মাহবুবা সিদ্দিকা।। ভালোবাসা শব্দটি পূত-পবিত্র এবং তা একমাত্র আল্লাহর দান। ভালোবাসা এমন এক অদ্ভূত অনুভূতি, যা মানুষের মনের গহীনে প্রবাহমান থাকে অনন্তকাল।
তাই ভালোবাসার জন্য কোন দিবস-রজনী নিদৃষ্ট নেই। ভালোবাসা সব মাখলুকাতের মাঝে রয়েছে। পরস্পরের মধ্যে আত্মতৃপ্তির প্রীতি স্থাপনের জন্য আল্লাহ প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। ভালোবাসার সৃজন অগাধ বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভালোবাসার কারণেই মমতাময়ী 'মা' গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। পিতা কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
ভালোবাসা তো সদা-সর্বদা সবার জন্য উন্মুক্ত। যেমন; স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-সন্তান,মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন। ভালোবাসা হচ্ছে একে-অন্যের জন্য কল্যাণকর। ভালোবাসার সময় যত দৃঢ় হয় তত মজবুত হয় _ততটাই মূল্যবোধের শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আর এই ভালোবাসা হোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের জন্য। বাবা-মার জন্য। জীবনসঙ্গিনীর জন্য। পাড়া-পড়শীর জন্য। মাযলূমদের জন্য। আর তা আমাদের পৌঁছে নিবে জান্নাত পর্যন্ত। ইন শা আল্লাহ।
কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে কিছু তরুণ-তরুণী থেকে নিয়ে শুরু করে বৃদ্ব-বৃদ্ধা পর্যন্ত_পুত-পবিত্র এই ভালোবাসাটাকে একটা তথাকথিত দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে।
কিন্তু, একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের জানা উচিৎ ছিল যে,এই দিবস শান্তির ধর্ম ইসলাম কখনো সমর্থন করেছে কিনা বা আমি-আপনি একজন মুসলিম হিসেবে এই দিবস পালন করলে কিংবা এই তথাকথিত একটা দিনকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো থেকে নিয়ে অসামাজিক কার্যক্রমে লিপ্ত হলে কোন সাওয়াব/ধর্মীয় ফায়দা আছেকিনা!
কিন্তু না! আমরা বে-খবর হয়ে পশ্চিমা এই অপসংস্কৃতিকে আমাদের সংস্কৃতি বানিয়ে ফেলেছি। অথচ, এই 'বিশ্ব ভালোবাসা দিবস' পশ্চিমা সভ্যতার একটি অংশ। যা ইহুদি খ্রিস্টান থেকে আমাদের পর্যন্ত চলে আসছে।
আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে গেছে। যেমন, আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে পাই_প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেঁতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন।
সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো।একদিন রোমের এক কারা প্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন।
মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তার আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর কারা প্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন মেয়েটিকে। তাতে লেখা ছিল, ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)।
মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল কারণ, ইতোমধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দু’চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ভালবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিনটিকে সেই দেশের মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে।(উইকিপিডিয়া)
যেই দিবসকে কেন্দ্র করে লাখো তরুণী নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলে। সমাজে বেহায়াপনা, বিশৃঙ্খলা, অসামাজিক কার্যক্রমসহ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। কেউবা না বুঝে রেপেরও শীকার হয়। আবার এই দিবসকে কেন্দ্র করে মিডিয়ায় অনেক খুনেরও খোঁজ পাওয়া যায়। সেই দিবস কখনো ইসলাম সমর্থিত ও একজন সচেতন মুসলিমের কাজ হতে পারে না।
সবমিলিয়ে ভালোবাসা দিবসের নামে সমাজে জিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ ও খুন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। হাদীস শরীফে এসেছে: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা,) বলেন; 'যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিনা-ব্যভিচার ব্যাপক হবে, তাদের মধ্যে দুরারোগ্য ব্যধি ও মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে দেখা দেবে'।
পরিশেষে বলতে চাই_নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করছে। অশ্লীলতা-নোংরামিতে ভরপুর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপনের নামে এমন বেহায়াপনা কর্মকাণ্ড কখনও ইসলাম সমর্থন করে না।
গর্হিত অশ্লীল বিনোদন উদযাপন করা ইসলামে মহাপাপ। কাজেই এসব অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। যারা ঈমানদারদের সমাজে এ ধরণের অশ্লীলতার বিস্তার ঘটায়, তাদের পরিণাম ভয়াবহ হবে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন; 'যারা মু'মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি' (সূরা আন-নুরঃ ১৯)
তাই একজন মুসলিম ও মুসলিমাহ হিসেবে আমি-আপনি ভিন্ন ধর্মের এই অপসংস্কৃতিকে নিজের ধর্মে পালন করা এবং এটাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া বোকামির নামান্তর এবং তা নিতান্তই আল্লাহর সাথে নাফরমানি করা। নিজের গুনাহের ভাণ্ডার সমৃদ্বি করা। একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে আমরা কখনো এই কাজ করতে পারি না।
সর্বস্ব, ভালোবাসা দিবস পালনের কুসংস্কার থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে ইসলামের নির্দেশিত পন্থায় চারিত্রিক মাধূর্যতা ও পবিত্র ভালোবাসা অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে তৌফিক দান করেন। আমীন।
লেখিকা: আলেমা ও প্রাবন্ধিক।
-এটি