সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১২ জিলকদ ১৪৪৫


কুরআনের খেদমতে চাঁদপুরের অবদান পর্ব-১

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: নুর আলম সিদ্দিকী

|| হাসান আল মাহমুদ ||

বাংলাদেশে কুরআনের খেদমতে চাঁদপুরের অবদান অতুলনীয়। বিশুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষার মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়ে চাঁদপুরকে দেশ ও দেশের বাহিরে গৌরবান্বিত করেছেন প্রখ্যাত তিন আলেম মনীষী। ইতিহাস তৈরী করা চাঁদপুরের সেই কৃতী তিন সন্তান হলেন- উজানী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত পীর হজরত ক্বারী ইব্রাহীম রহ., চাঁদপুর মুমিনবাড়ি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ক্বারী ইব্রাহীম রহ. এবং নূরানী পদ্ধতির আবিষ্কারক শায়খুল কুরআন আল্লামা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন রহ.। বরেণ্য এ তিন আলেমের খেদমত ও মেহনতে বাংলাদেশে ইলমুল ক্বিরাআত তথা কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের প্রসারতা লাভ করে। 

বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ মুফতি, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া মোহাম্মদপুর, ঢাকা’র প্রধান মুফতি বহুগ্রন্থ প্রণেতা লেখক মুফতি হিফজুর রহমান- এর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাকে বিভিন্ন জিনিসের জন্য আল্লাহ পাক নির্বাচন করেছে। তন্মধ্যে ইলমে কেরাতের জন্য বৃহত্তর কুমিল্লা তথা বর্তমান চাঁদপুরের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিশেষভাবে হজরত মাওলানা ক্বারী বেলায়েত সাহেব রহ.- এর এলাকাটির ভূমিকা। তাঁর আগে সারা দেশে শাইখুল কুররা হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন হজরত ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব রহ.। তাঁকে সবার শীর্ষে রাখতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিলেন চাঁদপুর মোমিনবাড়ি মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব রহ.।’ (-শায়খুল কুরআন আল্লামা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. স্মারকগ্রন্থ: পৃষ্ঠা-২০০)

এছাড়া, বর্তমানে দেশ-বিদেশে হিফজুল কুরআনের খেদমতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন চাঁদপুরের আরেক কৃতী সন্তান হাফেজ ক্বারী শায়েখ আব্দুল হক। 

কুরআনের খেদমতে বাংলাদেশে কালজয়ী অবদান রাখা চাঁদপুরের মহান মনীষীদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখার আজ থাকছে প্রথম পর্ব। 

প্রখ্যাত  পীর ক্বারী ইব্রাহীম উজানী রহ. 

প্রখ্যাত পীর ক্বারী ইব্রাহীম উজানী রহ. ১৮৬৩ সালে নোয়াখালী জেলার নলুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রচলিত নিয়মে তিনি নিজ এলাকায় আরবি ও ফার্সির প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি পাড়ি জমান তৎকালীন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ ভারতের কলকাতা আলিয়া মাদরাসায়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তিনি নাহু-সরফ, মানতিক-বালাগাত, তাফসীর-হাদীসসহ উলূমে দ্বীনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন।

জানা যায়, ‘ভারতের কলকাতায় পড়াকালীন একটি অদৃশ্য টান তাঁর নিজের মধ্যে অনূভূত হয়। আর তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ তাজবীদের সাথে পড়া। যতই দিন যায় তার এই সদিচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কিন্তু তার জন্য কোনো উপযুক্ত স্থান পাচ্ছিলেন না। তাঁর মনের এমন ব্যাকুলতা দেখে বিজ্ঞ মহল তাঁকে আরবে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন, অবশেষে তিনি ভারত থেকে পবিত্র মক্কা মুয়াজ্জমায় হিজরত করেন।

মক্কায় এসে তিনি মাদরাসা আস-সাওলাতিয়ায় ভর্তি হন। সাওলাতিয়ার প্রধান উস্তাদ ছিলেন শায়েখ মুহাম্মাদ ইয়ারে কুসূস রহ.। এসময় মক্কায় আয়োজিত বিশ্বব্যাপী কুরআন প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি ছিলেন সে সময়ের বাদশাহ শরীফ হাসান। তিনি নিজ হাতে ক্বারী ইব্রাহীম রহ. কে অসংখ্য পুরস্কার দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেন এবং তাঁর এই অসামান্য যোগ্যতা ও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে মক্কার সাওলাতিয়া মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি সেখানে ১২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতাকালে মক্কার এক মেয়ের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ৩০ বছর বয়সে তিনি মক্কা থেকে স্বস্ত্রীক মক্কা ত্যাগ করেন।’ 

একটানা ১২ বছর পবিত্র কাবাগৃহের সন্নিকটে ইলমে নববীর খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পর তিনি জাহিরী ইলমের সাথে সাথে বাতিনী ইলম অর্জনেরও প্রয়োজনবোধ করেন। সেজন্যে তিনি ভারতের গংগুহে চলে আসেন এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত পীর ফক্বীহুন নফস হযরত রশীদ আহমদ গাংগুহী রহ.-এর কাছে বায়আত হন। মাত্র ১৮ দিনে তাঁর কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। তারপর তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

স্বদেশে এসে তিনি প্রথমে নোয়াখালী (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) জেলার রায়পুরে  কুরআনের খেদমত শুরু করেন। বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিখতে তাঁর কাছে হাজারো শিক্ষার্থী আসতে থাকে।

১৯০১ সালে তিনি চাঁদপুরের কচুয়ার উজানী গ্রামে জামিয়া ইসলামিয়া ইব্রাহিমিয়া উজানি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় স্থানীয় আলেম তাঁরই মুরিদ ও খলিফা ক্বারী আহমাদুল্লাহ ও আব্দুল মজিদ দরবেশ উজানীতে মাদরাসা ও বাড়ির জায়গার বন্দোবস্ত করে দেন। দ্বীনি খেদমতের তাগাদায় তিনি এখানেই স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেন।  

আব্দুল মজিদ দরবেশ রহ.-এর ছেলে বর্তমান চাঁদপুর কচুয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা ওহিদুল হক এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব তখন নোয়াখালী থাকতেন। একবার আমার বাবা ও কচুয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ক্বারী আহমাদুল্লাহ সাহেব পীর সাহেব হুজুরকে নবাবপুর নিয়ে আনেন দ্বীনি এক কাজে। নবাবপুর যাবার পথে বর্তমান উজানী মাদরাসার দীঘির পাড়ে বসে জিরালেন (তখন মাদরাসা হয়নি, দীঘিটা ছিল)। তিনি এখানে আসতেই এদিক-সেদিক তাকালেন। নির্জন জায়গা। সাড়ে চারশো বছর আগের বক্তার খাঁ শাহী মসজিদ এখানে। এমন দৃশ্য হুজুরের মনে ধরলো খুব। তাই বলে ওঠলেন- ‘এরে! এ জায়গাতে যদি আইতে পারতাম, এখানে ইবাদত কইত্তে ভাল্লাগতো’। তারপর আমার আব্বা ও ক্বারী আহমাদুল্লাহ সাহেবগণ সবাই মিলে পীর সাহেব হুজুরকে নিয়ে আনেন তাঁর পছন্দ করা জায়গা উজানীতে। এখানে জায়গা কিনে হুজুরকে বাড়িও করে দেন তাঁরা। বাড়ি ও মাদরাসার জায়গা কেনার দলিল-দস্তাবেজে আমার আব্বা ও ক্বারী আহমাদুল্লাহ সাহেবদের অনেক দস্তখত আছে।’ 

চাঁদপুরের কচুয়ার উজানী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসে ইলমুল ক্বিরাআতের সেবা চালিয়ে যেতে থাকেন ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব রহ.। সারাদেশ থেকে ছুটে আসে অগণতি শিক্ষার্থী। সুবিন্যস্ত পদ্ধতিতে সুললিত অভিনব সুরে কুরআনের কেরাত শিখে শিষ্যরা ছড়িয়ে পড়েন দেশ-বিদেশে। তাঁর সুরটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমন্ডলে পরিচিতি পায় ‘উজানী সুর’ নামে। উজানীর বার্ষিক মাহফিলে তাঁর শেখানো পদ্ধতিতে কুরআন তিলাওয়াত ও আজানের সুরে মুগ্ধতা ছড়ায় আজো।  

কুরআনের খেদমত, দ্বীন প্রচার, মুরিদদের তালিম-তারবিয়াতসহ নানা খেদমতের পাশাপাশি তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন। বিশুদ্ধভাবে কুরআন শেখার জন্য ইলমে ক্বেরাতের ওপর ‘নুজহাতুল ক্বারী’ নামে একটি কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেন। 

বহুগ্রন্থ প্রণেতা মুফতি হিফজুর রহমান বলেন, ‘ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব উজানী রহ. ইলমে ক্বিরাআতের উপর একটা কিতাবও লিখেছেন। নাম ‘নুজহাতুল ক্বারী’। এই কিতাবটি বাংলাদেশের প্রায় সবকটি মাদারাসায় সিলেবাসভুক্ত। আমরা নিজেরাও এই কিতাব পড়েছি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর এই কিতাবটি অত্যন্ত উপকারী।’ 

ক্বারী ইব্রাহীম সাহেব রহ. থেকে কুরআনের ক্বিরাত শিখে দেশ-বিদেশে আজো ছড়িয়ে আছেন অসংখ্য ক্বারী। সারাদেশে তাঁর অগণিত শিষ্য, মুরিদ ও বহু ভক্ত আশেকান রয়েছে। কুরআনের খেদমতে তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত উজানী মাদরাসা দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছে আজো। এছাড়া, বর্তমান চরমোনাইয়ের দাদা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. ছিলেন তাঁরই শিষ্য। ফলে তাঁরই থেকে চরমোনাই আধ্যাত্মিক ধারার প্রসার লাভ করে।

কুরআনের খেমদতে বিস্ময়কর অবদান রাখা মহান বুযুর্গ আলেম প্রখ্যাত ‘উজানী পীর’ ক্বারী ইব্রাহীম ১৯৪৩ সালে আপন প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। রেখে যান তিনি ১১ ছেলে ও ৭ মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র-শিষ্য, মুরিদান ও খলিফা। 

তাঁর ইন্তেকালের পর ছেলে মাওলানা শামসুল হক খেলাফতপ্রাপ্ত উজানী পীর হন। তাঁর ইন্তেকালের পর ছেলে মাওলানা মোবারক করীম হয়েছেন খেলাফতপ্রাপ্ত উজানী পীর। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মাওলানা আশেকে এলাহী ও মাওলানা ফজলে এলাহী খেলাফতপ্রাপ্ত উজানী পীর হিসাবে বর্তমানে জারি রেখেছেন ‘উজানী সিলসিলা’। আর অপর ছেলে মাওলানা মাহবুবে এলাহী উজানী মাদরাসার পরিচালনায় আছেন।

এনএ/

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ