মাওলানা মাহমুদুল হাসান ।। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ওপর দুটি হক বা কর্তব্য রয়েছে- হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ। মোহাম্মদ সা. এ দুটি বিষয় যথাযথ সম্পাদনের পথ ও পদ্ধতি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন বিধায় তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব। এ বিষয়ে লিখতে গেলে একটি গ্রন্থ রচনা করতে হয়, তবে আমি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি।
হক্কুল্লাহঃ জন্মদাতা ও দাত্রী হিসেবে সন্তানের উপর যেমন পিতা মাতার অধিকার আছে তদ্রূপ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রিজিকদাতা হিসাবে বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার আছে। আর তা হলো আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করা এবং তার সাথে কোন কিছু শরিক না করা।
কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর পৃথিবীতে আল্লাহর পরিচয় ছিল না, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ও রাজা-সম্রাটরা তার স্থান দখল করে নিয়েছিল। আমরা মুসলমানরা মনে করি শুধু ফেরাউন খোদা দাবী করেছিল, আসলে সে যুগের রাজা ও সম্রাটরা নিজেদের খোদা মনে করত।
যেমন পারস্যের সম্রাটগন নিজেদের ঈশ্বর ভাবত আর প্রজারাও তাদেরকে খোদা জ্ঞানে সেজদা করত। চীনারা মনে করত আসমান নর আর জমিন নারী, এতদুভয়ের মিলনের প্রথম ফসল হলেন সম্রাট প্রথম খাতা। এজন্য চীনারা সম্রাটদের ঈশ্বর মনে করত। ভারতবর্ষে তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা হত। বৌদ্ধরা গৌতম বুদ্ধকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করত।
আরবরা বিভিন্ন দেবদেবী ও পাথর পুজায় লিপ্ত ছিল। রোম সাম্রাজ্যে তখন সেন্ট পলের ত্রিত্ববাদ তথা বাপ-বেটা ও পবিত্র আত্মার মধ্যে ঈসাকেই আ. প্রকৃত খোদা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তাছাড়া খ্রিস্টান পুরোহিতরা বুঝিয়েছিলেন যে, সম্রাট হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি তিনি ঈশ্বর ব্যতীত জনগণের কাছে দায়ী নয়।
এভাবে জনগণকে সম্রাটের দাসে পরিণত করা হয়েছিল। পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে তখন মূর্তিপূজা থেকে খ্রিস্টধর্মে উত্তরণ শুরু হয়েছে মাত্র। আর পূর্ব এশিয়া বৌদ্ধ পূজা ও মূর্তি পূজার জগাখিচুড়িতে লিপ্ত ছিল। এক কথায় ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ আল্লাহর নাম ও তৌহিদের সাথে পরিচিত ছিল না, সর্বত্র স্রষ্টার স্থলে সৃষ্টির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এমনি তমসাচ্ছন্ন যুগে মানুষের প্রতি আল্লাহর দয়া হল। মোহাম্মদ সা. আবির্ভূত হয়ে ডাক দিলেন 'হে মানবজাতি, বল আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নাই, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। এভাবে তিনি সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন করলেন।
হক্কুল ইবাদ-বান্দার অধিকার বা মানবাধিকার।
মানুষ সামাজিক জীব, পরস্পরের সহযোগিতা ব্যতীত সে বাঁচতে পারে না। কাজেই ব্যক্তির উপর অন্যদের যে অধিকার এবং অন্যদের ওপর তার যে অধিকার তাকেই হক্কুল ইবাদ বলে। এখানে আমি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করলাম।
নারী অধিকারঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে নারী ছিল মূর্তিমান অভিশাপ। ভারতে ছিল সতীদাহ প্রথা, আরবরা কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত, খ্রীষ্ট ইউরোপ মনে করত নারী আদি পাপের উৎস এবং নারীর প্রাণ নেই।
কারণ বাইবেলে বলা হয়েছে আদমের পাজরের হাড় থেকে ইভ বা নারীর সৃষ্টি হয়েছে। আর হাড় প্রাণহীন বিধায় নারীও প্রাণহীন জড়বস্তু। তাছাড়া কোন ধর্মেই নারীর উত্তরাধিকার, মোহরানা, সম্পদের অধিকার ইত্যাদি ছিল না।
এ অবস্থায় রাসূল সা. নারীর যে অধিকার দিয়েছেন তা অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে কল্পনাতীত। যেমন নারীর তিনটি অবস্থা- ঝি, জায়া ও জননী। (১) ঝি বা কন্যা সন্তানের বিষয়ে রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি দুটি বা তিনটি কন্যা সন্তান প্রতিপালন করে যোগ্য পাত্রে পাত্রস্ত করবে সে আর আমি পাশাপাশি জান্নাতে থাকব।
(২) জায়া বা স্ত্রীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, সমঅধিকার, সম্পদ সঞ্চয় বা মালিকানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। বিষয়টা দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। (৩) জননী বা মাকে ইসলাম বিস্ময়কর অধিকার দিয়েছে। যেমন- (ক) যীশু খ্রীষ্ট বলেছেন তাকে পিতা-মাতা-সন্তান ও সকল মানুষ থেকে অধিক ভালবাসতে হবে (নিউ টেস্টামেন্ট)।
(খ) রাসূল সা. বলেছেন, তাকে পিতা পুত্র ও সকল মানুষ থেকে অধিক ভালবাসতে হবে। অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্ট মাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন কিন্তু রাসূল সা. বাদ দিয়েছেন। এর অর্থ হল সন্তান রাসূলের সা. চেয়ে মাকে অধিক ভালবাসবে। কিন্তু জুরাইজের হাদীসে ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। জুরাইজ নামাজ পড়ছিলেন তখন তার মা ডাকছিলেন। কিন্তু নামাজ ভেঙ্গে তিনি সাড়া দেননি, এজন্য পরবর্তীতে ব্যভিচারের অপবাদসহ তাকে অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিল। এই হাদীস প্রমাণ করে আল্লাহর হুকুম আর মায়ের হুকুমের মধ্যে সমন্বয় করে চলতে হবে।
তদুপরি ইসলাম নারীর উক্ত তিনটি অবস্থার যাবতীয় দায়িত্ব তিন শ্রেণীর পুরুষ তথা পিতা, স্বামী ও সন্তানের উপর ফরজ করে দিয়েছে। এরপরেও পর্দাসহকারে নারীর জন্য চাকরি বা আয়-উপার্জনের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য দর্শন অনুযায়ী দুর্বল নারীর দায় দায়িত্ব কারো ওপর ন্যস্ত তো করা হয়ইনি বরং তারা বলছে, একটা পশু বাচ্চা যেমন নিজের খাদ্য নিজে গ্রহণ করা পর্যন্ত মা দেখাশোনা করে মানুষও তাই করবে।
তারপর সে নিজেই নিজের জীবিকা নির্বাহ করবে। এজন্যই চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় বেচারী নারী তো না খেয়ে মরবে। এটাই পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতা বা সমান অধিকারের মর্মকথা।
বিচারের অধিকার: ইসলামে ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রে কিসাস ও দিয়তের এখতিয়ারসহ অন্য সকল হত্যার ক্ষেত্রে দিয়ত তথা ১০০ উট বা দশ হাজার দিরহাম বা তৎসম পরিমাণ মূল্য প্রদানের বিধান দেয়া হয়েছে। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। এসব অর্থ পেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বাঁচতে পারত।
দরিদ্রের অধিকারঃ পৃথিবীর সকল ধর্ম ও মতবাদের মধ্যে একমাত্র ইসলাম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে। এজন্য যাকাত, ইনফাক, ইসলামী সমাজতন্ত্র, জিজিয়া, খারাজ, উশর ইত্যাদির বিধান দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ যাকাতে দরিদ্রের প্রয়োজন না মিটলে ইনফাক, তাতেও না হলে সম্পদ কেউ সঞ্জয় করতে পারবে না, সমবন্টন হবে। দলীল- লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলে দাও, আফবু অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দরিদ্রদের মাঝে দান করে দিতে হবে। (বাক্বারাঃ ২১৯)
ইয়াতিম বিধবার অধিকারঃ রাসূল সা. বলেন, কেউ মারা গেলে সম্পদ তার পরিবারের কিন্তু বোঝা আমার (মৃত ব্যক্তির পরিবারের ভরণ-পোষণ), আমি মৃত ব্যক্তির ঋণও পরিশোধ করব।
রাসুলের আত্মত্যাগঃ রাসুলের (সাঃ) কোন পাপ ছিল না, এর পরেও তিনি সাওমে বেসাল বা লাগাতার রোজা রাখতেন এবং সারা রাত দাড়িয়ে নামাজ পড়ে পা ফুলিয়ে ফেলতেন।
একইভাবে তিনি না খেয়ে কষ্ট করেছেন যদিও এর প্রয়োজন ছিল না। তিনি হযরত খাদিজার রা. সকল সম্পদ দরিদ্রের মাঝে দান করে দেন। তারপর গনিমত, যাকাত, ঊষর, খারাজ ইত্যাদি সরকারি মাল যা আসতো সাথে সাথে বন্টন করে দিতেন, ঘরে কিছুই রাখতেন না। তারপর আকছর ওয়াক্ত তিনি না খেয়ে থাকতেন।
যেমন হজরত আয়েশা ও মাইমুনা রা. বলেন, রাসূল সা. সাধারণত চাশতের সময় কিছু খাওয়ার জন্য স্ত্রীদের ঘরে আসতেন। কিছু পেলে খেতেন আর না পেলে বলতেন ‘আনা সায়েম- আমি রোযা রাখলাম। হজরত জাবের ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা জীবনে কোন দিন পেট ভরে তৃপ্তি সহকারে খেতে পান নাই।
হায় আফসোস, যিনি মানুষ ও মানবতার পূর্ণাঙ্গ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। বস্তুত পৃথিবীর বুকে যে মানুষটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার হয়েছে, যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা রটানো হয়েছে, যাকে সবচেয়ে বেশি অপবাদ দেয়া হয়েছে এবং ভুল বুঝানো হয়েছে- তার নাম মুহাম্মদ (সা.)।
বস্তুত এই সংঘাতের মূল কারণ হল সভ্যতার সংঘাত। কারণ পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তি হল সোশ্যাল ডারউইনিজম বা ন্যাচারাল সিলেকশন আর ইসলামের ভিত্তি হল "ইনসাফ"। পশ্চিমারা যোগ্যের উদ্ধর্তন সূত্রানুসারে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীতে শক্তিমানের শাসন নিশ্চিত করতে চায় আর দুর্বল বিনাশ করতে চায়। পক্ষান্তরে রাসূল (সাঃ) দুর্বলের আর্থিক ও বৈচারিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন- যা ডারউইনিজমের সাথে সাংঘর্ষিক। এজন্যই পাশ্চাত্য ও তাদের দোসররা ইসলাম ও ইসলামের নবীকে হেয় প্রতিপন্ন করে দাবিয়ে রাখতে চায়।
মুহাম্মদ সা. কেন শ্রেষ্ঠ?
রাসুল সা. তিনটি মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন- যা পৃথিবীর অন্য কোন মহামানবের পক্ষে সম্ভব হয়নি। (ক) তিনি সৃষ্টির সাথে সৃষ্টার পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। (খ) তিনি মানব জীবনের জন্য উত্তম, সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। যেমন খাওয়া-ঘুম, নখ-চুল কাটা, জুতা-কাপড় পরিধান করা, পেসাব-পায়খানা থেকে কাফন-দাফন পর্যন্ত। (গ) দারিদ্র বিমোচনে তিনি নিজে না খেয়ে কষ্ট করে পৃথিবীতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
পুনশ্চঃ গ্রিক সভ্যতা থেকে বর্তমান পর্যন্ত মনীষীগণ একটু একটু করে যে চিন্তা করেছেন তা জোড়াতালি দিয়ে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্ম দেয়া হয়েছে- যা ইসলামি জীবন ব্যবস্থার হাজার ভাগের একটা খণ্ডাংশ। পক্ষান্তরে রাসুল (সা) একা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছেন- যা মানবকল্যাণে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণিত হয়েছে।
এর অর্থ হলো পৃথিবীর তাবৎ দার্শনিক, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী সম্মিলিতভাবে মানব কল্যাণে যা করতে পারেননি একা মুহাম্মদ (সাঃ) তার চেয়েও উত্তমটা করেছেন।
এজন্যই তিনি সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ মহামনব। ওয়ামা আরসালনাকা আমি তোমাকে পাঠিয়েছি জগৎবাসীর রহমত হিসেবে। বুয়িছতু লিউতাম্মিমা মাকারিমাল আখলাক্ব- আমি মানব জাতির উন্নততর চারিত্রিক ভূষণ পূর্ণাঙ্গ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
-এটি