শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বুক রিভিউ : অগ্নিবীণা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।। আবদুল কাইয়ুম শেখ ।।

লেখক : কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকাশনী : মাওলা ব্রাদার্স
প্রচ্ছদ : (আবদুল) কাইয়ুম চৌধুরী
মূল্য : ৪০ টাকা
পৃষ্ঠা : ৬৪

বই-এর বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও পর্যালোচনা :

'অগ্নিবীণা' শব্দের অর্থ হলো, আগুনের বাঁশি কিংবা সপ্ততারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র! বইটিতে যেহেতু দ্রোহের দাবানল প্রমত্ত তরঙ্গের ন্যায় প্রবল বেগে বহমান রয়েছে তাই কবি আগুনের বাঁশির সঙ্গে তাশবীহ দিয়ে ও তুলনা করে গ্রন্থটিকে 'অগ্নিবীণা' বলে নামকরণ করেছেন! এই বিখ্যাত 'অগ্নিবীণা' গ্রন্থটি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি সর্বপ্রথম ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলি হচ্ছে - ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমণী’, ‘ধূমকেতু’, কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, খেয়াপারের তরণী’, কোরবানী’ ও মোহররম’। এছাড়া গ্রন্থটির সর্বাগ্রে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-কে লক্ষ্য করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতাও রয়েছে। কবি অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই প্রলয়োল্লাস কবিতাটির সূচনা এভাবে করেছেন,

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!

আলোচ্য 'প্রলয়োল্লাস' কবিতায় কবি বলতে চেয়েছেন, সর্বপ্রকার ঝড়, তুফান, টর্নেডো ও সাইক্লোন বিনাশ করার পরিবর্তে সৃজন করে! কবি 'প্রলয় নূতন সৃজন বেদন' বাণীটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় ভয় না পেয়ে জয়ধ্বনি করতে করতে দুর্বার বেগে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবার বলিষ্ট আহবান জানিয়েছেন!

'প্রলয়োল্লাস' কবিতার পর কাজী নজরুল ইসলাম বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে তার কবিতাসমূহের মধ্যকার সর্বাধিক বিখ্যাত 'বিদ্রোহী' কবিতাটি উল্লেখ করেছেন! ১৪১ লাইনের এই কবিতায় কবি দ্রোহের যে প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল বলেই আমাদের বিশ্বাস! কবিতাটিকে যদি বিদ্রোহাত্মক শব্দের বিশ্বকোষ ও এনসাইক্লোপেডিয়া বলে অভিহিত করা হয় তা হলেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না! এই বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিতাসমূহের অন্যতম। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে, বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই তা ব্যাপক গণজাগরণের সৃষ্টি করে। এ সময় তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয় বাংলা ভাষায় ও সাহিত্য পাড়ায়! প্রদীপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা, অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও কবিতাটি "চির উন্নত শির" নিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে ভাস্বর হয়ে আছে!

কবি 'রক্তাম্বর ধারিণী মা' কবিতায় মাতৃতুল্য স্বদেশ ও এর অধিবাসীদের অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম ও নিপীড়নের ভয়কে জয় করে রক্তরঞ্জিত বসন পরিধান করে ধ্বংসের বুকে সৃষ্টির নব পূর্ণিমায় হেসে উঠার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন!

আগমনী কবিতায় কবি নজরুল দুঃখ, শোক, অসুর ও দৈত্য-দানবের বিনাশ কামনা করে সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রশান্তির আগমনকে স্বাগতম জানিয়েছেন! সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই কবিতায় অধিকারবঞ্চিত সর্বহারা মানুষকে জেগে উঠার তেজোদৃপ্ত পয়গাম প্রদান করেছেন! ঠিক অনুরূপভাবে ‘ধূমকেতু’, কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, খেয়াপারের তরণী’, কোরবানী’ ও মোহররম’ কবিতাসমূহেও আমরা দেখতে পেয়েছি দ্রোহের তপ্ত আগুন ও আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার ভীমসঙ্কুল মহাবিস্ফোরণ!

নিম্নের বিখ্যাত লাইনগুলোও এই 'অগ্নিবীণার'ই অন্তর্ভুক্ত!

বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির
ঐ শিখর হিমাদ্রির!

ওরে আয়
ঐ মহাসিন্ধুর পাড় হতে ঘন রণভেরী শোনা যায়
ওরে আয়!

ঐ খেপেছে পাগ্‌লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্‌সে সামাল সামাল তাই
কামাল! তুনে কামাল কিয়া ভাই!

'এয় ইবরাহীম কোরবানী কর শ্রেষ্ঠ পুত্র ধন'
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন!

আস্তানা সিধা রাস্তা নয়
আযাদী মিলে না পস্তানোয়।

ফিরে এলো সেই মোহাররম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা!

কবি বক্ষ্যমাণগ্রন্থে শব্দীয়
গোলাবারুদের যে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ টিয়েছেন এবং অগ্নিস্ফুলিঙ্গের যে লেলিহান শিখা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা যুগযুগান্তরে কায়েমি স্বার্থবাদীদের অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে সর্বহারা মানুষকে দৃঢ়প্রত্যয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রদীপ্ত আহবান জানাবে! অসত্য, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবির লেখনীর 'ফণিমনসা' মনোভাবের কারণে বইটির 'অগ্নবীণা' নামকরণ শতভাগ সার্থক হয়েছে!

উচ্চমানের সাহিত্যমানসসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও মানবীয় কোনো রচনা এবং সৃষ্টিকর্মই ভু্লভ্রান্তি ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়! ভুলভ্রান্তি ও সন্দেহ সংশয়ের ঊর্ধ্বে থাকার একক বৈশিষ্ট্য কেবল আল্লাহ তাআলার বাণী মহাগ্রন্থ বল কুরআনের! তাই 'অগ্নিবীণা'র নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলতে চাই, দুর্বোধ্য, কঠিন ও লোহা লক্কর ভাষার কারণে নিম্ন কিংবা মধ্যমস্তরের সাধারণ পাঠকদের জন্য বইটি অনুধাবন করা দুরূহ ও বিরক্তিকর! তা ছাড়াও এতে রয়েছে এমন কিছু কাব্যপঙক্তি বাহ্যদৃষ্টিতে যেগুলোকে ইসলাম বিরোধী বলে প্রতীয়মান হয়! বিদ্রোহী কবিতায় দেখুন_

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!

ধূমকেতু কবিতায় এসেছে_

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যেহেতু ইংরেজ সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বিরামহীনভাবে লিখে চলছিলেন, তাই তার কবিতায় ঈশ্বর, দেবতা ও স্রষ্টাদ্রোহিতা প্রকারান্তরে তেজোদীপ্ত ভাষায় ইংরেজ সরকারের প্রবল বিরোধিতা! এসব কবিতা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগড়নের সৃষ্টি করেছিল এবং তাদের ক্ষমতার মসনদে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল! এসব কবিতায় তাদের বিরোধিতা করা হয়েছিল বলেই তারা সত্য, প্রেম ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কারারুদ্ধ করেছিল! 'রাজনন্দির জবানবন্দি' পড়লে আমাদের কথার সত্যতা আরো স্পষ্ট হবে।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ