মুফতি হোসাইন আহমদ জাবের।।
হযরত সালমান ফার্সী রা. তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা নিজেই বর্ণনা করেছেন। ফারেসের (পারস্য) ইস্পাহানের জাই নামক গ্রামে আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন অগ্নিপূজক। আমাদের বাড়ীর পাশে খ্রিস্টানদের একটি গীর্জা ছিলো। আমি একদিন হাঁটতে হাঁটতে গীর্জায় গেলাম। তাদের ইবাদত আমাকে খুবই মুগ্ধ করলো।
আমি তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের ধর্মের কেন্দ্র কোথায়? তারা বললো, শামে। আমি তাদের সাথে কিছু সময় কাটালাম। বাসায় ফিরার পর আমার পিতা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলে?
আমি বললাম, খ্রিস্টানদের গীর্জায়। তাদের ইবাদত আমার খুবই ভালো লেগেছে। বাবা বললেন, তাদের ধর্ম সঠিক নয়। আমরা যে ধর্ম পালন করছি সেটাই সঠিক। তাদের ধর্মের প্রতি অতি আকৃষ্ট দেখে বাবা আমাকে শিকল দ্বারা বন্দী করে রাখলেন। বন্দী অবস্থায় আমি পাদ্রীকে চিঠির মাধ্যমে জানালাম, যদি কোনো বণিক দল শামে যায় তাহলে আমাকে জানাবেন।
কয়েকদিন পরে তারা আমাকে একটা বণিক দলের কথা জানালো। আমি তাদের সাথে ‘শামে’ চলে গেলাম। শামের সবচেয়ে বড় গীর্জায় আমি অবস্থান করলাম। গীর্জার পাদ্রীর পরামর্শ মোতাবেক ইবাদত করতে লাগলাম। তবে পাদ্রীর চাল-চলন আমার কাছে একটু অন্য রকম মনে হলো। কিছুদিন পরে পাদ্রী মারা গেলো।
লোকেরা তাকে দাফন করতে এলে আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা গরিব-দুঃখীদের জন্য পাদ্রীর কাছে যে সদাকাহ দিতে, তা সে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিত না বরং নিজের কাছে রেখে দিত’। লোকেরা আমার কথা বিশ্বাস করলো না। আমি তাদের বললাম, ‘যদি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস না করো তবে ঐ জায়গাটা খুঁড়ে দেখো’।
তারা ঐ জায়গা খুঁড়ে দেখলো, সেখানে সাত কলস স্বর্ণ-মুদ্রা পুঁতে রাখা হয়েছে। তারা ক্ষীপ্ত হয়ে পাদ্রীকে দাপন করলো না বরং তাকে শূলে চড়িয়ে পাথর মেরে ফেলে দিলো। ঐ গীর্জায় তার স্থানে নতুন একজন পাদ্রী এলেন। তিনি অবশ্য খুব ভালে ছিলেন।তার কাছ থেকে আমি বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা নিতে লাগলাম এবং তার পরামর্শ মোতাবেক ইবাদত করতে লাগলাম।
কিছুদিন পর তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মৃত্যুর পরে আমি কোথায় যাবো? কার কাছে থাকবো? তিনি বললেন,আমি এই শামে এখন কোন ভালো পাদ্রী নেই। তুমি মুসল (ইরাক) চলে যাও, সেখানে একজন ভালো পাদ্রী আছে।
তার মৃত্যুর পরে আমি মুসল (ইরাকে) চলে গেলাম। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর ওই পাদ্রীও মৃত্যু শয্যায় শায়িত হলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখন কোথায় যাবো? তিনি বললেন, আমাদের এই মুসলে এখন কোনো ভালো পাদ্রী নেই।তুমি নসিবীন (তুরস্ক) চলে যাও। আমি নসিবীন (তুরস্ক) গেলাম। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ওই পাদ্রীও অন্তিম ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখন কোথায় যাবো? তিনি বললেন, আমাদের নসিবীনে এখন কোনো ভালো পাদ্রী নেই। তুমি আম্মরিয়া (গ্রীস) চলে যাও। আমি আম্মুরিয়া (গ্রীস) পথে পাড়ি জমালাম। সেখানে কিছুদিন থাকার হওয়ার পরে আম্মুরিয়ার পাদ্রীও পরকাল গমনের পথ ধরলেন। আমি তাকে বললাম, আমি এখন কোথায় যাবো? তিনি বললেন, তুমি এখন আরব চলে যাও, সেখানে একজন নতুন নবীর আগামন হবে।
আমি বললাম, আমি তাকে চিনবো কিভাবে?
তিনি বললেন, তিনি হাদিয়া গ্রহন করবেন এবং খাবেন। সদকাহ গ্রহন করবেন কিন্তু খাবেন না। তাঁর পিঠে নবুওয়াতের সীলমোহর থাকবে।
আমার নিকট কিছু স্বর্ণ-মুদ্রা ছিলো। আমি আরবগামী এক বণিকদলকে বললাম, আমার নিকট কিছু স্বর্ণ-মুদ্রা আছে, তোমরা এগুলো নিয়ে নাও এবং আমাকে তোমাদের সঙ্গী বানাও। তারা তাদের প্রস্তাবে রাজি হলো। আরবে পৌছার পরে তারা আমাকে ওয়াদিয়ুল কুরা'র এক ইহুদির নিকট আমাকে বিক্রি করে দিলো। আমি তার নিকট কিছুদিন থাকলাম। অতঃপর মদীনা থেকে তার এক চাচাতো ভাই এলো। সে বনূকুরাইযা গোত্রের লোক ছিলো।
সে আমাকে ক্রয় করে মদিনা নিয়ে এলো। এখানে আমি কাজ করতে লাগলাম। একদিন আমি খেজুর গাছের উপরে কাজ করছিলাম। এমন সময় আমার মালিকের নিকট এক ব্যক্তি এলো এবং বলতে লাগলো বনূ কাইলাহ ধ্বংস হোক। তারা মক্কা থেকে এমন ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছে যে নিজেকে নবী দাবী করে। সে এখন “কূবায়" অবস্থান করছে।
একথা শুনা মাত্রই আমি গাছ থেকে লাফিয়ে নিচে নামলাম। তাকে জিজ্ঞেস, করলাম কী বললেন ভাই! আরেকবার বলুন তো!আমার আগ্রহ দেখে মনিব আমাকে চড় মারলেন। আমি চুপ হয়ে গেলাম এবং সুযোগ মতো কূবার দিকে রওনা দিলাম।কূবায় পৌছে রাসূল সা. কে কিছু জিনিস দিলাম এবং বললাম, আপনার নিকট অনেক অসহায় মানুষ আছে। তাদের জন্য কিছু সদকাহ নিয়ে আসলাম।
রাসূল গ্রহন করলেন, এবং যারা অসহায় তাদের মাঝে বিতরণ করে দিলেন কিন্তু নিজে খেলেন না। আমি একটি শর্ত পেয়ে গেলাম। পরেরবার আমি আরো কিছু জিনিস নিয়ে রাসূল সা. এর নিকট গেলাম। তখন তিনি মদীনা লয়ে অবস্থান করছেন। আমি বললাম, আপনার জন্য কিছু হাদিয়া নিয়ে আসলাম। রাসূল সা. তা গ্রহন করলেন। অন্যদের দিলেন এবং নিজেও খেলেন। আমি দ্বিতীয় শর্তটি পেয়ে গেলাম। তৃতীয়বার যখন আমি রাসূল সা. এর নিকট গেলাম তখন তিনি এক সাহাবী রা. এর দাফনের কাজে ব্যস্ত। আমি বার বার উঁকি মেরে তাঁর পিঠের দিকে তাকাচ্ছিলাম। রাসূল সা. আমার মনোভাব বুঝতে পেরে পিঠ থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন। আমি তাঁর পিঠে নবুওয়াতের সীলমোহর দেখতে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। আমার দু-চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। আমি দৌড়ে গিয়ে রাসুল সা. এর সীলমোহরে চুমু খেলাম।
রাসূল সা. আমার পুরো ঘটনা শুনলেন এবং আমার মনিবের সঙ্গে চুক্তি করতে বললেন। আমি মনিবের সঙ্গে চুক্তি করলাম। রাসূল সা. তা সাহাবীগন কে শুনালে সাহাবীগন তা পরিশোধ করে দিলেন। আমি রাসূল সা. এর নিকট চলে আসলাম। তখন বদর ও উহুদ শেষ হয়ে গেছে। আমি খন্দকে অংশগ্রহণ করলাম এবং আল্লাহর নবী সা. এর জীবদ্দশায় সংগঠিত অন্যান্য জিহাদে শরীক হলাম।– মুসনাদে আহমদ, খন্ড –১৭ পৃষ্ঠা ৯৫, হাদীস নং– ৩২৬২৭।
লেখক: সংকলক ,তাকরীরে মুসলিম শরহে সহীহ মুসলিম।
-এএ