শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ফেসবুক ব্যবহার : প্রজন্মের অবক্ষয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

ভার্চুয়াল অগ্রগতির বদৌলতে এখন প্রায় সবার প্রাত্যহিক যাপিত জীবনেই ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, টুইটার, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে বেশ ওতপ্রোতভাবেই, মানুষ নিজেদের জড়িয়েছেন। বলা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে আজকাল প্রায় সব বয়সীরই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে নবপ্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ওপর দিন দিন বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে তারা সবকিছুই ভার্চুয়াল দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে। এতে ভালো-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। তবে এ দেশের বেশির ভাগ নেটিজেনরা এখনো অপরিপক্ব। গুজবে বিশ্বাসী।

হুট করেই আবেগপ্রবণ। আবার ঠিক কোনো কিছু বুঝার আগেই চরম উগ্র। যে উগ্রতা কখনো কখনো সামাজ, সংসার তথা রাষ্ট্রের জন্যও চরম হুমকি হয়ে দেখা দেয়। এমনকি তার পারিবারিক শিক্ষার প্রতিও প্রশ্নবোধক হয়ে পড়ে। ভার্চুয়াল অগ্রগতির সহজলভ্যতায় যেনতেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে ইদানীং মানুষ সাধারণ বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা করার মতো মানসিকতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলছে। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। কমছে একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য, সৌজন্যতা। ফেসবুকের কল্যাণে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষগুলো অল্পতেই হয়ে ওঠেন পরম আপন।

আর নিত্যদিন দেখা সাক্ষাৎ হওয়া চিরচেনা মানুষ, শুধু মাত্র লাইক-কমেন্টের বদৌলতে কখনো কখনো হয়ে যান চরম শত্রু। তবে ফেসবুক ব্যবহারে পাশে থাকা মানুষগুলোর ভেতরের রূপটা খুব ভালোভাবে বোঝা যায়। যে কারণে ফেসবুকের অপর নাম বলা যেতে পারে মনের আয়না।

একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী মনের অজান্তেই, সঙ্গীদের প্রতি তার ভেতরের মমতা, বন্ধুত্ব, ইতিবাচক বা নেতিবাচক বিষয়গুলো টাইমলাইন কিংবা কমেন্টে ফুটিয়ে তোলে। ফেসবুকের বহুবিদ নেতিবাচক দিক ছাড়াও ইতিবাচক অনেক দিকও রয়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে অনেক গঠনমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। ছোট্ট একটি পোস্টের কারণে দেশ ও জাতির বিশাল কল্যাণও বয়ে আনে। উপকৃত হয় অনেক দুস্থ ও অসহায় পরিবার।

ছোটবেলায় আমি ডায়ারি লিখতাম। আজও লিখি। নানান ধরনের কথা আছে সেই ডায়ারিতে। লিখি নিজের কথা। লিখি নিজের অনুভূতির কথা। থাকে পরিবার এবং সমাজ নিয়ে নানান ভাবনার কথা। আরো কতশত গল্প থাকে সেই ডায়ারিতে! যেই কথাগুলো একান্তই আমার গল্প। এটাও এক ধরনের যোগাযোগ। যোগাযোগ বিদ্যায় যার নাম ‘অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ’। সহজ কথায় নিজের সঙ্গে যোগাযোগ। এই গল্পগুলো গণমাধ্যমের জন্য নয়। ছোটবেলায় যখন ডায়ারি লিখতাম সেই কথা কাউকে জানাতে চাইতাম না। কারণ ডায়ারি মানেই তো ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত মনের ভাবনা সবার জন্য উন্মুক্ত করার নাম স্বাধীনতা নয়। ছোটবেলায় স্বাধীনতাবোধের এই শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার থেকে। সেই লেখা কখনো একা বসে পড়ি আর মৃদু হাসি।

সিলেট নগরীর একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি চলছে স্কুল জুড়ে। একদিন মনে প্রশ্ন জাগলো কিছুদিন পর তো এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সবাই চলে যাব বিভিন্ন কলেজে, কিন্তু আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে কী ভাবনা পোষণ করে? এটা তো জানা হলো না। যেই ভাবনা সেই মাঠে নেমে পড়া। উত্তর আমাকে জানতেই হবে। কী করা যায়, ভাবতেই মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। ঠিক সেই সময় আমি একখানা নতুন ডায়ারি কিনেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমার স্কুলের বন্ধুরা আমাকে নিয়ে তাদের ধারণাগুলো সেই ডায়ারিতে যেন লিখে দেয়। বলতে পারেন এক ধরনের চিঠির মতো অথবা মন্তব্যধর্মী প্রতিবেদনও। পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি আমি ডায়ারিতে বন্ধুদের মন্তব্য নেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। শুরুতে আমার বন্ধুরা রাগী রাগী চোখে তাকালেও আইডিয়া ভালো হওয়ায় সবাই সেই ডায়ারিতে আমাকে নিয়ে তাদের ভাবনা লিখে দিয়েছিল খুশি মনে। তাদের ধারণাসংবলিত সেই ডায়ারিখানা আজও আমার সঙ্গী। সেই ডায়ারিতে আমাকে খুশি করার চেয়েও আমাকে সমালোচনা করেই মন্তব্য প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে সবই ছিল গঠনমূলক।

স্কুল গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। স্কুলের পুরোনো কিছু বন্ধুদের সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন কিছু বন্ধু। সেখানে বন্ধুদের অভিনব সব কাজ চলতে থাকে। পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল আমাদের আচরণে। কলেজের শ্রেণিকক্ষে আমরা খুব চিরকুট লিখতাম। ক্লাস চলাকালীন এতক্ষণ কথা না বলে কি করে থাকব! একটা তো উপায় বের করতেই হবে। বুদ্ধি আঁটতে শুরু করলাম। শুরু হলো তিন গোয়েন্দার ‘ভূত থেকে ভূতে’ স্টাইলে চিরকুট লেখা। মানবিকী অনুষদের বি শাখা ক্লাসের ১১ জন আমরা এই চিরকুট লেখার কাজটি খুবই পারদর্শিতার সঙ্গে করতাম।

আমার মতো আপনারাও নিশ্চয় অনেকেই ডায়ারি লিখেছেন। নিজের সঙ্গে কথা বলার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ডায়ারি এটা আমার দৃঢ়বিশ্বাস। দ্বিমত করতেই পারেন। দ্বিমতকে বিরোধিতা করব না। সব মানুষের জীবনে নিজস্ব কিছু বিষয় থাকে যা একান্তই নিজের। আবার কিছু বিষয় সবার জন্য উন্মুক্ত। চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে একটা বিষয় লক্ষণীয়—যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডায়ারি লেখার অভ্যাসটা কমে যাচ্ছে। চিরকুট লেখায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আছে কি না আমার জানা নেই।

যুগের এই পরিবর্তনের জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করতে চাই না আমি। প্রযুক্তির সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতাও নেই। প্রযুক্তি ব্যবহার বিধি নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে বইকি।

ডায়ারি নিয়ে কেন এত কথা বলছি! ডায়ারির কথা বলছি এজন্য যে, বর্তমান সময়ে আমরা ডায়ারিতে মনের কথা আর লিখি না। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তাদের সংখ্যা বের করার জন্য গবেষণা আবশ্যক। তবে ফেসবুকীয় প্রদর্শনবাদিতা এত ব্যাপকতা পেয়েছে যে, আজ আমাদের গোপনীয়তার বিষয়টি উন্মুক্ত পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার তো মনে হয় আমরা স্বাধীনতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।

এখন ফেসবুক খুললেই কারো না কারো, কোনো না কোনো মন্তব্য চোখে পড়ে। সেটা আমার অধ্যয়নের বিষয় বলতে পারেন। আমি ব্যক্তির পোস্টগুলোকে যদি আধেয় হিসেবে বিবেচনা করি তবে সেই আধেয় বিশ্লেষণ করতে আমার ভালো লাগে। সেই আধেয় বিশ্লেষণ করলে সেই ব্যক্তির আচরণ এবং পারিবারিক শিক্ষার একটা চিত্র অনুধাবন করা যায়। অনেকেই আছেন এমন ভাষায় পোস্ট করেন যেটা অধ্যয়ন করে রীতিমতো হুমকিস্বরূপ মনে হয়। সেখানে কোনো নান্দনিকতা বোধ দেখা যায় না। আমরা চাইলেই কি একে অন্যকে ফেসবুকে গালি দিতে পারব? ফেসবুকীয় কিছু মন্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে গালি দেওয়ার এই অধিকার কে নির্ধারণ করেছে? কিন্তু দ্বিধাহীন চিত্তে আমরা উন্মুক্ত ফেসবুকীয় প্ল্যাটফরমে নিজের ভেতরকার সহিংস মানুষটাকে প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে ফেলছি। এতে আমাদের কোনো অনুশোচনা হচ্ছে না। আবার কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও নেই। আবার মজার বিষয় হচ্ছে—কেউ একজন একটি নেতিবাচক স্ট্যাটাস দিলে তার ফেসবুকীয় বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ না করে এমন সব পালটা নেতিবাচক মন্তব্য করেন তাতে মানুষের আচরণের স্বরূপতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়ি।

আমাদের সবার মনে রাখা উচিত—এক জন নেতিবাচক ব্যক্তির মন্তব্য শুধু তার ব্যক্তিত্বের পরিচয়ই বহন করে না এবং ফেসবুকের বদৌলতে সেই নেতিবাচকতা অগণিত পরিবারের সদস্যদের মননে খুব দ্রুত ছড়ায়। যোগাযোগের শিক্ষক হিসেবে বিশ্বাস করি—নেতিবাচক মন্তব্য অবশ্যই সেই ব্যক্তির নেতিবাচক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এক জন ফেসবুক ব্যবহারকারী যা মন চাইল, যেভাবে মন চাইল লিখতে পারেন না। পারার কথাও নয়। তারপরও এই স্বাধীনতাবোধের অধিকার কোথা থেকে ব্যক্তি পেল? ফেসবুক ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তির নোংরা ভাবনা বিস্তার স্বাধীনতা নয়, আমার কাছে তা স্বেচ্ছাচারিতা। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ বিধি থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।

ফেসবুকের আধেয় অধ্যয়ন করে আমার প্রথম প্রস্তাব—ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নেতিবাচক আধেয় নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। কেননা অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো ফেসবুকও আমাদের আচরণে প্রভাব ফেলে। অধিক স্বাধীনতা পেয়ে আমরা যখন নিয়ন্ত্রণহীন ফেসবুকীয় উন্মুক্ত পরিসরে অশালীন বক্তব্য প্রকাশ করছি—এই নোংরা মানসিকতার প্রকাশ অন্যদের আচরণে খুব সহজেই দ্রুততার সঙ্গে প্রভাব ফেলছে। এবং এই নেতিবাচক প্রভাব অল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। একইভাবে একটি ভালো উদ্যোগ বা একটি ইতিবাচক প্রতিবাদ জোরালো করতে এই ফেসবুকের ভূমিকা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। তাই বলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অশালীন এবং স্বেচ্ছাচারী আচরণকে সমর্থন করার পক্ষপাতিও আমি নই। সবারই মনে রাখা উচিত—আপনার যেমন স্বাধীনতা আছে, তেমনি অন্য আরেকজন ইতিবাচক ব্যক্তি এবং পরিবারেরও শালীনভাবে বাঁচার সমান অধিকার আছে।

ফেসবুকের স্ট্যাটাস অধ্যয়ন করে এক জন মা হিসেবে আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ ‘ভাবনা জগৎ’ নিয়ে চিন্তিত। এক জন শিক্ষক হিসেবে আমি আমার শিক্ষার্থীদের ‘জীবনবোধের আচরণ’ প্রকাশের ধরন নিয়ে শঙ্কিত। ফেসবুকে সহিংস আচরণ প্রকাশ বন্ধ করতে হবে। বন্ধের প্রয়োজনে আইন বিধি প্রয়োগ করতে হবে। ফেসবুক আচরণ শেখাতে সক্ষম তাই ফেসবুকের ব্যবহার বিধিতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসা জরুরি বলে মনে করছি।

হুটহাট পোস্ট দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কারো কোনো নেতিবাচক লাইক কমেন্ট দেখেই রিপ্লাই দেয়া থেকে বিরত থাকুন। যদি কোনো কারণে নেতিবাচক কমেন্টের রিপ্লাই দিয়েই ফেললেন, আর তার প্রতিউত্তর নোংরা ভাষায় আসে, তখন চুপ থাকাই শ্রেয়। নতুবা সেই বর্বর আপনাকেও তার পর্যায় নামিয়ে আনবে। কখনো কোনো স্ট্যাটাস বা কমেন্ট দিতে গিয়ে যদি ভুল করে ফেলেন, তাহলে তা শুরুতেই দুঃখ প্রকাশ করে উর্বর মানসিকতার পরিচয় দিন। খুব কাছের মানুষের ভেতরের কুৎসিত রূপটা যখন, ফেসবুকের বদৌলতে বুঝতে পারবেন, তখন তাকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে নয়, সাক্ষাতে জানিয়ে দিন। আপনার পোস্টে কে বা কতজন লাইক কমেন্ট দিলো বা না দিলো, তা নিয়ে ভাবার চেয়ে আপনার পোস্ট সামাজিকমাধ্যমে কতটা গুরুত্ব বহন করল তা নিয়ে ভাবুন। অবসর সময়ে অনর্থক পোস্ট দিয়ে থাকলে, পরে তা সংশোধন বা মুছে দিন। অশালীন ভাষায় মন্তব্য করা, কারো সাথে তর্কে গেলেও এমন একটি মুহূর্তে তর্ক ছেড়ে দিন, যখন তার মন্তব্য নেটিজেনদের কাছে কুৎসিত মনের পরিচয় দেয়।

উল্লেখিত আলোচনা অনুসরণ করতে পারলে বর্তমান সময়ে ভার্চুয়াল জগতে যে অস্থিরতা তা অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে, শব্দ গঠনে সামান্য আকার, একার ভুলক্রমে না বসলেই সুন্দর একটি অভিব্যক্তির মন্তব্যও ভিন্নরকমভাবে উপস্থাপন হয়। সুতরাং ফেসবুক আসক্তি যেন মানসিক রোগের কারণ না হয়।

লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ