সাইফুল্লাহ সুবহান।।
আমার বয়স তখন আট কি নয়। 'তফদার কান্দি' গ্রামে আমরা থাকি। গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে আমাদের বাড়ি। এরপর আর বাড়ি মাত্র দুটি। নাজমুলদের আর মধু আপাদের।
মধু আপাদের বাড়ির পর 'তফদার কান্দি' গ্রামের সীমানা শেষ। এরপর দক্ষিণ দিকে বড় রাস্তার পূব পশ্চিম দুই পাশে প্রায় আধ মাইল পর্যন্ত গাছ পালা ঘর বাড়ি কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু ফসলি জমি। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। আমাদের গ্রামের ভাষায় বলে বিল। দূরে যেখানে বিলের শেষ প্রান্তে ঘর বাড়ি গাছপালার ছবির মতো আবছায়া লোকালয় দেখা যায়, ঐ সুনীল আকাশটা যেন গোল হয়ে নেমে এসেছে সেখানে। যেন বিল পেরোলেই আকাশ ছোঁয়া যাবে। কত বিকাল আকাশ ছোঁয়ার নেশায় আমার আর নাজমুলের বিল পেরোনোর ফন্দি করে কেটে যায়! কিন্তু বিল আর পেরোনো হয় না। সময় বয়ে যায়। আর বয়ে যায় আমাদের বয়স।
আমাদের বিল পেরোনোর অভিযানে যোগ দেয় আরেকজন। তার নাম রফিক। রাস্তার পশ্চিম পাশে আমাদের বাড়ি কিন্তু, পুকুরটা রাস্তার পূবপাশে। আমাদের পুকুরের উত্তর-পূব কোণায় রফিকদের পুকুর। পুকুর দুটিকে পৃথক করেছে ছোট্ট এক টুকরো জমি। আমরা বলি 'আড়া' বা 'জানপাড়'। জায়গাটি বড় বড় দু-তিনটি আমগাছের ছায়া শোভিত। এর মধ্যে একটা গাছ দক্ষিণ দিকে হেলানো। এই হেলানো গাছে বসে আমাদের শৈশবের বৈকালিক আড্ডা ও আনন্দ জমে ওঠে। আমরা খেজুর পাতা দিয়ে চার পাখার ফ্যান বানাই। তার নাম 'চরকা'। খেজুর কাঁটায় গেঁথে নেই খেজুর পাতার চরকা। কাঁটায় গাঁথা চরকা হাতে দক্ষীণমুখী হয়ে রফিকদের 'জানপাড়ে' বসে যাই। মন জুড়ানো দখিনা হাওয়ায় এক ধরনের মৃদু আওয়াজ তুলে ঘুরে ওঠে চরকা। আমাদের মনে জেগে ওঠে উথালপাথাল আনন্দের ঢেউ।
এখন বর্ষা। বিল ভরা পানি আর কাদামাটি। সে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মতো তিন মানুষ সমান ধনচে আর পাট গাছ। সবুজ ধনচে আর পাটে যখন বাতাস লাগে গোটা বিল জুড়ে শুরু হয় একটা ছন্দময় আলোড়ন। যেন ঢেউ জেগে ওঠে সবুজ সমুদ্রে। ইচ্ছে করে সে ঢেউয়ের আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়ি সবুজ সমুদ্রে; সাঁতরে সাঁতরে পৌঁছে যাই দূরের দিগন্ত রেখায়।
বাতাস পড়ে গেলে ঢেউ থেমে যায়। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ সমুদ্র এখন স্থির শান্ত। কোথাও এতটুকু আলোড়ন নেই। এই নিরাকপড়া সমুদ্রে চোখে পড়ে সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিভীষিকা। পাটের পাতাগুলো প্রায় প্রতিটিই পোকায় খাওয়া। কোনটা পুরো খাওয়া, কোনটা আধখাওয়া। পোকাগুলো ভীষণ শিল্পিত উপায়ে খেয়েছে সেগুলো। পাতার শিরাগুলো ঠিকঠাক আছে। সবুজ অংশটা শুধু উধাও। যেন পাতার কঙ্কাল।
আধা খাওয়া পাতাগুলোর নিচে নিচে ঝুলে আছে সেই শিল্পি পোকাগুলো। পশমে ভরা ছোট্ট হলুদ শরীর। মাথার দিকটা একটু কালো। বিভীষিকাময় সৌন্দর্য। স্থানীয় ভাষায় এগুলোর নাম 'ছ্যাঙ্গা'। ভালো নাম জানিনা। পাটের দিন এলে এগুলোর উৎপাত বেড়ে যায়।
বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখি পাটের গোড়ার অতিরিক্ত শিকড়ে (মেজায়) অসংখ্য চিংড়ি মাছ। আমরা বলি 'ইছা মাছ'। ইছা মাছের লোভে আমরা তিনজন বিলে নেমে পড়তে চাই। পরক্ষণেই ছ্যাঙ্গার কথা মনে পড়ে। ভয়ে বিলের পাড়েই দাঁড়িয়ে থাকি। অতৃপ্তই থেকে যায় আকাঙ্ক্ষা।
আশ্চর্য! যে ছ্যাঙ্গার ভয়ে আমরা এত বড় বড় (!) তিনজন মানুষ কুপোকাত, সেই বিভীষিকাময় সৌন্দর্যের লোভেই বিলে নেমে আসে নানা প্রজাতির ঝাঁক ঝাঁক পাখি। কোনটা পরিচিত, নাম জানা। কোনটা নাম না জানা, অপরিচিত। পরিচিতদের মধ্যে আছে টুনটুনি, দোয়েল, বুলবুলি।
পাখিগুলো গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায় পোকার সন্ধানে। আমাদের কাছে যা ভয় ও বিভীষিকা, তাদের কাছে সেগুলোই পরম প্রিয় আহার্য। আমরা বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে পাখিদের কলকালি মুগ্ধ হয়ে শুনি। শুনে আরো বেশি মুগ্ধ হই। অনিমেষ নয়নে তাদের উড়াউড়ি, কাড়াকাড়ি দেখি।
টুনটুনিকে আমরা বলি 'হওত্তা টুনি'। এ নামের ঠিক কী কারণ তা আমরা জানি না। জানতে চাইও না। আমরা বরং সন্ধান জানতে চাই। একটা হওত্তা টুনির বাসার সন্ধান। বিলে এত টুনটুনির উড়াউড়ি — এগুলোর কী বাসা নেই? আমাদের মনের দৃঢ় প্রত্যয়, বাসা তো অবশ্যই আছে। কিন্তু কোথায় সে বাসা? তিনজনের মনে একই জিজ্ঞাসা। পথের ধারে, পুকুর পাড়ে, বাড়ির বাগানে সব বড় পাতার ছোট গাছ খোঁজে দেখি। বিশেষ করে 'বগই গাছ'। বাসা বানাতে 'বগই গাছ' টুনটুনির বিশেষ পছন্দ। বড় বড় দুটি বগই পাতা এক সাথে জুড়ে তারা তাদের টুনটুনি প্রাসাদ গড়ে তুলে। খুঁজতে খুঁজতে মাঝেমাঝে পেয়ে যাই দু একটা বাসা। সেগুলোর কোনটায় ডিম থাকে, কোনটায় থাকে ছোট ছোট ছা। পাখির ছা আমাদের ভীষণ প্রিয়। ইচ্ছে করে সেগুলো তুলে নিয়ে আসি। কাছে রেখে আদর করে পুষি। খাবার খাওয়াই। যত্ন নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়ে আসি না। নিয়ে আসিনা কারণ, বাসা থেকে পাখির ছা ধরে নিয়ে আসা মা পছন্দ করেন না।
অনেকগুলো দোয়েলও আসে পোকার সন্ধানে। এক জোড়া দোয়েলকে আমাদের দোয়েল জোড়ার মতো মনে হয়। আমাদের চৌচালা টিনের ঘরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা সুপারি গাছ। গাছটায় কাঠঠোকরার বানানো একটা ছোট্ট গর্ত। সে গর্তে বাসা বেঁধে বাস করে এক জোড়া দোয়েল। দীর্ঘদিন থেকে তারা এখানে বাস করে। যেন আমাদের পোষা। খুব সকালে ডাকাডাকি করে বাড়িটা মুখর করে তোলে। মা যখন বাড়ির হাঁস মুরগি গুলোকে খাবার দেন, ওরাও নেমে আসে আসে গাছ থেকে। খাবার খায় সবার সাথে। আবার আমাদের খাওয়া শেষে টেবিলে যে এঁটো কাঁটা পড়ে থাকে, কখনো সখনো টেবিলে বসে সেগুলো খুঁটে খায়।
নাজমুল আর ফারুককে বলি, ঐ দেখ, আমাদের দোয়েলরাও পোকা খেতে বিলে আসে। ওরা হাসে। বলে, ওটা যে তোদের দোয়েল কীসে তা বুঝা যায়? আমিও হাসি। কিছু বলি না। নাজমুল বলে ওটা তোদের দোয়েল হতেও পারে, আসলে সব দোয়েলই দেখতে এক রকম। কী জানি! হয়ত হবে।
সন্ধ্যা নেমে আসে। সূর্য অস্তাচলে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। আমরা তিনজনও ওঠে পড়ি। পা বাড়াই যে যার বাড়ির পথে। পিছনে পড়ে থাকে আমাদের শৈশবের সারল্য ভরা সোনালী বিকেল।
এনটি