এম এ মান্নান, ফুলপুর ।।
অধিকাংশ সময় যিকির আযকার, তাসবীহ তাহলীল ও সুলূকের লাইনে মেহনতের মাধ্যমে মসজিদেই সময় কাটান হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমীর পীরে কামিল শায়খুল হাদীস মরহুম আল্লামা আহমদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহির খলীফা ময়মনসিংহের ফুলপুর সদর কাজী পীরে কামিল মাওলানা শাহ ওয়াজেদুল ইসলাম আলমগীর।
ছোট বেলা থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দীনদার, নামাজী, কুরআনের আশেক, পরহেজগার ও আল্লাহওয়ালা একজন মানুষ। এখন পর্যন্ত তার আমলের এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন তিনি।
কাজী আলমগীর ১৯৫৮ সনের ১ মার্চ নানার বাড়িতে অর্থাৎ ফুলপুর উপজেলার বওলা ইউনিয়নের রামসোনা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী দারোগা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার নানা মরহুম ইমাম হোসেন তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত আদর্শ, ন্যায় নীতিবান, প্রভাবশালী ও আল্লাহওয়ালা একজন দারোগা ছিলেন। আর তার বাবা মরহুম কাজী মৌলভী শাহ এলাহী বক্স ও মা মরহুমা ছাবেদা খানমের বাড়িও একই উপজেলার একই ইউনিয়নের হাতিবান্ধা গ্রামে। তার বাবা কাজী এলাহী বক্স একজন দেওবন্দী আলেম ছিলেন।
তিনি কলকাতা আলিয়া ও বেরলভি মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেছেন। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার আলিফ বা তা’র হাতে খড়ি হয় নোয়াখালীর মরহুম ক্বারী ফয়জুল্লাহ (রহ.)র নিকট।
তিনি তখন ফুলপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। এসময় কাজী মাওলানা আলমগীরের বাবা এলাহী বক্স ফুলপুরে পুরাতন ডাকবাংলা রোডে বর্তমান কাজী বাড়িতে এসে জমি কিনে বসতি স্থাপন করেন।
সে সুবাদে তিনি বাসস্ট্যান্ড মসজিদে গিয়ে পড়তেন। এরপর তিনি আমুয়াকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৪র্থ শ্রেণি পাস করে কাজিয়াকান্দা কামিল মাদরাসায় ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে সেখান থেকে তিনি দাখিল, আলিম ও ফাযিল পাস করেন। এসব ক্লাসে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
এরপর চলে যান ময়মনসিংহের কাতলাসেন আলিয়া মাদরাসায়। সেখান থেকে তিনি ১৯৭৬ সনে তৃতীয় শ্রেণিতে কামিল পাস করেন। কামিল পাস করলেও ইলমী সাইডে তার কমতি অনুভব হয়। পরে আরও অধিক ইলম হাসিলের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সনেই চলে যান বাংলাদেশের বিখ্যাত ক্বওমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে।
সেখানে গিয়ে নিচের জামাতে ভর্তি হয়ে পড়া শুরু করেন এবং ১৯৮৪ সনে মিশকাত জামাত সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি নিজ এলাকায় চলে আসেন।
এর আগে ১৯৮০ সনে তিনি তার বাবার উত্তরসূরী হিসেবে ফুলপুর সদর কাজী পদে কর্মজীবন শুরু করেন এবং এখনো এ পদে তিনি বহাল আছেন। এছাড়া ওই একই সনে উপজেলার রূপসী ইউনিয়নের ঘোমগাঁও গ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের প্রথমা কন্যা সৈয়দা গুলশানারা বেগমের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত সুখের হয়। তিনি ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক। তার প্রথম সন্তান হাফেজ আব্দুল্লাহ।
তিনি বাবার সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। দ্বিতীয় সন্তান হাফেজা আমাতুল্লাহ। ময়মনসিংহের শিকারীকান্দা গ্রামে তার বিবাহ হয়েছে। তার স্বামী হাফেজ মাওলানা মুফতী আবু নাঈম কাসেমী গাজীপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম। এছাড়া ফাতেমাতুজ জুহরা নামে একটি দাওরা মহিলা মাদরাসা ও একটি ছেলেদের মাদরাসার পরিচালক। হাফেজা আমাতুল্লাহ ওই মহিলা মাদরাসার হিফজ বিভাগের পরিচালক। তার তৃতীয় সন্তান জামিলা খাতুন। তিনি একজন আদর্শ গৃহিণী।
তার বিয়ে হয়েছে রহিমগঞ্জ গ্রামে। তার স্বামী মাওলানা আনিছুল্লাহ ত্রিশালের বালিপাড়ায় একটি মাদরাসার পরিচালক। কাজী মাওলানা আলমগীরের চতুর্থ সন্তান হাফেজ মাওলানা আব্দুল ওয়াদূদ ইমরান। তিনিও বাবার সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। ইমরান ফুলপুর ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক।
বিগত পৌরসভা নির্বাচনে তিনি কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছেন। তবে থেমে যাননি। আগামীতে আবারও তিনি নির্বাচন করতে কাজ করে যাচ্ছেন এলাকায়। তার পঞ্চম সন্তান হাফেজ মাওলানা উবায়দুল্লাহ। তিনি ওমান প্রবাসী। সেখানে তিনি একটি মসজিদের ইমাম ও খতীব। তার ৬ষ্ঠ বা সর্বশেষ সন্তান ফাতেমা খাতুন। তিনি দাওরা পাস।
একজন আদর্শ গৃহিণী। তার স্বামী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএজি পাস করে সিলেটের মৌলভী বাজার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র প্রশিক্ষক। মাওলানা শাহ ওয়াজেদুল ইসলাম আলমগীর সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন কাজে জড়িত। তিনি ছাত্রজীবনে কাতলাসেন পড়াকালীন বারোরি সৈয়দ মোড়লের বাড়িতে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এরপর ১৯৯০ সনে পুরাতন ডাকবাংলায় নিজ জমিতে বাইতুল ওয়াদূদ শাহী জামে মসজিদ নামে একটি মসজিদ ও এর পাশে তার ছোটভাই মোয়াজ্জেম হোসেনের জায়গায় একটি মক্তব ও হিফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি বর্তমানে চলমান থাকলেও সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে মক্তব ও হিফজখানাটি বন্ধ রয়েছে।
এমনকি মক্তবের সেই ঘরটিও আর এখন নেই। তবে কাজী সাহেবের এজন্য মন কাঁদে। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় মানসিকভাবে তিনি অশান্তি অনুভব করছেন। তাই এসব প্রতিষ্ঠান সুন্দর ও সুচারুভাবে পুনরায় চালু করার চেষ্টা তিনি অব্যাহত রেখে চলেছেন। কোন হৃদয়বান ব্যক্তি এগিয়ে আসলে তার জন্য সহজ হবে। এখানে আরেকটি কথা পাঠকের জানার জন্য উল্লেখ করছি।
কাজী সাহেব একজন ইলম পিপাসু। তিনি সময় পেলেই কুরআন তিলাওয়াত করেন। কিছুদিন তিনি ফুলপুর সরকারি কলেজ রোডে দারুল ইহসান কাসিমিয়া এক্সিলেন্ট মাদরাসায়ও হিফজখানায় হাফেজ রমজান আলী জাইরার হুজুরের দারসে বসেছেন। তার দাওরা জামাত পড়া বাকি থাকায় ২০১৩ সনে পুনরায় তিনি হাটহাজারী চলে যান এবং আল্লামা আহমদ শফী হজুরের সুহবতে থেকে তারই নিকট দাওরা সম্পন্ন করেন। এছাড়া এই শায়েখের নিকট বায়াত হয়ে ২০১৯ সন পর্যন্ত তার অধীনে তাযকিয়ায়ে নাফসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পরে ২০১৮ সনে আহমদ শফী হুজুর তাকে খেলাফত দান করেন। এছাড়া হাটহাজারী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম সাহেবের ছেলে হাফেজ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নিকট থেকেও তিনি খেলাফতপ্রাপ্ত।
কাজী আলমগীর নিজেও মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক রংপুরী, মাওলানা আশরাফ উদ্দিন ও মাওলানা মাহফুজসহ শতাধিক আলেমকে খেলাফত দান করেছেন বলে জানান। তিনি তাবলীগের একজন মুবাল্লিগ। ২০১৩ সনে তিনি ঢাকা, টাঙ্গাইল, যশোর, গাজীপুর ও নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এক সাল লাগিয়েছেন।
তিনি সব সময় দাওয়াতের কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার আজও হজ্ব করা সম্ভব হয়নি। তিনি বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। এর ভিতর দিয়েই তার অধিকাংশ সময় কাটে মসজিদে যিকির আযকার, তাসবীহ তাহলীল ও সুলূকের লাইনে মেহনতের মাধ্যমে। এভাবেই তিনি তার জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাতে চান। শনিবার (২১ মে) বাদ আসর পুরাতন ডাকবাংলায় কাজীবাড়ী জামে মসজিদে এ প্রতিবেদকের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সকল মানুষ কুরআন ও হাদিসের আলোকে চলুক এটাই আমার চাওয়া। সবশেষে তিনি সকলের দোয়া কামনা করেন।
-এটি