আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: মানুষের প্রধান রেচন অঙ্গ হলো বৃক্ক বা কিডনি। কিডনি মূত্রনালীর অংশ এবং রক্তের ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। মানবদেহের উদরগহ্বরের পিছনের অংশে, মেরুদণ্ডের দুদিকে বক্ষপিঞ্জরের নিচে পিঠ-সংলগ্ন অবস্থায় দুটি কিডনির অবস্থান। প্রতিটি কিডনি দেখতে শিমবিচির মতো এবং লালচে রংয়ের। বছরের পর বছর, দিনের পর দিন কিডনি ঠিক এভাবেই ছাঁকনির কাজ করে চলে। লবণ, বিষ এবং অবাঞ্ছিত পদার্থ শরীরে ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু কিডনি অকেজো হয়ে গেলে শরীরের ক্ষতিকর বর্জ্য রক্তে জমা হয়। তখন বেঁচে থাকাই মুশকিল।
কিডনির কাজ হল শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি, বিষাক্ত পদার্থ, তরল পদার্থ বের করে দেওয়া। খাবার আর পানীয়ের মাধ্যমে অনেক রকম নোংরা পদার্থ শরীরে যায় যা আমাদের কিডনির উপর চাপ ফেলে। সেই সঙ্গে কিডনির ক্ষতি করে, কিডনিতে বেশি পরিমাণ ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এমনকী কিডনিতে পাথরও হতে পারে। ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়লেই তখন কিডনিতে পাথর তৈরি হয়।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণেও কিডনির উপর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এই অবস্থাগুলো সঠিক উপায়ে নিরাময় করতে ও সুস্থ রাখতে প্রতিদিন ডায়েট থেকে বেশ কিছু খাবার বাদ দেওয়া উচিত। প্যাকটজাত পণ্যগুলো থেকে কঠোরভাবে দূরে থাকা অবশ্য প্রয়োজন। অনেকেই অজান্তে লবণের মাত্রা বাড়িয়ে দেন, তাতে কিডনির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
কিডনিতে সমস্যা থাকলে ফল, জুস, শুকনো ফল ও ফসফরাস সমৃদ্ধ ফল এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কিডনির রোগে আক্রান্তকে লবণের পরিমাণের উপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত।
সবুজ শাক-সবজি, মিষ্টি আলু, বেরিজ, আপেল, চর্বিযুক্ত মাছ সবই কিডনিবান্ধব বলে বিবেচিত হয়। আবার বাদাম, দুগ্ধজাত পণ্য, প্যাকেটজাত পণ্য ও চিনিযুক্ত খাবার কিডনির জন্য ক্ষতিকর। তাই কিডনির রোগে যারা ভুগছেন, তারা এধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন।
উচ্চ পটাসিয়াম-জাত খাবার যেমন কিছু ফলের রস, শুকনো ফল ও বাদাম ও ফসফরাসযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। কিডনি রোগের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রোটিনের মাত্রাও সীমিত রাখা উচিত।
সাধারণত কিডনির রোগীদের খুব সাবধানে খাবার বাছাই করতে হয়। রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি পর্যায়ে থাকে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা, কম লবণ দেওয়া খাবার, চিনি ও কৃত্রিম খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন। এছাড়া কার্বোহাইড্রেট সমৃ্দ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন। সবসময় ফলের রসের মতো প্রাকৃতিক মিষ্টি বা চিনি পান করুন।
কিডনি যাতে ঠিক মতো কাজ করতে পারে সেই কারণেই কিডনি পরিষ্কার রাখতে হবে। শরীরে যদি বিষাক্ত পদার্থ জমতে থাকে তাহলে রক্ত দূষিত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে কিডনিতে পাথর, ফোলা ভাব, ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা এসবও আসতে পারে। আর কিডনি যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে ত্বকের অনেক সমস্যাও দূর হয়। এর জন্য রোজ প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতেই হবে। তেল, ঝাল, মশলা খেয়ে হাত তো ঠিকই ধুচ্ছেন, তবে কিডনি কি পরিষ্কার করছেন? না, সে কি সম্ভব নাকি! উত্তর হবে-হ্যাঁ, সম্ভব। হাতের কাছেই আছে এর সমাধান। কীভাবে পরিষ্কার করবেন? জেনে নিন, কিডনি পরিষ্কারের ঘরোয়া উপায়।
ধনেপাতা
কিডনি পরিষ্কার করতে ধনেপাতার জুড়ি নেই। পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন এক আঁটি ধনেপাতা। এরপর কুচি কুচি করে কেটে একটি পাত্রে রাখুন। পাত্রে কিছুটা পানি দিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে ছেঁকে পরিষ্কার বোতলে রেখে দেন। ফ্রিজেও রেখে দেয়া যেতে পারে ওই বোতল। এরপর প্রতিদিন একগ্লাস করে ধনেপাতার জুস খেলেই হাতেনাতে মিলবে ফল। কিডনির মধ্যে জমে থাকা লবণ এবং বিষাক্ত পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যাবে। শুধু কিডনিই নয়। এক আঁটি ধনেপাতায় আছে ১১% ফাইবার, ৪% প্রোটিন, ১% ক্যালরি, ১% কার্বোহাইড্রেট, ১% ফ্যাট। ম্যাঙ্গানিজ ২১%, পটাসিয়াম ১৫%, কপার ১১%, আয়রন ১০%, ক্যালসিয়াম ৭%। এতে রয়েছে ৩৮৮% ভিটামিন কে, ১৩৫% ভিটামিনে এ, ৪৫% ভিটামিন সি, ১৬% ফলেট।
লেবুর রস
লেবুর রসেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণ সাইট্রিক অ্যাসিড। আর তাই লেবুর রস রক্তকে ফিল্টার করে এবং সেখান থেকে দূষিত পদার্থ অপসারণ করে। লেবুর রসে ক্যালশিয়াম অক্সালেট দ্রবীভূত হয়ে যায় যা কিডনি স্টোনের অন্যতম প্রধান কারণ।
তুলসি পাতা
কিডনি পরিষ্কার রাখতে এবং রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বজায় রাখতে খুব ভাল কাজ করে তুলসি পাতা। চায়ে তুলসি পাতা ফুটিয়ে খেতে পারেন। তুলসি পাতায় থাকা অ্যাসিটিক এসিডের কারণে কিডনির পাথর আস্তে আস্তে নরম হতে থাকে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদানের কারণে এটি কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।
আপেল সিডার ভিনেগার
প্রতিদিন আপেল সিডার ভিনেগার খেতে পারেন। আপেল সিডার ভিনেগার শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই সঙ্গে রক্তচাপও কমে আর কিডনি ভাল থাকে। আপেল সিডার ভিনেগারের মধ্যে থাকে সাইট্রিক অ্যাসিড, যা পাথর গলিয়ে দিতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে সব টক্সিনও বেরিয়ে যায়।
আদা চা
আদা চায়ে রয়েছে অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা। এটিও মুক্ত মৌল অপসারণের মাধ্যমে কিডনি রোগের সঙ্গে যুক্ত প্রদাহ হ্রাস করে। আদা ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে গরম পানিতে পাঁচ মিনিট ফুটাতে হবে। একে মিষ্টি স্বাদের করতে চাইলে একটু মধু মিশিয়ে পান করুন। এই চা সকালের দুর্বলতা ও কাশি দূর করতে সাহায্য করবে। এতে কোলেস্টেরল মাত্রা কম এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দারুন কার্যকরী।
হলুদের চা
হলুদে রয়েছে চমৎকার স্বাস্থ্য সুবিধা। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি প্রদাহরোধী উপাদান। এ ছাড়া উপাদানটি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ফলে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয় তা বন্ধ করে। হলুদ উচ্চ রক্তচাপ কমায় যা কিডনি রোগের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু এটি লিভার ফাংশনও উন্নত করে তাই হলুদের চা পান করলে এটি চমৎকারভাবে কিডনি পরিষ্কার করে। পানিতে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এর সঙ্গে লেবু রস এবং গোল মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে পান করুন।
রাজমা
রাজমার মধ্যে থাকে ভিটামিন বি, থাকে ফাইবার ও খনিজ পদার্থ। যা কিডনি পরিষ্কার করতে এবং মূত্রনালীর কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। রোজ না হলেও সপ্তাহে অন্তত ২ দিন রাজমা খেতেই পারেন।
তরমুজ-বেদানা
প্রতিদিন তরমুজ আর বেদানা খেতে পারলেও খুব ভাল। তরমুজের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ জল। এছাড়াও থাকে লাইকোপেন, পটাশিয়াম। যা কিডনির কার্যকারিতা বাড়ায়। সেই সঙ্গে প্রস্রাবের অম্লতা নিয়ন্ত্রণে রাখে। বেদানার রসেও প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। এছাড়াও থাকে অ্যাস্ট্রিনজেন্ট। যা কিডনিতে পাথর হতে দেয় না।
বিট রস
কিডনি পরিষ্কার রাখতে বিট রসের জুড়ি নেই। পাশাপাশি এটি আপনার লিভার স্বাস্থ্যকে উন্নত করবে। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মুক্ত মৌলি দূর করে। বিট রস প্রস্রাবের অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি করে যা কিডনিতে পাথর গড়ে ওঠায় দায়ী ক্যালসিয়াম অপসারণ করতে সাহায্য করে। বিট রস শরীরের রক্তকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে সহায়তা করে যা কিডনিকে পরিষ্কার রাখে।
টিএ/