|| হাসান আল মাহমুদ ||
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তার অধীনে ‘নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারের’ লক্ষ্যে গঠিত বিভিন্ন কমিশন নানা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। বিশেষ করে ‘পিআর’ পদ্ধতির দিকে নজর দিচ্ছে অনেক রাজনৈতিক দল। তবে একটি বড় দল এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে। প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই রয়েছে তারা।
এদিকে পিআর পদ্ধতি ছাড়া কোনো নির্বাচন নয় বলে সাফ জানিয়েছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলেন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম বলেছেন। এছাড়া দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘আমরা সব ক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চাই। ৩০০ বা ৪০০ আসন যা-ই হোক, সব জায়গায় পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।’
পিআর পদ্ধতি কেন প্রয়োজন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পিআর পদ্ধতির নির্বাচন না হলে কোনো অবস্থাতেই পেশীশক্তি ও কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। পিআর পদ্ধতি হলে কোনো ব্যক্তিকে নয় প্রতিকে ভোট হবে। যে প্রতিক যত ভোট পাবে সে অনুযায়ী তাদের প্রতিক সংসদে আসন পাবে।
এছাড়া, কাল শনিবার (২৫ জানুয়ারী) পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে নগর সম্মেলনও ডেকেছে দলটি।
পিআর পদ্ধতি কী?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ( পিআর ) বলতে বোঝায় যে কোনো ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থা যার অধীনে একটি নির্বাচকমণ্ডলীর উপগোষ্ঠী আনুপাতিকভাবে নির্বাচিত সংস্থায় প্রতিফলিত হয়। যেখানে শুধুমাত্র দলগুলির একটি পছন্দের অনুমতি দেওয়া হয়, প্রতিটি দল প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বা ভোট ভাগের অনুপাতে দলগুলির জন্য আসন বরাদ্দ করা হয় এবং আসন বন্টিত হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কেন চাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ?
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান আওয়ার ইসলামের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে শতভাগ ভোটারের ভোট মূল্যায়িত হয়। কোনো একটা ভোটও অবমূল্যায়িত হয় না।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, এখন বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, তাতে প্রার্থী ৩০ পার্সেন্ট ভোট পেয়ে এমপি হলো। আর বাকি চারজন মিলে ৭০ পার্সেন্ট পেলো। তাহলে এই ৭০ পার্সেন্ট ভোটের কোনো মূল্য থাকলো না।
পিআর পদ্ধতির খারাপ দিকও রয়েছেন জানান এই প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতির খারাপ দিক হলো, বিভিন্ন এলাকায় পাশ করার জন্য পার্টি থেকে নমিনেশন কেনাবেচা হয়। যাদের টাকা আছে, তারা নমিনেশন কিনে। তারপর স্থানীয়ভাবে তারা কালো টাকা ব্যবহার করে পেশিশক্তি ব্যবহার করে। বিভিন্নভাবে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য চেষ্টা করে।
‘পার্লামেন্টে তো আসলে যোগ্য ব্যক্তিরা যেতে পারেন না। সেখানে যারা যায়, আসলে শিক্ষিত মানুষের সংকট সেখানে থাকে। তারা পার্লামেন্টের গুরুত্বই বুঝে না। তারা বুঝে হলো টাকা কামানো।’- মন্তব্য করেন তিনি।
প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে সমস্যা কী?
প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনের অসারতা তুলে ধরে মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, এখন যেটা হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকান্ডের বরাদ্দ এমপিদের দিয়ে আসে। তাদের পিছনে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ঘুরে। এমপির কাজতো এটা না। স্থানীয় উন্নয়ন ডেভেলপমেন্টের জন্য তো স্থানীয় সরকার আছে। এমপিদের কাজ হল পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করবে। আইনের ব্যাখ্যা করবে। বাৎসরিক বাজেট নিয়ে চিন্তা করবে। বৈদিশিক চুক্তি ইত্যাদি নিয়ে বিশ্লেষন করবে। যারা সরকার পরিচালনা করে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে। বিশ্লেষন হবে। এখন যারা বিশ্লষন করবে, সমালোচনা করবে তারাই যদি সে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে থাকে, তাহলে সে সংসদ আসলে ফলপ্রসু হবে না।
পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে সফলতা কী?
দলটির যুগ্ম-মহাসচিব বলেন, বিগত ৫৩ বছরে দেখেছি এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে। এতে দেশটা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দৈত্য-দানব তৈরী হয়েছে। কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় নাই। এজন্য আমরা বলছি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে। যে দল যত পার্সেন্ট ভোট পাবে, পার্লামেন্টে তারা তত পার্সেন্ট সাংসদ হবে। কারো দশ পার্সেন্ট হলে দশটা আসন হবে। ত্রিশটা হলে ৩০টা আসন হবে। তাহলে এখানে প্রত্যেকটা দল যাদের নূন্যতম জনসমর্থ আছে, তারা প্রত্যেকেই প্রধিনিধিত্ব করতে পারবে। এতে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে। একটা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী হবে।
তিনি বলেন, দেখা যায়, কিছুর থেকে কিছু হলেই রাজপথে আন্দোলন হয়। সেটা কমে যাবে। কারণ যেহেতু প্রত্যেক দল যাদের জনভিত্তি আছে, যাদের প্রতিনিধি পার্লামেন্টে আছে, তারা ডিবেট করবে পার্লামেন্টে। এখানেই সব সমস্যার সমাধান হবে। রাজপথে আসার প্রয়োজন হবে না।
তিনি আরও বলেন, এটা নতুন কোনো সিস্টেম না। ওয়ার্ল্ডে প্রায় ৯১টা দেশে পিআর পদ্ধতিতে এখন নির্বাচন হচ্ছে। আমরা ২০০৮ সাল থেকে এ দাবি করে আসছি। আট সালে যদি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হত, তাহলে আওয়ামীলীগের মত দৈত্য ফ্যাসিস্টদের তৈরী সুযোগ থাকতো না। কারণ, পিআর পদ্ধতিতে কোনো দল এককভাবে বৃহৎ আকারে আসন পাওয়ার সুযোগ কম, যার কারণে সংবিধান পরিবর্তনের মত একক মেন্ডেট ক্ষমতা তাদের থাকে না।
হাআমা/