মুহাম্মাদ ইবরাহীম আল খলীল।।
তখন হিফযখানায় পড়ি। বৃহত্তর মোমেনশাহীর সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়ায়। আমি খুব ছোট। বুঝ-টুঝ তেমন হয়নি। শৈশবের দৌড়ান্নতা আমার সারাটায়। এই মাদরাসা দেশের শীর্ষস্থানীয় মাদরাসা সমূহের মধ্যে একটি হওয়ার কারণে এখানে অনেক বড় বড় আলেমদের আগমন ঘটতো। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের পদচারনায় মুখর থাকতো সব সময়।
যে বছর আমি ভর্তি হয়েছি তার এক দুই দিন পরেই শুনলাম আমাদের মাদরাসায় বুখারীর শরীফের ইফতেতহী দরস হবে। দরস প্রদান করবেন আল্লামা আশরাফ আলী সাহেব রহ.।
তিনি কুমিল্লার কাসেমুল উলুম মাদরাসার। তখন আমার কচি মনে এটা বসেনি, ইফতেতাহী দরস বলতে কি বুঝায়। তবে সেই নামটি আমার হৃদয়ের গেঁথে যায়। তার প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা যেন এমনিতেই চলে আসে। তাই ওই দরসের দিন একটু আগেভাগেই চলে যাই। গিয়ে বসি একটু সামনা সামনি। হুজুর তখন তালিবুল ইলমদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ নসিহত করলেন।
এখনো আমার কানে সেই কন্ঠটা বাজে। সেই দিন হুজুর বলেছিলেন, "সময়ের গুরুত্বের ব্যাপারে আমাদের আকাবিররা এতো সময়ের হেফাজত করতেন যে, তিন মিনিটে গোসল করতেন। এক মিনিটে যাওয়া। আরেক মিনিটে গোসল। আর এক মিনিটে আসা। এরকম আরো মূল্যবান অনেক নসিহত করেন।
হুজুর জামিয়ার শায়েখ এবং মুরুব্বী ছিলেন। মাদরাসার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যেতেন। ছাত্রদেরকে নসিহত করতে। উৎসাহ, উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতেন ছাত্রমনে। এরপর তো আরো অনেকবার দেখেছি। মনে আছে, সেই জামিয়া ইসলামিয়ার বার্ষিক মাহফিল ছিল। আশরাফ আলী সাহেব হুজুর সম্ভবত ওই মাহফিলের সভাপতি ছিলেন। মাহফিলের শেষ দিকে হুজুরের বয়ান ছিল। মাহফিল শেষে হুজুর দুআ শুরু করলেন। মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসতে লাগলো।
মাঠ লোকে লোকারণ্য। হুজুরের ভয়, আশা আর বিনয় মেশানো দুয়ার দৃশ্য যে কী তা বলে বুঝাতে পারবো না। দুআর মাঝখানে "আল্লাহ!" শব্দ হুজুর জোরে বলে উঠলেন। মুহূর্তেই চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসলো। অশ্রু প্রবাহিত করল আমার চোখ। সবাই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। অনবরত চোখের পানি ঝরছে। এখনো কানে বাজে আল্লাহ শব্দের সেই ধ্বনি। আহ! কি ভয় এবং আশানীয়া সুরে তিনি দুআ করতেন!
হিফয শেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমালাম।
ভর্তি হলাম চৌধুরীপাড়া মাদরাসায়। তখন তো হুজুরকে আরো ভালোভাবে চিনলাম। দেখলাম। তার সোহবত থেকে একটু নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তাকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছি চৌধুরীপাড়া মাদরাসায়। ২০১২ সাল। নাহবেমীর জামাতে পড়ি। খবর পেলাম এ বছর বেফাকের কাউন্সিল হবে আমাদের মাদরাসায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় সব ওলামায়ে কেরাম আসবেন। সাথে এটাও শুনলাম যে, আল্লামা আশরাফ আলী সাহেব হুজুরও আসবেন। বিশ্রামের জন্য অবস্থান করবেন উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা আমজাদ হোসাইন সাহেব হুজুরের কামরায়। ওই সময় হুজুরকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি।
২৯-১২-২০১৯ যখন ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজের আগ মুহূর্তে কুরআন তেলাওয়াত করছিলাম, তখন হঠাৎ সংবাদ পেলাম আমার এই প্রিয় মানুষটি এই জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সংবাদটা শোনার পর আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশের সবকিছু। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার মুখ দিয়ে কোন সারা শব্দের বের হচ্ছিল না। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলালা। শোকের ছায়া আমার চারপাশটা আচ্ছন্ন করে ফেলে। তিনি এভাবে চলে যাবেন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল।
ফজরের নামাজের আগে ছুটে গেলাম, প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো একবার দেখার জন্য। তার লাশ মালিবাগ মাদরাসার মাঠে রাখা। শোকের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সবাই দেখে দেখে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার তো আসতে মন চাচ্ছে না। মন চায় থেকে যায় তার সাথে। দেশের বাড়ি কুমিল্লায় যেখানে জানাজা হবে ছুটে যায় সেখানে। মনকে আমি বুঝাতে পারছিলাম না। কিন্তু পরদিন মাদরাসার পরীক্ষা থাকার কারণে ফিরে আসতে হল।
মুহূর্তেই মালিবাগ মাদরাসা আলেমদের পদচারণায় ভারি হয়ে গেল। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা একে একে আসতে লাগলো। একটু পরেই আসলেন উস্তাযে মুহতারাম আল্লাহ মানুর হোসাইন কাসেমী রহ.। হুজুরকে দেখার পর তিনি মালিবাগ মাদরাসার দফতরে গিয়ে বসলেন এবং শোকসন্তপ্ত আলেম উলামায়ে কেরামকে ধৈর্যধারণ করার কথা বলছিলেন। আমিও গিয়ে বসলাম হুজুরের সামনে।
হুজুর আল্লামা আশরাফ আলী রহ.এর স্মৃতিচারণ মূলক আলোচনা করছিলেন। তার সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের ঘটনা বলছিলেন। হুজুর বললেন, এখন আমাদের উপর দায়িত্ব হলো তার জন্য ইসালে সওয়াবের দুআ করা। এবং তার রেখে যাওয়া আদর্শকে আঁকড়ে ধরা। অনুসরণ করা। তার সাথে আমি কাজ করেছি। সব সময় তাকে মান্য করতাম। বেফাকের বিভিন্ন মিটিংয়ে যখন তার কোন মত আমার মিলমত না হতো তখন আমি চুপ থাকতাম। কোন কথা বলতাম না। তার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতাম।
তিনি বেফাকের শুরু লগ্ন থেকেই কাজ করেন। তার সাথে জড়িত ছিলেন। বেফাকের সর্বপ্রথম যে মিটিং হয় সেখানেও উপস্থিত ছিলেন। তার মাঝে তিনটা গুণ ছিল, এক. কাসরাতে ইবাদাত বেশি বেশি ইবাদত করতেন। দুই. কাসরাতে মুতালাআ(বেশি বেশি মুতালাআ করতেন।) তিন. সময়ের হেফাজত করতেন। কোন কাজ না থাকলে কিতাব মুতালাআয় বসে যেতেন। উভয় জনই আজ পর জগতের বাসিন্দা। আমরা দুআ করি আল্লাহ তাআলা উভয়ইকে শান্তির নিবাসে ভালো রাখুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক. মাদরাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজকুনিপাড়া, তেজগাঁও ঢাকা
-এটি