আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ভাষার জরিপ প্রকাশকারী সংস্থা ‘অ্যাথনোলোগ’-এর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী পৃথিবীতে মোট ভাষা রয়েছে ৭ হাজার ৯৯টি। শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে বাংলাভাষার অবস্থান সপ্তম!
‘৪৭-এ ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তানিরা যখন আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো, ওলামায়েকেরামও তখন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
মিছিল-মিটিং-সমাবেশ করেছিলেন। সরকারকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। এ সময় আলেমদের রাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এর ঐতিহাসিক ও অন্যতম দাবিই ছিলো, “বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক।”
উত্তাল সেই সময়ে ওলামায়েকেরাম শুধু এটিকে দাবি হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখেননি; দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অনেক কাজও করেন। মানুষকে তাঁরা সচেতন করে তোলেন। বয়ান-বক্তৃতায় আলোচনা করতেন এবং হাটে-ঘাটে, স্কুল-মাদরাসায় মিটিং পথসভা করে জাতিকে বোঝাতেন মাতৃভাষার গুরুত্ব।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত কবে, কীভাবে, কাদের মাধ্যমে বা কোন নেতৃত্বে বেগবান হয়েছিলো তা আজ অনেকেরই অজানা। ভাষা আন্দোলনের ডামাডোলে আজ হারিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস ও মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর কথা। হারিয়ে গেছেন মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা ভাসানী ও তর্কবাগীশরাও।
একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে ঐতিহাসিক বইয়ের লেখক সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি তাঁর নিপুণ আঁচড়ে তুলে এনেছেন হারিয়ে যাওয়া সেসব গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। সীমাহীন ধৈর্য আর আকাশসম মনোবল নিয়ে শয়ে শয়ে বই ঘেটে সেগুলোর সমন্বয় করেছেন তিনি এ বইটিতে। লিখেছেন মাওলানা মাসউদুর রহমান।
ফারুক হাসান বইটির বিষয়ে লিখেছেন
প্রথমে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি শাহোশি ভাইকে৷ মাতৃভাষার প্রতি গভীর প্রেম তাঁকে অগাধ শ্রম ও প্রবল বিসৰ্জনে উজ্জীবিত করেছে৷ যার উৎপন্ন ফসল "একুশের মাওলানারা"৷
একুশের মাওলানারা৷ লোমহৰ্ষক গ্রন্থ৷ বাংলা ভাষার প্রতি আলেমদের যে অবদান-আয়োজন, তা দেখে আমি বিস্মিত ও গৰ্বিত৷ আমি বাঙালি বলে গৰ্ববোধ ও সুখবোধ আমার অন্তকরণকে যতটুকু আলোড়িত করে, ঠিক ততটুকুই আমি ভীতু হয়ে যাই এই ভেবে যে, আমি মাওলানা৷ আর এই দেশ ও দেশের ভাষা-ঐতিহ্যে মাওলানাদের কোনো অবদান নেই৷ কিন্তু এখন দেখছি— মাওলানাদের অবদান আছি; স্বীকৃতি নেই, ত্যাগ আছে; আলোচনা নেই, আন্দোলন-সংগ্রাম আছে; তবু তাদের কোনো নাম নেই৷ এই দেশের জন্য, দেশের মাটি ও ভাষার জন্য মাওলানাদের বিরাট ভুমিকা রয়েছে— এখন এটাই প্রতিভাত হল৷ আর এটাই চিরন্তন সত্য হয়ে সবসময় জীবন্ত রবে৷ কারণ, আমার গ্রন্থ সরোবরে উক্ত দাবির পক্ষে তথ্যনিৰ্ভর এই বইটি আছে৷
আমি হতবাক৷ বিস্ময়াভূত দৃষ্টি নিয়ে কয়েকবার পড়েছি দীৰ্ঘ কলেবরের বইটির ২৩ তম পৃষ্ঠার "একুশের মাওলানা" শিরোনামের বৰ্ণনাটি৷ পড়েছি৷ চিত্তবিহ্বল গৰ্ব অনুভব করেছি৷ হারানো ইতিহাস ফিরে পাওয়ার স্বাদ কেমন, তা এইমাত্র গ্রহণ করেছি৷
ভাষার ভিন্নতা আল্লাহর অপার দান৷ মাতৃভাষার প্রতি আবেগ সহজাত সুন্দর মননের উৎকৰ্ষ প্রতীক৷ বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা৷ এই ভাষায় কথা বলে আমাদের মা এবং কচি শিশু; বাবা এবং অশীতিপর দাড়িপাকা বৃদ্ধ দাদা৷ বাংলা আমার ভাষা; যে ভাষায় আমি কাঁদি ও হাসি এবং প্রকাশের বালিয়াড়িতে খুব সুন্দর করে মনের অনুভূতি-উপলব্ধি ছড়াই৷
আমি যখন আঞ্চলিক ভাষায় বিরক্তি ঝাড়ি কিংবা আনন্দের অভিব্যক্তি প্রকাশ করি, তখন খুব মধুর লাগে৷ বলতে পারায় এবং লিখতে পারায় যে তৃপ্তি, মাতৃভাষায় বলে ও লিখে সে তৃপ্তি আমি লাভ করি৷ আমার ভাষা আমার কাছে সঙ্গিতের মতো মনে হয়৷ কেমন সঙ্গিত? যে সঙ্গিতে বাজনা নেই; সুর লহরী আছে, ঝাঁঝালো সুর নেই; রোমাঞ্চকর অনুরাগ আছে৷
জাতি হিসেবে আমরা উঁচু ও স্বকীয়তাপ্রেমী৷ আমরা আবেগ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, নিবেদিত তাজা রক্ত দিয়ে রক্ষা করেছি আমাদের রাষ্ট্র এবং আমাদের ভাষা৷ গোলাকার পৃথিবীকে বলে দিয়েছি: আমরা আমাদের অধিকার ধরে রাখতে জানি৷
জাতি হিসেবে আমরা অত্যন্ত নিচু ও হীন৷ এটাও চিরন্তন সত্য৷ প্রান্তিকতায় আমরা অন্ধ-বধির-বিকারগ্রস্ত৷ প্রান্তিকতা এমন এক ব্যাধি যে, এতে নিরেট সত্য প্রকাশ হারায়; নিৰ্ভেজাল বাস্তবতা ক্ষুণ্ন হয় আর স্বতস্ফূৰ্ত আয়োজন-অবদান ও আবেগ-প্রেম ব্যথিত হয়ে ঠুকড়ে কাঁদে৷ প্রান্তিকতা বিবাদ বাড়ায়, মিথ্যা ফলায় এবং প্রান্তিকতা নিত্তান্ত অহমিকা মাত্র৷
এই প্রান্তিকতা দেখে আসছি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস-অবদানে৷ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-অবদানেও ঠিক একই প্রান্তিকতা দেখে চোখ ঝলসে যাচ্ছে৷
আমি লক্ষ করেছি— বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-সংগ্রাম বৰ্ণনায় মাওলানা ভাসানীর কথা বৰ্তমানরা মুখেও আনে না৷ অথচ এই মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু৷ বঙ্গবন্ধুর বক্ষে স্বদেশের যে প্রেম, এই প্রেম রোপন করেছেন স্বয়ং মাওলানা ভাসানী৷ বঙ্গবন্ধু তা অকপটে স্বীকার করেছেন৷ কিন্তু বৰ্তমানরা অবাক কোনো কারণে এবং তাঁর পরিচয় "মাওলানা" হওয়ার কারণে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তাঁকে আলোচনায় আনে না৷ স্বীকার করবে কি, নামই নেয় না৷
বৰ্তমানরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে৷ কিন্তু সেখানে উলামা ও পির-মাশায়েখদের যে আত্মপ্রণোদিত উপস্থিতি ছিল, সে অধ্যায়ের কালি মুছে দিয়ে পরবৰ্তী অধ্যায় সাজায়৷
প্রান্তিকতা নামক জলাশয়ের ঠিক একই ধারা চলছে বাংলা ভাষার ইতিহাস ও অবদান নিয়ে৷ শুনে আশ্চৰ্য হবেন যে— এই ভাষার জন্য যারা নিবেদিত ছিলেন এবং প্রথম উদ্যোক্তা ও সোচ্চারকণ্ঠী ছিলেন, তাঁরা সবাই মাওলানা৷
আজ প্রান্তিকতার আধারে ইতিহাসের সত্য পাঠ ও চিরন্তন বাস্তবতা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে৷ স্বীকার করবে কি, আলোচনাতেই আনে না৷ তারা ইতিহাস-অবদানের বিরাট অধ্যায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে রচনা করে ইতিহাস! কী মিথ্যুক!
যে সত্য তারা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তা বাণের স্রোতে তলিয়ে যায়নি৷ ছুড়ে ফেলা প্রতিটি ইতিহাস-পৃষ্ঠা শাহোশি ভাই নিৰ্দ্বিধা সাহস নিয়ে তুলে এনেছেন এবং ইতিহাসের ধারা অক্ষুণ্ন রেখে পৃষ্ঠাগুলোর সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন৷
এই অসাধ্যকে সাধন করতে কৰ্মতৎপরতা আর গভীর পৰ্যবেক্ষণের যতটুকু শক্তি ও শ্রম দরকার ছিল, ঠিক ততটুকু ঢেলে দিয়ে তিনি নিৰ্মাণ করেছেন তথ্যনিৰ্ভর গ্রন্থটি৷ গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পাক— কামনা করি৷
বইটি সম্পর্কে ইশতিয়াক সিদ্দিকী লিখেছেন, ইতিহাস জগতে শাকের হোসাইন শিবলি মানে নতুন কিছু। ভিন্ন কিছু। শেকড় থেকে কিছু...।
মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা নিয়ে সাড়া জাগানো ইতিহাসগ্রন্থের পর এবার শাহোশির নতুন উপহার 'একুশের মাওলানারা'।
ভাষা আন্দোলনের চেপে রাখা ইতিহাস ও দলিলপত্র নিয়ে প্রায় ৮শ পৃষ্ঠার বিশাল আয়োজন। সংগ্রহ করতে পারেন। জানবেন। জানাবেন। ছড়িয়ে যাক আলেম সমাজের গৌরবগাঁথা ইতিহাস।
মাহমুদ তাশফীন লিখেছেন- এটি যদি বই না হয়ে একটি থিসিস হতো আর মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলি হাফি. এ পান্ডুলিপিটি নিয়মতান্ত্রিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গবেষণা বিভাগে জমা দিতেন- তাহলে শাকের হোসাইন শিবলি হাফি. ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করতেন।
তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি সম্ভব হতো কিনা সেটি আপেক্ষিক বিষয়। প্রতিহিংসা শিক্ষা ও মেধার মূল্যায়নে প্রতিবন্ধক হওয়াটা- বাংলাদেশে অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে নিয়মতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়েও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের ঘটনা কম নয়।
এ উপাধি সম্মাননা হিসেবেও দেওয়া হয়। আমরা পাঠকসমাজ আলেম লেখক মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলি ভাইকে ডক্টরেট তথা (ড.) উপাধি দেওয়ার দাবি জানাই।
অদেখা ও চেপে রাখা এক নতুন ইতিহাসকে তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন। তার এ বই হলুদ সাংবাদিকতা ও বিকৃত সংস্কৃতি চর্চার বিরুদ্ধে সাক্ষাৎ চপেটাঘাত।
এর আগে প্রকাশিত তাঁর 'আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে' বইটিও একই ক্যাটাগরির। এ বইটির জন্য তিনি বাংলাদেশের যে কোনো জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।
পুরস্কার কর্তৃপক্ষ যদি একজন আলেম হওয়ার কারণে তাকে পুরস্কার বঞ্চিত করে থাকে তাহলে আমাদের অঙ্গনের কোনো প্রতিষ্ঠানের উচিত তাকেসহ অন্যান্য গুণী লেখকদের প্রতি বছর পুরস্কৃত করার ধারা চালু করা। সেটি লেখকদের কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিতে পারে কিংবা কোনো অভিজাত প্রকাশনী।
শাকের হোসাইন শিবলি
মাহফিল, বিশাল বুক কমপ্লেক্স [২য় তলা] ৩৭ নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৮১৬-৪২৮৭২৭
মূল্য: ১,০০০/ [একহাজার]
-এটি