আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: হিজরি প্রথম সনে মহানবী (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের সহযোগিতায় মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন। ওই মসজিদের সঙ্গে পৃথক দুটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে একটিকে মহানবী (সা.) আবাসগৃহ হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর অন্যটি শিক্ষানিকেতন হিসেবে ব্যবহার করতেন।
ইতিহাসে এই শিক্ষানিকেতনকে ‘মাদরাসা-ই-সুফফা’ বলা হয়ে থাকে। এ মাদরাসা ছিল আবাসিক। এর মধ্যে স্থানীয় গরিব, দুস্থ, এতিম ও সহায়-সম্বলহীন মুহাজির ও তাঁদের সন্তানদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ‘আসহাবে সুফফা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। ‘সুফফা’র এ মাদরাসাটিই মদিনার প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে পবিত্র কোরআন ছিল প্রধান পাঠ্যপুস্তক। কোরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস ও তাজবিদ (কোরআন পাঠের নিয়ম-নীতি) ইত্যাদির পাশাপাশি ইসলামধর্মীয় বিধি-বিধান এখানে শিক্ষা দেওয়া হতো। এটাই ছিল তখন ইসলামী শিক্ষার প্রধান ও প্রথম কেন্দ্র। ইতিহাসবিদরা এটাকে ‘জনশিক্ষাকেন্দ্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। এ শিক্ষাকেন্দ্রের আবাসিক ছাত্রদের ব্যয়ভার নগরীর বিত্তবানরা বহন করতেন। আবার অনেকে নিজেই নিজের ব্যয়ভার বহন করতেন। [মজিদ আলী খান, শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা), বাংলা অনূদিত (ইফাবা, ২০০৫), পৃষ্ঠা ১২৪]
তবে ‘মাদরাসা-ই-সুফফা’র আগে মদিনায় তিনটি উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ওই তিন প্রতিষ্ঠান হলো—
(১) মসজিদে বনি জুরায়েখ। এটি হিজরতের আগে মদিনায় প্রথম মাদরাসা। মদিনার প্রাণকেন্দ্র ‘কালব’ নামক স্থানে এই ‘মসজিদ-কাম-মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাফে বিন মালেক আনসারি (রা.) এ মসজিদের ইমাম ও মুয়াল্লিম (শিক্ষক) ছিলেন। [মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত (ঝিনুক পুস্তিকা, ঢাকা, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ৪৫১]
(২) মসজিদে কুবা। মদিনা থেকে ছয় মাইল উত্তরে কুবা নামক স্থানে এ মসজিদ অবস্থিত। হিজরতের সময় মহানবী (সা.) মদিনায় এসে সর্বপ্রথম এ স্থানে ১৪ দিন অবস্থান করেন। এখানে তিনি একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে এক শুক্রবার তিনি জুমার নামাজে ইমামতি করেন। নওমুসলিমসহ অগ্রবর্তী মুহাজিররা সর্বপ্রথম এখানে অবস্থান করেন। এখানেও ইসলামী উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু হয়। সালেম (রা.) ও আবু হোজায়ফা (রা.) নামের দুজন সাহাবি এই মসজিদকেন্দ্রিক শিক্ষানিকেতনে শিক্ষকতা করতেন। [ড. আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজজীবনে তার প্রভাব (ঢাকা : ইফাবা, ২০০৪), পৃষ্ঠা ৪৬]
(৩) নাকিউল খাজামাত। মদিনা থেকে ৯ মাইল দক্ষিণে ‘নাকিউল খাজামাত’ নামক স্থানে আসাদ বিন ইউয়ারা (রা.)-এর বাড়িতে একটি উপ-আনুষ্ঠানিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মদিনার বিখ্যাত আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে যারা আকাবার শপথের পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাঁরা এখানে নামাজ আদায় করতেন ও ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতেন। মুসআব বিন উমাইর (রা.) এ মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে ‘মুয়াল্লিমুন মাশহুর’ (বিখ্যাত শিক্ষক) উপাধিতে ভূষিত করেন। (বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজজীবনে তার প্রভাব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮)
এ ছাড়া আরো দু-একটি প্রথম দিকের শিক্ষাকেন্দ্রের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন—গামিম মাদরাসা। মক্কা থেকে মদিনার পথে গামিম নামক স্থানে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রের কথা স্মরণীয়। বরিদ বিন হাসিব (রা.)সহ একদল লোক এসে এখানে মহানবী (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবী (সা.) তাঁদের নিয়ে এশার নামাজ আদায় করেন এবং সুরা মারিয়ামের প্রাথমিক আয়াতগুলো তাঁদের শিক্ষা দেন। (বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজজীবনে তার প্রভাব, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪)
দ্বিতীয় হিজরিতে (৬২৩ খ্রিস্টাব্দে) মাকরামাহ ইবনে নাওফেল (রা.) নামক জনৈক আনসারের গৃহে ‘দারুল কাররাহ’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল আবাসিক ধরনের। ওই সাহাবি নিজ গৃহে থেকে জ্ঞানার্জন করতেন।
আল্লাহর রাসুল (সা.) মসজিদে নববীতে অবস্থান করে সাহাবিদের নামাজ কোরআন ও হাদিস শরিফ শিক্ষা দিতেন। কোরআন কারিমের আয়াত মুখস্থ করার জন্য তিনি তিনবার আবৃত্তি করতেন। কোরআন শিক্ষা করা ছাড়াও সাহাবিরা ধর্মীয় বিধান, কারুময় হস্তলিপি, বংশ ইতিহাস, ঘোড়দৌড় ও তীর নিক্ষেপ শিক্ষা করতেন। এভাবে একযোগে ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার প্রচলন ঘটিয়েছেন মহানবী (সা.)। মক্কা, মদিনা, সিরিয়া ও বিভিন্ন অঞ্চলের সাহাবি কোরআন-হাদিসের জ্ঞান আহরণের জন্য তাঁর কাছে আসতেন। রাসুলে করিম (সা.)-এর জীবদ্দশায় ৯টি মসজিদ মদিনায় ছিল। এসব মসজিদে মুসলিম শিশুরা শিক্ষা গ্রহণের জন্য সমবেত হতো। আধুনিক যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতির মতো তখন ভর্তি পরীক্ষা ও বেতনের দ্বারা শিক্ষার দ্বার সংকুচিত ছিল না। মসজিদ ছিল তখন একটি উন্মুক্ত বিদ্যালয়, যা থেকে বর্তমানে Open University- এর ধারণা লাভ করা হয়েছে। শিক্ষাদানের বহু প্রজ্ঞাময় ও জ্ঞানী সাহাবি তখন ছিলেন শিক্ষকতায় নিবেদিত। ছাত্ররা তাঁদের ঘিরে রাখত মৌচাকের মৌমাছির মতো।
ঐতিহাসিক খোদা বকশ ‘Islamic Civilization’ গ্রন্থে ওই আমলের মসজিদের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার সম্পর্কে লিখেছেন, “For the Muslims the mosque does not bear the same exclusive character as does a church for the Christians. It is not merely a place of worship. The Muslim indeed honours the mosque but he does not hesitate to use it for any laudable purpose”.
রাসুল (সা.)-এর বিদ্যাপীঠ হিসেবে মসজিদের এই ব্যবহারই পরে শিক্ষার গণমুখী প্রসার ও সম্প্রসারণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। ঐতিহাসিক ইয়াকুবির মতে, বাগদাদে ৩০ হাজার মসজিদ শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহৃত হতো। বড় মসজিদগুলোতে পাঠ্যতালিকা ভাগ করা ছিল। শিক্ষকরা সে পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী বিশেষ পাঠ্যসূচির ওপর বক্তৃতা দিতেন। পরিব্রাজক নাসির খসরুর মতে, (একাদশ শতাব্দীতে) মিসরের রাজধানী কায়রোর মসজিদে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার লোক ‘দ্বিনি ইলম’ (ধর্মীয় জ্ঞান) আহরণের জন্য সমবেত হতো। সাম্প্রতিককালের মিসরের জামে আজহার, দিল্লির জামেয়া মিল্লিয়া ও দেওবন্দ মাদরাসা মসজিদভিত্তিক শিক্ষারই উত্তর ফসল।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলমানরা যখনই কোনো দেশ জয় করেছেন, তখনই তারা সে দেশে তাদের বাসস্থানসংলগ্ন স্থানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এ ঐতিহ্য থেকেই শতাব্দীর পাদমূলে এসে ভাগ্যাহত ও বিভ্রান্ত মুসলিম মিল্লাত মসজিদকে কেন্দ্র করে পুনরায় ইসলামী শিক্ষা উজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেতনা লাভ করছে। দাওয়াত ও তাবলিগের কার্যক্রম সম্ভবত সে স্মৃতি ও পদ্ধতি বহন ও ধারণ করছে।
সূত্র: ইকনা