শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মাওলানা শিব্বির আহমদ রহ. ইলমের আকাশে ডুবে যাওয়া সূর্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।মিযানুর রহমান জামীল।।

বাংলার এক ঐতিহাসিক ইমামের বিদায়— ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন। ইলমের আকাশে ডুবে যাওয়া সূর্য। হাজারও ভারাক্রান্ত মনের সাথে দেশের আকাশও আজ মেঘলা হয়ে ওঠেছে। আলেমের মরণ যেন জগতের মরণ।

হাটহাজারীর বাবা হুজুরের পর দাদা হুজুর মাওলানা শিব্বির আহমদ রহ.ও বিদায় নিলেন। এর দুইদিন আগে হুজুরের বিবি ইন্তেকাল করেন। এটা কেবল একটি পরিবারের অভিভাবকের বিদায় নয় বরং ইলমের আহালদের একজন রাহবারের চলে যাওয়া। তিনি যতটুকু চলে গেছেন তার চেয়ে বেশি রয়ে গেছেন লাখো হৃদয়ে৷

এইতো- হঠাৎ হুজুর হেসে দিলেন। কোনো কারণে আবার রাগ হলেন। অভিমান করলেন। ডাক দিলেন। শাসন করলেন। বুকে আগলে নিলেন। পরম স্নেহের চাদরে জড়ালেন। যারা খুব কাছের, ছাত্র, সন্তান কিবা পৌত্রের বয়সের- তাদের সাথে এ স্মৃতিগুলো খুব পরিচিত, মিষ্টি এবং কোমল। আমার সাথেও আছে হুজুরের অনেক স্মৃতি ও ভালোবাসার পাঠ। একটা কথা আছে- ইনসাফওয়ালা শাসক, রাজা বা সেনাপতি চলে গেলে প্রজারা ভেঙে পড়ে এটাই স্বাভাবিক।

হুজুরের সাথে সর্বশেষ সাক্ষাত হয় নোয়াখালীর প্রাচীন মাদরাসা দারুল উলূম চরমটুয়ায়। এর আগে নোয়াখালী মারকাযুল উলুমসহ বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে মাদরাসা দারুর রাশাদে যখন যেতেন তখন আমি হুজুরের সোহবত ও খেদমতে সর্বোচ্চ সময় দেয়ার চেষ্টা করতাম। বর্ণাঢ্য জীবনী সংগ্রহের জন্য জীবনের শেষ দিকে ঢাকার বাইরে- বিশেষ করে নোয়াখালীর বিভিন্ন প্রান্তে অনেকবার দেখা করার সুযোগও হয়। তখন হজুরের ছোট ছেলে আমার খুব আস্থাভাজন ব্যক্তি মাওলানা মুফতি আহমদ হাফিজাহুল্লাহ অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষাতের সময় সুযোগ করে দিতেন।

এর ভেতরে কত জোয়ার-ভাটা আর থেমে থেমে পথচলা। হুজুরের সাথে আমারও এক অনন্য জীবন কেটেছে৷ আমিও হজুরের সুভাসে মুগ্ধ ভোমরা। কখনও দীর্ঘ সময় কখনও অল্প সময় আবার কখনও বা দূর থেকে দেখে তড়িৎ সাক্ষাতে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। আজ থেকে এক যুগ আগে ২০১১ সালে কলমসৈনিক পত্রিকার কাজ শুরু করি আমরা। সে সুবাধে খতীবে আযম মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ রহ.,. চৌমুহনীর বড় হুজুর মাওলানা নূরুল হুদা রহ., জামেয়া ওসমানিয়ার মুহতামিম মাওলানা সানাউল্লাহ আব্বাসী রহ., মুফাসসীরে কুরআন আল্লামা মোস্তফা আল হোসাইনী রহ.,. জমিয়তের সভাপতি হাফেজ আনসার সাহেব রহ.সহ অনেক আলেমের জীবন ও কর্মের উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করি। সেই থেকে হুজুরের সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হয়ে যায়। খোঁজ-খবর বেড়ে যায়।

ফোন দিলে দরদি কণ্ঠে বলে উঠতেন- 'তুই দেয়া কত্তি আবি কোন সময়, ইত্যাদি?' (তুমি দেখা করতে আসবে কখন?) সেই গলা সেই শব্দ এখন আর শোনা যাবে না। তাঁর সুন্নতে নববীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার খণ্ড খণ্ড স্মৃতি আমার চোখে এখনও ভেসে ওঠছে। শতাধিক বাণী আর নসীহার মজলিসে কে শোনাবে মধুর কথা, ভুল হলে কে শাসাবে আমাদের? কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলতেন না তিনি। অপরাধকে সাধারণ ভাবতেন না। ইনসাফ করার ক্ষেত্রে অবলম্বন করতেন সর্বোচ্চ সচেতনতা।

২০০৫ সালে নোয়াখালীর জামিয়া ইসলামিয়া মাইজদীতে হুজুরের অনেক ঝলমলে স্মৃতির কথা শুনেছি উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ নোমান সাহেবের কাছ থেকে। আমাদের দরস শুরু হওয়ার আগে উস্তাদজী কিতাবের মুসান্নিফের ঘটনার সাথে মাঝে মধ্যে তাঁর আব্বাজানেরও মালফুজাত শোনাতেন। তখন থেকেই বেশ ভালো করে হুজুরকে দেখা, জানা এবং মানার চেষ্টা করতাম।

মাওলানা শিব্বির আহমদ রহ. এ পৃথিবীকে বরকতময় একটি ইলমী বংশ উপহার দিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ "কাশফুল বারী" এর লেখক মুফতি ইদরীস কাসেমী রহ.এর ভগ্নিপতি। এ বংশের মধ্যে রয়েছেন— হাফেজ, আলেম, কারী, খতীব, ওয়ায়েজ, মুফতি, মুহাদ্দিস, লেখক, ফকিহ ও গবেষক। রয়েছেন একঝাঁক তরুণ স্বাপ্নিক, যারা আগামী দিনের পথে ঈর্ষণীয় অবদান রাখবেন। যাদের উসিলায় আগামী প্রজন্ম আরও সমৃদ্ধ ও আলোকিত হবে।

জীবনের বেলাভূমিতে কাউকে খুব সহজে সন্ধ্যার কাছাকাছি হতে হয় আবার কাউকে কিছুটা বিলম্বে। একটা অবকাশ যাপনের পর সব মানুষকেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। এসবই আল্লাহর দুনিয়ার নেজাম। এর ভেতরেই চলছে আমাদের হায়াতের ঘড়ির কাটা। এর ভেতরে কয়জনই পারে জীবনকে সাজাতে, কয়জন পারে পরের তরে জ্বেলে নিজেকে শেষ করে দিতে! তিনিও ঠিক এমনই ছিলেন। নাহু-সরফের যে খেদমত করে গেছেন তার জন্য তিনি ইলমী অঙ্গনে অমর হয়ে থাকবেন।

১৯৪১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া সেই শিশুটি আজকের মাওলানা শিব্বির আহমদ রহ.। কেবল তাঁর গঠনমূলক কর্ম এবং ফিকিরের কারণে তিনি সবার কাছে আজ বর্ণাঢ্য ইতিহাস। তিনি 'বয়ানুল মাতালেব' ও 'আত-তাইসীর শরহে নাহবেমীর' লিখে দেশ-দুনিয়ায় প্রসিদ্ধ হয়েছেন। এ দুটি বই বিভিন্ন মাদরাসার পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও 'তালিমুত তারকীব ওয়াত্-তারজামা'ও লিখেন। সর্বশেষ রচনা করেন— 'আল-আরবাঈন ফি তাদরীবিল মুদাররিসীন।'

দীনি খেদমত তথা নাহু-সরফের প্রশিক্ষণের কাজে দেশ ও দেশের বাইরে দীর্ঘ সময় দিয়েছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও সফর করেছেন কয়েকবার। শরীর অসুস্থ হওয়ার পরও দীনি খেদমতে তাঁর পথচলা থেমে যায়নি। থেমে যায়নি ধারাবাহিক কার্যক্রম। তবুও রোগ ব্যাধি যখন চেপে বসে তখন বার্ধক্য এসে তারুণ্যকে গিলে ফেলে। কে পারে তখন স্নিগ্ধ তারুণ্যকে ধরে রাখতে? তিনি তাঁর বয়সের তারুণ্য না ধরে রাখতে পারলেও ইলম ও কালামের তারুণ্যকে ঠিকই ধরে রেখেছিলেন। তাঁর চলপ যাওয়া মানে আরবী ব্যাকরণের এক ঐতিহাসিক ইমামের বিদায়।

গত বুধবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যা ৬ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় বেসরকারী হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন ছেলে, এক মেয়েসহ ছাত্র, ভক্ত ও অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে যান।

টিএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ