।।শামস আরেফিন।।
“বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ: মিথ বনাম বাস্তবতা” বইটি কবি ও গবেষক মূসা আল হাফিজের অনবদ্য রচনা। এখানে লেখক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন- মুসলিম বিজয়ের ফলে যদি অন্ধকারই নেমে আসে বাংলা সাহিত্যে, তবে প্রশ্ন আসে মুসলিম বিজয়ের আগে কেমন বাংলা সাহিত্যসম্ভার ছিল? এর উত্তর হচ্ছে বাংলা তখনও জনসাধারণের ভাষা কথ্যরূপে ব্যবহৃত হত।
আর সংস্কৃত তখন লেখ্যরূপ পায়। তখন সেন রাজাদের শাসনামলে বাংলায় বেদ পড়ার অনুমতি পর্যন্ত দিতেন না ব্রাহ্মণরা। তাই সহজেই বুঝা যায়- বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ মূলত মূসলিমদের শাসনামলে বিকশিত হয়। কারণ এর পূর্বে তো ভাষা বলতে সভ্য সমাজ সংস্কৃতকে বুঝত। তাই বাংলায় মুসলিম অভ্যুত্থানের আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অস্তিত্ব স্পষ্ট ছিল বলা দুরূহ।
তিনি ঐতিহাসিক সূত্র উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন- সেন রাজাদের অন্যতম কীর্তি ছিল বাংলার জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে এ দেশে সংস্কৃতভাষার অনুশীলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। মুসলিম শাসনামলে সংখ্যালগু হয়েও মুসলিম সম্প্রদায় কীভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে এই উপমহাদেশে শাসন করেছিলেন, তা উল্লেখ করেছেন।
অথচ বৃটিশ শাসনামলে এই মুসলিমরাই ছিল সংখ্যাগুরু। পাশাপাশি একজন প্রকৃত গবেষকের মতো প্রশ্ন তুলে বলেছেন- মুসলিম বিজয়ের কারণে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বা তুর্কিরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস করেননি। কারণ (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) সেনাপতি মিহিরাকুলার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানরা নালন্দা আক্রমণ করে।
এরপর প্রতাপশালী শাসক শশাঙ্ক বৌদ্ধ রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্নিদগ্ধ করেন। এভাবে তিনি তুর্কিদের তথা মুসলমানদের উপর মিথ্যা দোষ চাপানোর ইতিহাস রচয়িতাদের মুখোশ উন্মোচন করেন।
কবি মূসা আল হাফিজ গবেষক হিসেবে হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন- বাংলায় মুসলিম শাসনামলের পূর্বে সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক ব্রাহ্মণরা বাংলাকে তাচ্ছিল্য করে বলতো অপভ্রংশ বা মূর্খ ও সংস্কৃতিহীন মানুষের ভাষা। অর্থাৎ যাদের কোন রুচিবোধ বা সংস্কৃতি নেই, তাদেরই এই ভাষা হতে পারে।
তারা এই ভাষার অস্তিত্ব স্বীকার করা হতো লোকভাষা বলে যার কোন লেখ্য রূপ থাকতে পারে না।
পাশাপাশি শাসক শ্রেণিরভাষা যেহেতু ছিল সংস্কৃত, তাই বাংলা হারায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। মুসলিম শাসনামলে ফার্সি হয় দরবার বা শাসকদের ভাষা। আর যেহেতু এ অঞ্চলের জনসাধারণের ভাষা বাংলা, তাই তাদের সাথে যোগাযোগ ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য হলেও মুসলিম শাসকদের বাংলা শিখতে হয়।
আর নিজেদের সংস্কৃতি বা সাহিত্য বাংলা ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছাকাছি যাওয়ার প্রয়োজনও হয়। স্থানীয়ভাষা ও সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহিত করে মুসলিম শাসক দলিত হিন্দু ও অচ্ছুৎদের সমাজের মূলস্রোতে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেন। তাই মুসলিম শাসনামলকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা কতটা যৌক্তিক?
তিনি বাংলাসাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার মতামত “১২০১ হইতে ১৩৫২ পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার বা সন্ধিযুগ” এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেন। একজন প্রকৃত গবেষকের দায়িত্ব হচ্ছে নতুন কিছু আবিষ্কার করা। নতুন কিছু সৃষ্টি করা মানেই পুরাতন কিছুকে ধ্বংস করা বা চ্যালেঞ্জ করা।
আর তা যথাযথভাবে করতে পেরেছেন বলে বই পড়ে পাঠকের মনে হবে। তিনি ড. আহমদ শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- সাহিত্যের নিদর্শন না পেলেই যে তা বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ, তা বলা যায়না। কারণ তুর্কি বিজয়ের পূর্বে বাংলা ভাষা শাসন ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের প্রয়োজন হয়নি। ফলত হিন্দু বা মুসলমান বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ পায়নি।
তাই প্রথম যে মুসলিমদের আমলে এই বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ সৃষ্টি হয়, সে মুসলিম শাসনামলকে আমরা বাংলা সাহিত্যের অন্ধকারযুগ বলতে পারিনা। বরং বলা সমীচিন হবে- বাংলা ভাষার আদিরূপ গঠনে প্রধান ভূমিকা এই মুসলিম শাসকদের। তাই সহজেই উপসংহার টানা যেতে পারে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির আমলে শুধু সেন রাজাদের সিংহাসন হারায়নি বরং সংস্কৃততার একচ্ছত্র আধিপত্য হারিয়েছে।
কথ্যরূপ বাংলার লেখ্যরূপ বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয় মুসলিম শাসনামলের প্রথমদিকে।সুলতান আলী মর্দান খিলজি (১২১০-১২১২) সংস্কৃত যোগশাস্ত্র ‘অমৃতকুণ্ড’-এর অনুবাদ করতে উদ্যোগী হন বাংলায়। তাই সান্ধ্য ভাষার বা আলোআধারী ভাষার সময়কালে মুসলিম বিজয়ের মাধ্যমে নিজের অবয়ব উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
অন্ধকার যুগ বললেও এর মধ্য থেকে আলোর স্ফূরণ ঘটেছে, আমাদের এই সত্য স্বীকার করা প্রয়োজন। তাই সাধারণ পাঠক ও গবেষকগণ এই সময়কালকে বাংলাভাষার আদিযুগ হিসেবে জানতে পারেন।
সাহিত্যের রাজনীতি বা সংস্কৃতির রাজনীতি একটি চিরন্তন সত্য এই উপমহাদেশে। উপমহাদেশের সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের সনাতনিগণ।তাদেরই পূর্বপুরুষগণ এই সেন বংশের রাজা ও রাজাদের নৈকট্যলাভকারী পুরোহিত।
তাই সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করার জন্য এই পুরোহিত বা উচ্চবর্ণের সনতনীরা যেমন সচেতন ছিলেন অতীতে। ঠিক তেমনি তাদের পরবর্তী বংশধরগণ ও সংস্কৃত ভাষার কালিমা ঢাকতে বা সংস্কৃত চর্চাকারীদের কালিমা ঢাকতে মুসলিম শাসকদের দোষারোপ করার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করেছেন- ইতিহাসের পটপরিবর্তনের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে।
তাই মুসলিম তথা তুর্কিদের দোষারোপ উচ্চবর্ণের ভূত বা সাহিত্যিকও ঐতিহাসিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস।এই সত্য পাঠকের সম্মুখে কবি মূসা আল হাফিজ আবিষ্কার করতে পেরেছেন বলে তাকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ। বিশেষত অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ না জানালেই নয়। কারণ "বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ: মিথ বনাম বাস্তবতা" বইটি দীর্ঘকাল ধরে একটি আরোপিত ইতিহাসের মুখোশ উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে।
-কেএল