শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


নদীর ভাঙন ও হাসমত আলীর পরিবার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম

সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।সাথে তিব্র বেগে বাতাস। আচমকাই বৃষ্টির গতিবেগ কমে আসতে থাকে।আর একসময় সম্পূর্ণ রূপে বৃষ্টি ঝড়া খ্যান্ত হয়ে যায়।

চারিদিকের গাছপালাগুলোন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।হাঁস-মুরগি ও বনের পশু পাখিরা বেড়িয়ে যায় খাবারের সন্ধানে। গৃহ পালিত পশুদের কে তাদের আপন আপন মালিকগন মাঠে নিয়ে যায়।চারপাশে ছেলেপুলেদের হৈ-হুল্লোড়,পশুপাখিদের ডাক। সব মিলে ভিন্নরকম মন মতানো কলরবে পরিনত হয়।

কিন্তু তখনও মেঘের ঘোর সরেনি।সূর্যের কোনো নিশানা পর্যন্ত নেই। নাতিপুতিদের ক্ষুধার্ত রোদন বিষাদ ঠেকে তাই বাহিরে বেড়িয়ে দুই হাটু উঁচু করে উর্ধমূখী হয়ে বসে আশি বছরের বৃদ্ধ হাসমত আলী।

যেন মিনতির স্বরে প্রশ্ন করতে চায় স্রষ্টাকে। আসমান জমিনের মালিককে।তার চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।এক চির চেনা আতংক ভর করেছে তার ঘাড়ে।তারা নদী মাত্রিক অঞ্চলের মানুষ।

কৃষি কাজ ও মৎস শিকার তাদের প্রদান আয়ের উৎস।জলের উচ্ছাস-বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে মেঘেদের ছুটাছুটি ভয়ংকর আকার ধারণ করবে বলে মনে হয়। আকাশের অবস্থা খারাপ, যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।গত রাতে রেডিওর আবহাওয়ার সংবাদ থেকে সে এমনটাই শুনেছে।

নিজের অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে হাসমত আলীর। ভাবতে থাকে তাঁর এবং তার পরিবারের জীবন যাত্রার পট পরিবর্তন হওয়ার ইতিবৃত্ত।

সে অনেক দিন আগের কথা। যখন সে সুস্থ সবল ছিলো। দিনের পর দিন গরুর পিছে ছুটাছুটি আর হাল চাষ করে দিন পার করতো।
পৌত্রিক সুত্রে পাওয়া কিছু জমিজমা ছিল। সেখানে চাষবাস ও গরু বাছুর লালন পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতো হাসমত আলী।পরিবারের সদস্য বলতে গেলে একটি মাত্র ছেলে ও তারা স্বামী স্ত্রী দুজন। মোটামুটি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটতো তাদের।

স্রষ্টার মর্জি। এক সময় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে অথই জলে ভেসে যায় তার সব জমিজমা। জমানো টাকা পয়সা দিয়ে একটু দূরে গিয়ে আবাসস্থল গড়ে তুলে।নদীর কোল ঘেঁষা ছাড়া উপায় নেই।কেননা নদীর মাধ্যমেই যে পেটে পরে দুমুঠো দানা পানি।জমিজিরাত তো ভেসে গেলো জলের স্রোতে।পরের জমিতে চাষ করে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।শুধুই গাধা খাটুনি।

এরই মধ্যে কঠিন পরিশ্রম করা মানুষ হাসমত আলীর গায়ের জোর আর আগের মতে থাকে না।হয়তোবা কদিন বাদেই দাড়িয়ে যাবে বৃদ্ধের কাতারে।

এমনেই নাকের উপর নয় হাত পানি তার উপর আবার মাথায় ছখান ইট রাখার মত অবস্থা। রোগের কি আর দুঃখ সুখ আছে।হঠাৎই হাসমত আলীর স্ত্রী ভিতর বাসা বাঁধে নানান রোগ।চিকিৎসা করার মত টাকাটাও তার কাছে থাকে না।

কোনো উপায় খুজে না পেয়ে মনোযোগ সহ পূর্ণ রুপে কাজে মন দেশ একমাত্র ছেলে শফিউল। যেভাবেই হোক মাকে বাঁচাতে হবে তার।বেশ কষ্ট সাধ্য হলেও মোটেই হাল ছাড়েনি।

দিন রাতের অক্লান্ত পরিশ্রমের অর্থ দ্বারা চিকিৎসা করে অসুস্থ মাকে।এক সময় বিধাতার অশেষ কৃপায় আগের মত না হলেও মাকে মোটামুটি সুস্থ করে তোলে শফিউল।

বাবা ছেলের এক সঙ্গে খাটুনির ফলে সংসার স্বচ্ছলতার দিকে পা বাড়ায়। ছেলের ভক্তি শ্রদ্ধায় হাসমত ও তার স্ত্রী ভীষণ খুশি।তারা উভয়ে পরামর্শ করে লাল টুকটুকে একটা কর্মঠ বউ এনে দেয় শফিউলের জন্য।

আনন্দ উল্লাসের সাথে তাদের দিন কাটতে থাকে।তাদের আনন্দের স্রোতকে আরও গতিময় করতে শফিউলের স্ত্রীর কোলে আসে একটি মিষ্টি মেয়ে বাবু।কিন্তু একমাত্র ছেলের প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় অসহায়ত্বের সাথে লড়াই করে আসা এই পরিবারের সবাই রীতিমতো মনঃক্ষুণ্ন হয়।এমনকি মফিজ নিজেও। প্রথম সন্তান বলে কথা, তাদের এই রাগ অভিমান আর কুসংস্কারের উপর বিশ্বাস বেশি দিন টিকে না।পুনরায় তাদের আনন্দ উল্লাসের ধারা অব্যাহত থাকে।

কিন্তু কে জানতো যে তাদের এই আনন্দ বেশি দিন টিকবে না।একটা সময় এই আনন্দই পরিনত হবে দুঃখে।

তারপর একদিন হঠাত করেই শফিউলের মা সবাই কে অবাক করে দিয়ে মৃত্যু বরণ করে। যে মানুষটা দুরারোগ্য রোগ হতে মুক্তি পেয়ে রীতিমতো সুস্থ সবল হয়ে উঠে, আজ হঠাৎ করেই তার এমন চলে যাওয়ায় অবাক হওয়ারই কথা।পুরো পরিবার জুড়েই শোক নেমে আসে।

কয়েক মাস বাদেই বর্ষার মৌসুম চলে এলো কারণে অকারণেই নদীর জল উত্তেজিত। ঝড় বৃষ্টিতে জল বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভাঙনের গতিও তীব্রতর।অকল্পনীয় ভাবে নদী চলে এলো একেবারেই হাসমত আলীর গ্রামের নিকট।

জমানো টাকা পয়সা ও নেই। স্বচ্ছল আত্মীয় স্বজনও তেমন কেউ নেই। আচমকা নদীর এহেন পরিস্থিতিতে গ্রাম বাসী সকলেই চিন্তিত।তাছাড়া আশ পাশের সবাই-ই নিজেদের নতুন আবাসস্থল গড়তে ব্যাস্ত।

রোগ শোক ভূলে এবারও বাবা ছেলে নেমে পরে দাড়ানোর মত একটু জায়গার সন্ধানে। বেশ কয়েক দিন ঘুরে ও ফলপ্রুস তেমন কিছু করতে পারে না।অথচ নদীর উচ্ছাস তরঙ্গ মোটেই শান্ত হয় না।

নদী এসে দাড়িয়েছে একেবারে নাকের ডগায়।নিরুপায় হয়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো বসবাসের সেই পুরনো ঘর সহ ঘরের কিছু আসবাব পত্র বিক্রি করে দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

এরপর বিক্রির টাকা দিয়ে একটু জায়গা ক্রয় করে।দাড়ানোর জায়গা হলে মাথা গোঁজার একটা ঘরের ব্যাবস্থা হবেই।মায়াময় ভিটা মাটি ঘর দুয়ার নদীর স্রোতে ঠেলে দিয়ে চলে আসে নতুন এক জায়গায়। এক ধনী বাড়ির ক্রয়কৃত কামলা হয়ে যায় শফিউল।এর বিনিময়ে কিছু টাকা এনে বসবাসের জন্য একটা ঘর তোলে।

আজ বছর খানেক হলো কামলা খাটার সময় শেষ হয়েছে। আজ বেশ কদিন বন্যার পূর্বাভাস।তাই নদীর উচ্ছাসের নিকটবর্তী হওয়া দূর্সাধ্য।তাই রুজিরোজগার প্রায় বন্ধ।অনাহারে কাঁদে আদরের ছোট্ট ছেলে মেয়েরা।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ