এহসান সিরাজ
আব্বার চাচাত ভাই সিদ্দিক মিয়া (ওরফে ছিদ্দু মিয়া)। আমরা ডাকি ছিদ্দু কাকা! হাসিটা সবসময় তার ঠোটেই থাকে। কথা বলার আগেই হাসেন। গ্রামের আর দশটা মানুষের চেয়ে তার সরলতা আরও বেশি। সাত-পাঁচে তিনি নেই। অন্যের জমি-জমায় কাজ করে কোনোভাবে সংসার চালান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর ও গ্রামের আশপাশের দু’চারটা বাজার ছাড়া কোথাও যাননি তিনি। জীবনে ঢাকা শহরও দেখেননি!
কাকা একদিন স্বপ্ন দেখেন, তাবলীগ জামাতের আমির এবং কারাইলের মুরব্বি মাওলানা আলী আকবর [রহ.]-এর সঙ্গে চট্টগ্রামের পথে রওয়ানা হয়েছেন। উদ্দেশ্য পানির জাহাজে করে হজে যাবেন!
স্বপ্নেরঘোরে রঙ্গিন স্বপ্ন, মক্কাশরিফ যাচ্ছেন হাজির বেশে! যাবেন সোনার মদিনায়ও। কোনরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই পৌছে গেলেন চট্টগ্রাম বন্দরে। কিন্তু বিধি বাম, তাদের রেখে অনেক আগেই বন্দর ছেড়ে জাহাজ চলে গেছে সমুদ্র বুকে। অগত্যা ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় না থাকায় বাড়ি চলে এলেন!
ঘুম ভেঙ্গে গেলো কাকার। আফসোস, হায়! জীবনে কোনো দিন মক্কা-মদিনায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, আহ! আল্লায় যদি স্বপ্নেই আমাকে কালো গেলাফের ‘কাবা’ আর সোনার মদিনার সবুজ গম্বুজের ‘রওজা’ দেখিয়ে দিতেন!
এককান দু’কান করে করে সবার মুখেই ছিদ্দু কাকার হজ ফেরতের কাহিনী। কে যেনো নাম দিলো তার ‘ফিরতি হাজি!’ এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধী লাভ করলেন। হ্রদয়পটে তার স্বপ্নের আভা। মদিনার সবুজ গম্বুজ আর মক্কার কালো গেলাফের কাবা!
কেটে গেলো বহু বছর। ১৯৯৪ সালে ৫৪ বছর বয়সে ছিদ্দু কাকার মাথায় চাপলো কাজের জন্য সৌদিআরব যাওয়ার বাসনা। ‘শেষ বয়সে বিদেশ করতে পারবা না’ এ বলে সবাই তাকে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নাছুর বান্দা যাবেনই।
অবশেষে ভিটে-মাটি লিজ দিয়ে আরও কিছু ধার-দেনা করে ৬০ হাজার টাকায় ক্লিনার ভিসায় পাড়ি দিলেন সৌদিআরব। এক বছর কাজ করলেন মক্কার একটি হাসপাতালে। এরপর স্বপ্ন তার বাস্তবে এলো। বদলি হয়ে এলেন মসজিদে হারামের এক নম্বার গেইট ‘বাব আব্দুল আজিজ’-এ।
আগে কাবা ছিলো তার বুকে, আর এখন তিনি কাবার বুকে! বারোটি বছর কাটিয়ে দিলেন এক নম্বর গেইটেই। সাতবার হজ করলেন, ওমরাহ করলেন অসংখ্যবার। আর সুযোগ পেলেই চলে যেতেন মাতাফে, কাবার তাওয়াফে। আহ, কী ভাগ্য!
গ্রামীণ একটা প্রবাদ আছে, ”আল্লায় যারে দেয়, ছাপ্পর ফাইড়া দেয়।” ছিদ্দু কাকার বেলায় এ প্রবাদ অত্যুক্তি হবে না। কারণ, হজ মৌসুম শেষ এক সকালে ডিউটির সময় দেখেন হেরেমের কোনায় এক লোক অচেতন হয়ে পড়ে আছে। আরও দু’জনের সহযোগিতায় লোকটাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলেন তিনি।
জ্ঞান ফিরে এলে জানতে পারলেন ইনি সাধারণ কেউ নন। বায়তুল্লায় নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বীতিয় প্রধান অফিসার। গোপনে কর্মীদের নজরদারি করতে বের হয়ে হাইফু আক্রান্তে জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
সুস্থ হয়ে বৃদ্ধ ছিদ্দু কাকার কাছে অফিসার জানতে চাইলেন, প্রতিদান কী চাও? বললেন, আমি আল্লার জন্য করেছি, কোনো প্রতিদান চাই না!
অফিসার বললেন, আল্লাহ তোমাকে বড় প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। আমি তোমাকে কিছু একটা দিতে চাই। বলো, কী চাও? কাকা কিছু চায় না! অফিসারের পিড়াপিড়িতে অবশেষে বললেন হজ নিয়ে তার স্বপ্ন কাহিনী।
আরও বললেন, জীবনে কল্পনাও করিনি আমি তোমাদের দেশে আসবো হজ করবো। আমার সব আশাই আল্লাহ পূরণ করেছেন! তবে কিছুদিন ধরে একটা নতুন স্বপ্ন মনের কোণে বার বার উঁকি দিচ্ছে। যদি ভরসা দাও বলতে পারি। বলো তোমার নতুন স্বপ্ন?
কাকা বললেন, ক’দিন ধরেই তো কাবা ঘরের ভেতর-বাইরে সংস্কার কাজ হচ্ছে এ ফাঁকে যদি তুমি আমাকে কাবার ভেতর যাওয়ার একটা সুযোগ করে দাও জীবনভর তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
অবাক-বিস্ময়ে অফিসার তার দিকে চেয়ে থাকলেন! এ কী বলে বুড়ো? টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোনো কিছু না চেয়ে চাচ্ছে কাবা ঘরের ভেতর ঢোকার অনুমতি! আর এর ভেতরে তো নির্দিষ্ট ইউনিফরম ছাড়া কোনো শ্রমিক ঢোকতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ঠিক আছে কাল বাদ এশা ৭৯ নম্বার গেইটে থাকবে। আমি ঢুকানোর ব্যাবস্থা করবো।
পর দিন সময়ের আগেই গোসল করে নতুন কাপড় পড়ে জায়গা মতো হাজির ছিদ্দু কাকা। অফিসার তাকে নিয়ে সোজা কাবাঘরে! সময় দিলেন আট মিনিট। দুই দিকে চার রাকাত নামাজ পড়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ছিদ্দু কাকা হাত তুললেন রব্বে কাবার দরবারে! মালিক তুমি এভাবেই তোমার প্রিয় বান্দাকে তোমার ঘরে ডেকে আনো!
[২০১৬ সালে হজ থেকে আসার পর একদিন আসর নামাজ পরবর্তী কথোপকথনে অধমের কাছে চাচা জানতে চাইলেন, ভাতিজা! মক্কা- মদিনায় কী কী দেখেছো? বললাম, এই এই দেখেছি। চাচা আমাকে আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন এটা দেখেছো, ওটা দেখেছো? বললাম, হ্যাঁ কাকা দেখেছি।
তখন কাকা আবেগাপ্লুত হয়ে আমার হত ধরে বললেন, চাচা! আল্লাহ আমাকে একবার কাবা ঘরের ভেতর যাওয়ার তৌফিক দিয়েছেন। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম চাইলাম কীভাবে সম্ভব কাকা? তখন তিনি উল্লিখিত ঘটনা বললেন। ২০১৭ সালে কাকা ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতের নুর দিয়ে ভরপুর করুন]
লিখক: আলেম সাংবাদিক ও লেখক
-এটি