মূল: সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.
ভাষান্তর: সাঈদ হোসাঈন
ড. ইউসুফ কারজাভী। মুসলিমবিশ্বের শীর্ষসারির আলেম। উম্মতের রাহবার ও মুরুব্বী। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও বিশ্বময় দওয়াতি তৎপরতার ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান আরববিদ্ধান মহলে অতি সুপরিচিত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। সাড়া জাগানো বিপ্লবী চেতনাসমৃদ্ধ ও ইলমী গবেষণামূলক গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি ইসলামী লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য লিখিত তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘ফিকহুয যাকাত’ থেকে শুরু করে একেবারে শেষ গ্রন্থটি পর্যন্ত এর জ্বলন্ত প্রমাণ। শিক্ষা-দীক্ষা, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি এবং দাওয়াতি ক্ষেত্রে তাঁর কর্মতৎপরতা ক্লান্তিহীন-শ্রান্তিহীন। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে তিনি চিরউৎসর্গিত।
উম্মাহর যুবসম্প্রদায়ের মাঝে চিন্তা-চেতনা ও দ্বীনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বোধ ও সূক্ষ্ম অনুভূতি সৃষ্টি এবং সমাজ সংস্কারে তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা প্রশংসনীয়। ইসলামী কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। দ্বীনের সহিহ বুঝ ও মুসলিমবিশ্বের সমকালীন পরিস্থিতির সূক্ষ্ম উপলব্ধির মাঝে তিনি সম্মিলন ঘটানোর প্রয়াস পান।
ড. কারজাভী জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল আযহার’ এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিসন্তান। আরববিশ্বে এটি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। যুগে যুগে উম্মতের শ্রেষ্ঠ আলেম, দাঈ, বুজুর্গ ও মনীষীগণ এখানে জ্ঞান-গবেষণায় রত ছিলেন। আরব দুনিয়ায় দ্বীন-ইসলামের হেফাজত ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অসামান্য।
শায়খ কারজাভী ইসলামী জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পর শিক্ষা-দীক্ষা ও দাওয়াতি ক্ষেত্রে শায়খ হাসান আল বান্নার চিন্তাধারা গ্রহণ করেন। দাওয়াত ও তারবিয়াত সম্পর্কে শায়খ বান্নার ছিল সজাগ দৃষ্টি, আর সংস্কার সম্পর্কে ছিল আলোকিত চিন্তা-দর্শন। তাঁর সঙ্গে দুটি দলের সম্পৃক্ততা ছিল খুব বেশি।
এক দল হল অভিজ্ঞ মুসলিম স্কলার, আরেক দল হল আধুনিক শিক্ষিতসমাজ। শায়খ বান্নার নীতি ছিল এককথায়- উপকারী যে কোন প্রাচীন বিষয় থেকে উপকৃত হওয়া এবং ভালো ও উপযোগী হলে যে কোন নতুন বিষয়কে স্বাগত জানানো। শায়খ কারজাভী এক্ষেত্রে তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন। দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মাঝে তিনি যথাসাধ্য ইসলামকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে পরিতৃপ্ত করেছেন।
শায়খ কারজাভী যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শায়খ বান্নার এ চিন্তা-দর্শনকে ধারণ করে কাজ শুরু করেন। সেসময় পাশাচাত্য সভ্যতা মধ্যপ্রাচ্যে তীব্রভাবে আঘাত হানে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সভ্যতার রঙ-ঢঙে রঞ্জিত হয়। আর দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণ শক্তি ও হিম্মত হারিয়ে ফেলে। এভাবে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়।
একটি পাশ্চাত্যের পূর্ণ আনুসারী, আরেকটি স্বকীয় সত্তা হারিয়ে বিকৃতির শিকার। এক দল আরেক দলকে কী বোঝাতে চাই, কী পেশ করতে চাই- কিছুই বুঝে না কেউ। আধুনিক শিক্ষিতসমাজ আলেমদের বিরুদ্ধে চিন্তানৈতিক পিছিয়ে পড়া ও যুগের সমস্যাবলী না বোঝার অভিযোগ তুলে।
অপর দিকে আলেমসমাজ তাদের বিরুদ্ধে রুচি ও চিন্তার বিকৃতি এবং দ্বীনি চেতনা হ্রাস পাওয়ায়র পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করে। এ কঠিন পরস্থিতিতে নির্ভরযোগ্য আলেমদের উচিৎ ছিল তারবিয়াত ও দাওয়াতি তৎপরতা বৃদ্ধি করে উভয় দলকে সন্তুষ্ট করা। হিন্দুস্থানে ‘নদওয়াতুল ওলামা’ এ চিন্থাধারা ধারণ করেই স্বজাতির মাঝে কাজ করে অগ্রগতি লাভ করেছে। আর আরববিশ্বে এই চিন্তা-দর্শনের বিপ্লব ঘটিয়ে আলেমসমাজ ও আধুনিক শিক্ষিতসমাজকে পরিতুষ্ট করেছেন শায়খ হাসান আল বান্না।
আর শায়খ ইউসুফ কারজাভী হলেন এই শায়খ বান্নার-ই শীর্ষসারির অনুসারী, মুগ্ধ গুণগ্রাহী। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শায়খ বান্নার অনুসারীরা মিশরের সাবেক স্বৈরশাসক জামাল আবুদুন নাসেরের রোষানলে পড়ে। ‘নাসেরী-তাণ্ডবে’ বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের সকল দাওয়াতি তৎপরতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম। ওলামা-মাশায়েখ ও দাঈদের দ্বীন-ধর্ম নিয়ে বেঁচে থাকাও তখন সীমাহীন কষ্টকর হয়ে পড়ে।
এ কঠিন পরিস্থিতিতেও শাইখ কারজাভী ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে তাঁদের দাওয়াতি তৎপরতা চালিয়ে যান। এতে তাঁরা ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। দ্বীন ও উম্মাহর প্রতি তাঁদের দায়-দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করেন।
এর মাধ্যমে তাঁরা এমন এক অসাধারণ জাগরণ সৃষ্টি করেন, যাতে ধর্মানুরাগী যুবসমাজের উপর প্রবল প্রভাব পড়ে। কন্টকময় পরিবেশে তাঁদের এ কর্ম-পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে দ্বীনি আমলেরও হেফাজত হয়।
এসময় শাইখ কারজাভী ইসলামীবিশ্বের একজন প্রতীকব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর সুদৃঢ় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁর দক্ষতা এবং সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন দাওয়াতি ও জাগরণমূলক কাজে তাঁর তৎপরতা তাঁকে পূর্ণ প্রস্তুত করেছে। এছাড়াও তিনি একজন সৎ ও মুত্তাকি আলেম। তাঁর সমস্ত দ্বীনি কাজের জন্যে তিনি শুধু আল্লাহর কাছেই ছওয়াব-প্রত্যাশী।
এগুলো সেযুগের কথা যখন সমকালীন মানুষের জীবন-বৈচিত্র ও চাকচিক্য অবলোকন করে লোভী দাঈদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যেত। যশলিপ্সা ও অর্থলিপ্সায় তাদের অন্তর মরে যেত। এ ঐন্দ্রজালিক পৃথিবীর চাকচিক্য ও রূপ-রস-গন্ধ অবজ্ঞাভরে পাশ কাটিয়ে চলেন শাইখ কারজাভী। ইসলামী দাওয়াত, তারবিয়াত ও বিপ্লবের ক্ষেত্রে তিনি এক শক্তিশালী প্লাটফর্মে পরিণত হন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা তাঁর চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমে আলোকিত হয়। তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি এখন ইসলামের এক বড় সম্পদ।
মিশরে আমি যখন শাইখ কারজাভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি তখন তিনি মাত্র যুবক, আলআযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া অনুষদের ছাত্র। আমার এই সফরটা ছিল ইমাম হাসান আল বান্নার শহীদি-মৃত্যুর পর। তখন তাঁর অনুসারী ও ভক্ত-অনুরক্তরা তাঁকে হারিয়ে প্রচণ্ড শোকাহত ছিল। এসময় একদল প্রাণোচ্ছল ইখওয়ানী যুবক আমার কাছে এলেন।
তাঁরা আমার চিন্তাধারা, দ্বীনি কর্মতৎপরতা, ইসলামী জাগরণ ও সমাজ সংস্কারে আমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন। আমার সদ্যপ্রকাশিত আরবী গ্রন্থ ‘মাজা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমিন’ তাঁদের কাছে বেশ সমাদৃতি পেয়েছে। কিতাবটিকে বড়ো আগ্রহভরে গ্রহণ করেছেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা হয়। সেসব প্রোজ্জ্বল নওজোয়ানদেরই একজন ছিলেন শাইখ ইউসুফ কারজাভী।
তাঁর সঙ্গে আমার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল সবসময় অটুট-অবিচ্ছিন্ন। প্রায় দশ বছর পর আমি কাতার সফরে গিয়েছিলাম। তখন তিনি এবং তাঁর দুই বন্ধু মিশর থেকে নির্বাসিত হয়ে কাতারে বসবাস করছেন। এখানে তিনি ইসলামী শিক্ষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এদেশে যুবক-বৃদ্ধদের সম্মিলনে একটি চমৎকার দ্বীনি পরিবেশ পান তিনি।
এসব যুবক-বৃদ্ধ তাঁর সান্নিধ্য পরশে থেকে উপকৃত হয়। এই সফরে তাঁদের সঙ্গে আমার বড়ো আনন্দময় সাক্ষাৎ ঘটে। আমরা অতীতের বিভিন্ন বিষয়ে স্মৃতিচারণ করলাম। শাইখ কারজাভী ও তাঁর সাথীবর্গকে দেখলাম খুবই কর্মতৎপর। তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মপদ্ধতিতে খুবই সজাগ। তাঁদের এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হচ্ছে এবং সমাজে এর ভালো প্রভাব পড়ছে। এগুলো দেখে আমি সীমাহীন মুগ্ধ হয়েছি। শাইখ কারজাভী তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং দাওয়াত ও তারবিয়াতের ক্ষেত্রে তাঁর সজাগ দৃষ্টিতে এগিয়ে চলছেন সম্মুখ পানে। এর ফলে কাতারের মহামান্য আমিরের কাছ থেকে তিনি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন।
তিনি পাঠদান, লেখালেখি, গ্রন্থ-প্রণয়ন ও মাহফিলে বয়ানের মাধ্যমে তাঁর কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দাওয়াত, তারবিয়াত ও জাগরণমূলক তৎপরতার মাধ্যমে ধ্বংসোন্মুখ নতুন প্রজন্ম এখন তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মতোই ইসলামী পরিবেশেই বেড়ে উঠছে। আমার কিছু টুটাফুটা কর্ম ও প্রচেষ্টার কারণে তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন এবং সবসময় শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। আমার সঙ্গে তাঁর আচরণ ছোট-বড়’র মতো। এটা হয়ত বয়সে আমি তাঁর চে’ তের বছর বড় হওয়ার কারণে।
আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তাঁকে, আমাকে এবং দ্বীনের সমস্ত খদেমকে কবুল করেন। সব দয়া ও অনুগ্রহ তাঁরই। শুরু এবং শেষে সমস্ত প্রশংসা ও শুকরিয়া তারই জন্য নিবেদিত।
[বি. দ্র. সত্যের অনুরোধে এখানে একটা কথা অবশ্য বলে রাখতে হয়, ড. কারজাভীর চিন্তার কিছু কিছু অংশ আহলে ইলমের নিকট সংশোধনযোগ্য। কিছু ফিকহী মাসআলায় জুমহূর উলামায়ে কেরামের খেলাফ তাঁর একক মত রয়েছে, যা অনুসরণযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় না।]
-এটি