॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
ডিজিটাল টেকনোলজির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শিক্ষার্থীদের পড়ার ইচ্ছা কমিয়ে দিচ্ছে। ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বিষয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিঃসঙ্গতা-একাকিত্বের অনুভূতিও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড লার্নিং জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফিল রিড বলেন, যেসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের অতিরিক্ত নেশা আছে, তারা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন। ইন্টারনেট আসক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সও খুবই দুর্বল। একাডেমিক ফলাফল বিবেচনায় দেখা যায়, ইন্টারনেট আসক্তরা শিক্ষাগত যোগ্যতার মানে পিছিয়ে থাকছেন।
গবেষণায় ২৮৫ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কোর্সের শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, অধ্যয়নের দক্ষতা, পড়াশোনার আগ্রহ, উদ্বেগ ও একাকিত্বসহ আরো কিছু বিষয় মূল্যায়ন করা হয়েছিল। পরিশেষে দেখা যায়, অতিরিক্ত ইন্টারনেটের আসক্তি পড়ুয়াদের পড়াশোনাবিমুখ করে তুলছে।
পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও দক্ষতা দুটোই কমিয়ে দিচ্ছে। গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, ইন্টারনেট আসক্তরা তাদের পড়াশোনার কাজ গুছিয়ে করে উঠতে পারছেন না। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি কাজ করার কথা না থাকলেও ইন্টারনেট আসক্তির কারণে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষাকে বেশ ভয় পাচ্ছেন এবং বিষয়টি নিয়ে তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন থাকছেন। যে কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাকিত্ব বাড়ছে, যা পড়াশোনাকে আরো কঠিন করে তুলছে।
গবেষণাটিতে অংশ নেওয়া ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ৪ ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। বাকিরা ১ থেকে ৩ ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ জানায়, তারা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া সাইট ব্যবহার করতেন। এছাড়া ৩০ শতাংশ জানায়, তারা বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তিকে দায়ী করেছেন গবেষকরা। তাদের দাবি, ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অনীহার প্রধান কারণ। এর ফলে বাড়ছে একাকিত্ব, যা হতাশাগ্রস্ত করছে শিক্ষার্থীদের। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক শিক্ষার ওপর। গবেষকরা বলছেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ইন্টারনেট আসক্তির কারণে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ গুণাবলি না থাকা খুব একটা ভালো ফল বয়ে আনবে না।
সম্প্রতি কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দিনে যারা অতিরিক্ত সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে।
গবেষকরা কলেজ শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে মানসিক সমস্যার সম্পর্ক বুঝতে দুটো স্কেল ব্যবহার করেন। প্রথমটি ইন্টারনেট অ্যাডিকশন টেস্ট (আইএটি)। ১৯৯৮ সাল থেকে এ স্কেলের ব্যবহার চলে আসছে। দ্বিতীয়টি নতুন স্কেল, যা ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরন বুঝতে তৈরি করা হয়েছিল।
ঐ গবেষণার প্রধান গবেষক মাইকেল ভ্যান আমেরিনজেন বলেন, গত দুই দশকে ইন্টারনেটে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অনলাইনে কাজ করছেন, মিডিয়া স্ট্রিমিং করছেন এবং সোস্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাচ্ছেন। তবে ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌলিক কিছু জিনিসে পরিবর্তন এনে একটু সচেতন হলেই শিশুদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার নিযন্ত্রণে করা বা তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজরদারি করা যায়।
শিশুদের যদি কোন ডিভাইস দেওয়া হয় তাহলে সেটিতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করাটাই নিরাপদ বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
এর মাধ্যমে শিশু কী দেখছে তার উপর নজরদারি করা সম্ভব। শিশুদের ই-মেইল অ্যাকাউন্টটি খোলার সময় তার জন্ম তারিখটি সংযুক্ত করার পর সেটি যদি ১৩ বছরের নিচে হয় তাহলে, গুগল আপনা-আপনিই বলবে যে, ওই অ্যাকাউন্টটি প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের অধীনে হবে। আপনি করতে চান কিনা।
সেক্ষেত্রে জানতে চাওযা হবে যে, ওই অ্যাকাউন্টটি অন্য কার অ্যাকাউন্টটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। অর্থাৎ সেখানে যেকোন একজন অভিভাবকের ই-মেইল অ্যাকাউন্ট চাইবে। এখানে বাবা কিংবা মায়ের একটা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট দেওয়ার সুযোগ থাকে। এরপর থেকে এই জি-মেইল অ্যাকাউন্ট পুরো ডিভাইসের অ্যাকাউন্ট লগ-ইন করা হবে তখন সে এটি দিয়ে কী কী খুঁজলো, কী কী অ্যাপ ইন্সটল করলো, ইউটিউব-ফেসবুকে কী দেখলো- সব কিছু তখন অভিভাবকের ই-মেইল অ্যাড্রেস থেকে দেখা যাবে।
এমনকি ওই ডিভাইসটি নিয়মে শিশু কোথায় গেলো সেই স্থানটিও শনাক্ত করা সম্ভব হবে।প্যারেন্টাল সেফ ব্রাউজারে একটি অ্যাপ আছে। এটা যদি শিশুর ডিভাইসে ইন্সটল করা হলে কোন ধরনের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট দেখতে পারবে না শিশু। সিকিউরিটি বিষয়কে আরো অ্যাপস আছে যেগুলো ইন্সটল করে রাখলে অন্যান্য অ্যাপসেও যাতে অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট না আসে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অনেক সময় দেখা যায় যে, বাবা বা মায়ের ডিভাইসই শিশু ব্যবহার করে থাকে। সেক্ষেত্রে সেফ ব্রাউজার-প্যারেন্টাল কন্ট্রোল নামে একটা অ্যাপস আছে। সেটি মোবাইল, ল্যাপটপ বা পিসিতে ইন্সটল করে যখন বাচ্চারা ব্যবহার করবে তখন সেটি চালু করে রাখা সম্ভব। এই অ্যাপটি এনাবল-ডিসাবল করার অপশন আছে। এটি প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায়। পিসি বা ল্যাপটপের ব্রাউজারে আলাদা ছোট প্লাগ-ইনস এর মতো ‘ব্রাউজার এক্সটেনশন’ ইন্সটল করে রাখলে সেটিও অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট আসা বন্ধ করে দেয়। এমনকি সার্চ করলেও আসবে না। এসব ব্রাউজার এক্সটেনশন ফ্রিতে পাওয়া যায়।
ফেসবুক এবং মেসেঞ্জারের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের চাইল্ড ভার্সন আছে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দেওয়া যায়, যেটি তারা ব্যবহার করলেও অভিভাবকদের সুপারভাইজ করার সুযোগ থাকে।
ফেসবুকে বাচ্চাদের ব্যবহারের জন্য একটা অপশন আছে। মেসেঞ্জারেও অপশন আছে। সেখানে কেউ আপনার বাচ্চাকে অনুরোধ বা রিকোয়েস্ট পাঠালে আপনার কাছেও সেটি আসবে। আপনি অনুমতি দিলে তারা চ্যাট করতে পারবে।
যে কোম্পানির কাছ থেকে ইন্টারনেট সংযোগটি নেওয়া হচ্ছে তাদের বাচ্চাদের জন্য ‘সেফ ইন্টারনেট’ ফিচারটি আছে কিনা সেটি যাচাই করে নেওয়া ভাল। এই ফিচারটি থাকলে কিছু সাইট বা কন্টেন্ট ব্লক করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়া যায়।
ওয়াইফাই সংযোগের জন্য আমরা যে অ্যাকসেস পয়েন্ট বা ডিভাইস যেমন রাউটার ব্যবহার করি সেগুলোর বেশিরভাগ গুলোতেই কিছু সুবিধা থাকে। যার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এগুলোর ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড নিতে হবে যাতে এর উপর কন্ট্রোল থাকে। এর মাধ্যমে ল্যাপটপ থেকে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের ফিচারগুলো এনাবল বা চালু করে দিতে হবে।
শিশুরা কতক্ষণ অনলাইন বা ইন্টারনেটে থাকবে তার একটা নির্দিষ্ট সময় বেধে দেওযা উচিত। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নিযন্ত্রণ আনতে হলে ইন্টারনেট সংযোগ বাসায় কখন কখন থাকবে আর কখন থাকবে না সেটির একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে নিন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা যারা ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকেন তাদের পোর্টালে ঢুকে একটা আবেদনের মাধ্যমে সংযোগের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে নেয়া যায়।
আবার এটি ব্যক্তি পর্যায়েও করা যায়। ভাল মানের যেসব ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার আছে তাদের কাছে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের একটা ফিচার আছে। যেখানে নির্ধারণ করা যায় যে, কোন কোন ডিভাইসে কখন ইন্টারনেট থাকবে, কোন কোন কন্টেন্ট থাকবে, কোন কোন অ্যাপস থাকবে কোনটা থাকবে না।
এছাড়া ইউটিউব, ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও প্যারেন্টাল কন্ট্রোল এবং বয়স নির্ধারণের ব্যবস্থা আছে। এটি চালু থাকলে কোনভাবেই কিছু কন্টেন্ট শিশুদের কাছে আসবে না।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় আপনিও শিশুর সাথে বসুন। শিক্ষামূলক বিভিন্ন চ্যানেল এবং ওযেবসাইট রয়েছে। তাদেরকে সেগুলো দেখতে উৎসাহিত করুন। নতুন কিছু শিখতে বা তৈরি করতে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলুন।
ইউটিউব কিংবা অন্য সাইটগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী যে বিষয়গুলো দেখে সেই একই ধরনের বিষয় বা কন্টেন্টগুলোই পরামর্শ বা সাজেশান্স হিসেবে আসতে থাকে।
আর এজন্যই শিশুদের আগ্রহ অনুযায়ী ভাল ও শিক্ষামূলক কন্টেন্ট দেখতে উৎসাহিত করলে তাদের কাছে সেসব কন্টেন্টই আসবে।
বাংলাদেশে সাধারণত কোন একটি বাড়িতে একটি ওযাইফাই সংযোগ নেওয়া হয় এবং বাড়ির প্রতিটি সদস্য সেই একই ওয়াইফাই শেয়ার করে ব্যবহার করে। ওই বাড়ির প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্যরা যদি ওই ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে উল্টা-পাল্টা কিছু সার্চ করে বা দেখে, তাহলে সেগুলো ওই আইপি অ্যাড্রেসেই জমা হয়।
ওই ইন্টারনেট ব্যবহার করে যদি বাড়ির শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরাও কিছু ব্রাউজ করে তাহলে ওই জিনিস বা কন্টেন্টগুলো তাদেরও সামনে চলে আসে। তাই শিশুদের এ ধরনের কন্টেন্ট থেকে দূরে রাখতে ইন্টারনেট ব্যবহারে অভিভাবকদেরও সতর্ক হতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে শিশুদের ডিভাইসে যদি প্যারেন্টাল কন্ট্রোল জি-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটি অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট শিশুদের থেকে ফিল্টার করে দূরে রাখে।
লেখক: মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১
-এটি