নুরুদ্দীন তাসলিম।।
গত ১ জানুয়ারি বেফাকের পক্ষ থেকে বোর্ডের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আগামী ৯ মার্চ (৫ শাবান) শুরু হতে যাচ্ছে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। দিনের হিসেবে কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আর বাকি রয়েছে মাত্র ১ মাস ২৩ দিন।
গত দু'বছর কওমি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি
করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে গত দু'বছর কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সময়মত পরীক্ষা দিতে পারেনি। বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাদের। করোনা পরিস্থিতির কারণে একবার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল রমজানের পর। নতুন বছর শুরু করতে অনেক দিন সময় নষ্ট হয়েছিলো। এতে করে শিক্ষাবর্ষের সিলেবাস শেষ করতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বেশ ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
পরবর্তীতে ২০২১-এর মার্চের শেষের দিকে সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা বিধিনিষেধ চালু করা হলে আবারো বন্ধ হয়ে যায় কওমি মাদ্রাসাগুলো। এতে করে বোর্ড পরীক্ষার্থীদের আরো একবার ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অল্প সময়ের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ করার উদ্যোগ নেয় বোর্ড, এতে গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টগুলোর দু’টো পরীক্ষা একই দিনে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। যা অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল শিক্ষার্থীদের মাঝে।
চলতি বছরের শিক্ষাবর্ষ প্রায় ৬ মাস পর শুরু হলেও বর্তমানে করোনা মহামারীর পাশাপাশি দেশে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির নতুন ধরণ অমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যেই গত কয়েকদিন ধরে বাড়তে শুরু করেছে করোনা শনাক্তের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২২২ জন। এতে করে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
‘পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে’
সরকার এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত না নিলেও শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি বলেছেন, ‘পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে’।
এদিকে এক মাস ২৩ দিন বাকি রয়েছে কওমি মাদরাসাগুলোর কেন্দ্রীয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার। অধিকাংশ জায়গায় বুখারী খতমের আয়োজন করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ইতোমধ্যে বুখারি খতম শেষ বলেও জানা গেছে। খেয়ারের প্রস্তুতির আগমুহূর্ত চলছে মাদ্রসাগুলোতে।
এরমধ্যে হঠাৎ সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে গেলে গত দুই বছরের মতো এবারও ভোগান্তির শিকার হতে হবে শিক্ষার্থীদের। তাই খেয়ার ও শেষ মুহূর্তের ক্লাস কমিয়ে পরীক্ষা এগিয়ে নেওয়া যায় কিনা এ বিষয়ে শিক্ষাবিদদের মতামত ও ভাবনা জানার চেষ্টা করেছে আওয়ার ইসলাম।
পরীক্ষা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কী ভাবছেন শিক্ষাবিদরা?
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী নাজেমে তা'লীমাত মাওলানা মুহাম্মদ ওমর মেখলী বলেছেন, আপাতত স্বাভাবিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে হাটহাজারী মাদরাসার পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করা হয়েছে ৯ মার্চ (৫শাবান) থেকে। পরিস্থিতি বেগতিক হলে তাৎক্ষণিক সবকিছু পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে পরীক্ষা এগিয়ে অথবা পিছিয়ে নেওয়ার বিষয়ে। চলমান পরিস্থিতির বাইরে অগ্রিম কিছু ভাবার অথবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন মতামত দেননি তিনি।
তিনি বলেছেন, আপাতত স্বাভাবিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তই ঠিক আছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় ভিন্ন কিছু হতে পারে, সেটা পরবর্তীতে দেখা যাবে।
এদিকে রাজধানীর জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়ার নাজেমে তা'লীমাত মুফতি আশরাফুজ্জামান বলেছেন, এমনিতেই শিক্ষাবর্ষের দীর্ঘ একটা পার হওয়ার পর শুরু হয়েছিল নতুন শিক্ষা কার্যক্রম। এরমধ্যে অনেক তাড়াহুড়া করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস এগিয়ে নিতে। নতুন করে পরীক্ষা এগিয়ে নিলে বেশ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে শিক্ষার্থীদের। তাই পরীক্ষা এগিয়ে না নেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন এই শিক্ষাবিদ।
তিনি বলছেন, ’গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কারণেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। খেয়ার কমিয়েও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতে হয়েছে। এখন যখন শিক্ষাবর্ষের প্রায় ছয় মাসের মত সময় আমরা পাইনি, তখন পরীক্ষা এগিয়ে নিলে আরো বেশি ক্ষতি হবে’ বলেন তিনি।
ঠিক একই রকম মতামত দিয়েছেন ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মুফতি মকবুল হোসাইন। তার কথায় উঠে এসেছে প্রায় ছয় মাসের মত বিলম্বে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর বিষয়টি।
তিনি বলেছেন,‘ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা বলা মুশকিল। তবে অনিশ্চিত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে পরীক্ষা এগিয়ে নেয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে’।
তিনি আরো যুক্ত করেছেন, ‘আমরা বর্তমানে যে শিক্ষাবর্ষ পার করছি তা শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ ছয় মাস পরে। পরিস্থিতির কারণে যদি এবার রমজানের আগে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে রমজানের পরে আমরা পরীক্ষা নিব এবং আগামী শিক্ষাবর্ষটা আরো কিছুটা দেরিতে শুরু হতে পারে’।
রমজানের পরে পরীক্ষার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর তাখাস্সুছে ভর্তি, দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া, আগামীতে কি করবে- ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও বেশ ভোগান্তির শিকার হতে হয়-
এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘এটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে এবং এমন হলে তা সত্যিই দুঃখজনক হবে। কিন্তু তাই বলে যেখানে শিক্ষাবর্ষের অনেকগুলো দিন কম পাওয়া গেছে। সেখানে পরীক্ষাএগিয়ে আনাটা সমীচীন হবে না’।
এদিকে রাজধানীর জামিয়া কারিমিয়া রামপুরার শিক্ষা সচিব মুফতী হেমায়েতুল্লাহর কথায় কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া গেছে।
তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবারই ভোগান্তিতে পড়তে হবে। তাই পরিস্থিতি যদি একান্তই খারাপের দিকে যায় এবং ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নিতে চায় তাহলে পরীক্ষা এগিয়ে নেওয়াটাই ঠিক হবে। বিগত বছরের মতো রমজানের পরে পরীক্ষা অথবা অল্প সময়ে একদিনে গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টের ২ টি পরীক্ষা নেওয়ার মত পরিস্থিতির দিকে না যাওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন তিনি।
পরীক্ষা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কী বলছে বেফাক?
এ বিষয়ে বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মাওলানা জুবায়ের আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, সাম্প্রতিক কয়েক দিনের পরিস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষা এগিয়ে নেয়া হবে কিনা এমন একটি আলোচনা বিভিন্ন মহল থেকে উঠছে। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এখনো কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
‘আর কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এ বিষয়ে উপযোগী কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন মুরুব্বীরা। তবে এখনই মুরুব্বীদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অগ্রিম কোনো পদক্ষেপ অথবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা নেই’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘হঠাৎ অগ্রিম কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হলে পরবর্তীতে যদি পরিস্থিতি ঠিক থাকে তাহলে রমজানের আগের সময়টা খালি পড়ে থাকবে, তখন এক ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতি হবে। তাই পরীক্ষা এগিয়ে নেয়া হবে কিনা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরো কিছুদিন সময় নিতে চান বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, গত দু'বছরে সময়মতো পরীক্ষা দিতে পারেননি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। এতে করে বেশ ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছিল তাদের। অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়েছেন, কেউবা ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন, রমজানকে ঘিরে তারবির বিষয়টিতেও হাফেজদের মাঝে তৈরি হয়েছিল শঙ্কা।
বিধি নিষেধ অমান্য করলে লকডাউনের হুঁশিয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
এদিকে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে শুরু হতে যাওয়া একুশে বই মেলা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৫ দিন। এদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মেলা আরো পিছিয়ে শুরু হতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আরো ১১ দফা বিধি-নিষেধ চালু করা হয়েছে। এরইমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন বিধি নিষেধ অমান্য করলে দেওয়া হতে পারে লকডাউন।
করোনা পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় বন্ধ হয় কওমি মাদরাসা
উল্লেখ্য, দেশে করনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের মার্চে বন্ধ করা হয় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রায় দেড় বছর বন্ধের পর এরপর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সারা দেশে একযোগে খুলে দেওয়া হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এছাড়া ১৫ অক্টোবরের পর ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্তের কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী। তবে ২০২০ সালেল জুলাই মাসেই খুলে যায় দেশের হেফজ বিভাগগুলো এরপর আগষ্টে খুলে কওমি মাদ্রাসাগুলোর কিতাব বিভাগ। এর প্রায় ৭ মাস পর ২০২১ সালের মার্চের শেষ দিকে সরকারের পক্ষ থেকে আবারো ১৮ দফা নির্দেশানা জারি করা হলে প্রায় ছয় মাস পর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খুলে যায় কওমি মাদ্রাসা।
এটি/এনটি