিন্তু কালা যাদুর সাহায্যে এই দেখাকে বন্ধ করা যায়। (১০) ভাল স্বভাবের বাড়ির মেয়ে হঠাৎ স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায় এমনই কালাযাদুর প্রভাব। (১১) বিনা কারণে হঠাৎ চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া বা ছাঁটাই হওয়াটাও কালা যাদুর জন্য হতে পারে। অনেক চেষ্টা করেও আয় বাড়াতে পারেন না, প্রমোশন হয় না এ সব ক্ষেত্রে। (১২) বহু মহিলার বিনা কারণে অনেক বার ‘মিসক্যারেজ’ হয়। এ ক্ষেত্রেও অনেক সময় দায়ী হয় কালা যাদু। (১৩) অনেকের সিগারেটে মারাত্মক আসক্তি থাকে। বহু চেষ্টা করেও ছাড়তে পারেন না। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় খুব কাছের বন্ধুরা কালা যাদু করে থাকে। (১৪) অনেক সুন্দরী বিবাহিতা হঠাৎ করে স্বামীর মুখে বন্য জন্তুর মুখ দেখতে পান। ভয়ে স্বামীকে এ কথা বলতে পারেন না। এ সব ক্ষেত্রে অবশ্যই কালা যাদুর হাত থাকে। এই ধরনের ঘটনা ইউরোপে বা আমেরিকায় প্রতিনিয়ত ঘটে। উপসংহার : আমাদের জিবনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কালো ম্যাজিকের ভয়াল থাবা রয়েছে। কোরআন ও হাদিসের বর্ণিত আমলের মাধ্যমে আমরা এই অনিষ্ট বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হবো। -লেখক, শিক্ষার্থী। |