শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


শাগরেদের চোখে যেমন ছিলেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব, বেফাক ও হাইআর সাবেক কো-চেয়ারম্যান এবং একইসঙ্গে জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) ২০২০ সালের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ ইন্তেকাল করেন। গত কিছুদিন আগে তার ওফাতের এক বছর পূর্তি হয়।

এ উপলক্ষ্যে তাকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ লিখেছেন আল্লামা কাসেমী (রহ.)-এর শাগরিদ ও একান্ত স্নেহধন্য আলেমেদ্বীন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক এবং টংগী তিস্তা গেট জামে মসজিদের খতীব মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী (দা.বা.)। নিবন্ধটি তুলে ধরা হলো-

হযরত আল্লামা কাসেমী সাহেব (রহ.) ছিলেন আমার একান্ত রাহবার, উস্তাদ ও মুরুব্বী এবং আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুরুব্বী ও পথপ্রদর্শক। গত বৎসর এই মাসে আকস্মিক হযরতকে হারিয়ে ফেলেছি আমরা। হযরতকে হারানোর সেই বেদনাকাতর শোক এখনো প্রতিনিয়ত তরতাজা অনুভব করি।

চারপাশ জুড়ে যেন সাগরসম শূন্যতা বিরাজ করছে। হযরতকে হারানোর বেদনা এক বছর সময় পার হওয়ার পরও একটুও ভুলতে পারিনি।

দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় যাবত জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় হযরত ছিলেন আমার মাথার উপর ছাতার মতো। এই দীর্ঘ সময়ে হযরতের গভীর স্নেহমমতা ও পিতৃসম অভিভাবকত্বের পরশে ছিলাম। হযরত আমাকে অত্যন্ত স্নেহ যেমন করতেন, তেমনি হযরত আমার উপর অগাধ আস্থাও রাখতেন। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ও ছোট-বড় সিদ্ধান্ত নিতে হযরত অধমকে ডাকতেন। একান্তে কথা বলতেন ও মতামত চাইতেন।

এটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওয়া। জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, জামিয়া সোবহানিয়া, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, এমনকি হযরতের একান্ত পারিবারিক বিষয়েও হযরত নিজের বড় সন্তানের মতো আমার সাথে একান্তে পরামর্শ করতেন।

জামিয়ার যে কোন বিষয়েও হযরত মতামত চাইতেন একান্ত আপন হয়ে। এই পুরো সময়ে আমি আমার সর্বোচ্চনা চেষ্টা-সাধনা দিয়ে হযরতের খেদমতের চেষ্টা করেছি। সবসময় হযরতের স্নেহ, ভালবাসা আমার সঙ্গী হয়ে ছিল।

আজ হযরতকে হারানোর এক বৎসর পার হয়ে গেল। কিন্তু চারপাশজুড়ে যে শূন্যতা, যে মরুময় খা খা শূন্যতার পরিবেশ, তা কোনভাবেই গুছাতে পারছি না। হযরতকে হারানোর বেদনা একটুও ভুলতে পারছি না।

হযরত (রহ.) গুণাবলী, বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন এবং বহুমুখী দ্বীনি খিদমত নিয়ে লিখতে গেলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন সব অঙ্গনের উলামায়ে কিরামের পৃষ্ঠপোষক। তালিবুল ইলমদের একজন দরদী অভিভাবক । সর্ব স্তরের আলেমদের অন্যতম মুরুববী। ইসলামী রাজনীতির মাঠে ছিলেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী । ইসলাম ও মুসলিমের যে কোন প্রয়োজনে ছিলেন সব সময় সোচ্চার।

তাঁর তাকওয়া-পরহেজগারী ছিল প্রশ্নাতীত। ছিলেন তাওয়াক্কুল-আল্লাহর উপর ভরসা রাখার এক উজ্জ্বল নমুনা। বিনয় ছিল যার জীবনের ভূষণ।

কর্মহীন ও আশ্রয়হীন আলেমদের ছিলেন আশ্রয় দাতা। ছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরামের মধ্যমণি। কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’র সিনিয়র সহ সভাপতি, আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র কো-চেয়ারম্যান, ঐতিহ্যবাহী জামেয়া মাদানিয়া বারিধারা ও জামিয়া সোবহানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, রাজনীতিতে ছিলেন প্রাচীন রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র মহাসচিব এবং ইসলামী স্বার্থ সংরক্ষণ মূলক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম’র মহাসচিব। সর্বোপরি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর এক হুশিয়ার কাণ্ডারি।

আরবীতে এধরনের ব্যক্তিত্বকে বলে ‘মাজমা’উল কামালাত’-পরিপূর্ণতা গুণের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব।

আমার শায়েখ আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) এমন এক উস্তাদ ছিলেন যিনি ছাত্রদেরকে পিতৃস্নেহ দিয়ে লালন করতেন। তালিবুল ইলমরা ও তাঁকে পিতৃতুল্য মনে করত। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় ছাত্ররদেরকে তিনি ‘বাজি’-বাবা বলে সম্বোধন করতেন। ছাত্ররা ও সম্মান করে তাঁকে ‘বাজি’-বাবার মত সম্মান করত। শুধু ছাত্রকালেই তা সীমিত নয় আলিম হয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পর ও তাদের শ্রদ্ধাবোধ অব্যাহত থাকত।

তিনি ছাত্রদের একজন মুরুব্বী উস্তাদই শুধু ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দরদী অভিভাবকও। যার অভিভাবকত্ব ছাত্রদের কর্মজীবন পর্যন্ত অব্যাহত থাকত। এমনকি ছাত্রদের বিয়ে-শাদীর প্রতি ও খেয়াল রাখতেন। পড়ন্ত বয়সে ছাত্রদের সন্তানদের বিয়েতে উপস্থিত হয়ে তদারকি ও বিয়ের খুৎবা দিতেও তাঁকে দেখা যেত।

তাঁর অনেক ছাত্র আছেন যারা আলিম হয়ে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কেউ হয়েছেন মুহাদ্দিস, মুফাসসির কিংবা ওয়াজের মঞ্চের খ্যাতিমান বক্তা। কেউ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন লেখক-গবেষক হিসেবে কেউবা রাজপথ কাঁপানো রাজনীতির নেতা হয়ে।

হযরত কাসেমী সাহেব (রহ.) ছিলেন আলেম সমাজের ঐক্যের মধ্যমণি। তিনি কখনোই কারো পেছনে নেতিবাচক আলোচনা বা গীবত করতেন না। হযরতের এই গুণ সকলকেই মুগ্ধ করতো। তাঁর মেজাজ ছিল মধ্যপন্থার। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে আপোসহীন হয়ে ও পরমতকে সম্মান করার এক আদর্শ মানব ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর পছন্দের জামা ও টুপিতে ছিলেন অবিচল। সারাজীবন পোষণ করতেন নিজস্ব নজরিয়া। কিন্তু ভিন্ন লেবাস ও ভিন্ন নজরিয়াকে তিনি কখনো কটাক্ষ বা ঘৃণা করে কথা বলতে শুনিনি কখনো। সব মত ও পথের মানুষের সাথে হাসিমুখে সাবলীলতার সাথে কথা বলতেন।

ঈমান-আক্বিদাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সব স্তরের উলামায়ে কিরামের মধ্যমণি হয়ে উঠেন। হয়ত আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে উলামায়ে কিরামের ঐক্য আরও সুদৃঢ় হত, ঈমান-আক্বিদার ময়দানে আরো দক্ষ নেতৃত্ব ও সুদৃঢ় অবস্থান রচিত হতো। মহান আল্লাহর অমোঘ বিধানের অধীনে আমরা সবাই। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হওয়ার নয়।

তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির ময়দানেও পীরে কামিল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) ছিলেন অনেক উঁচু মাপের এক সাধক। তাযকিয়া ও ইহসানের বাস্তব এক নমুনা রেখে গেছেন তিনি তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য। তাঁর তাসাওউফ সাধনায় ছিল না কোন লৌকিকতা। পীর মুরীদীর নামে তিনি কোন আস্তানা আর খানকাহ গড়ে তুলেননি। মুরীদ আর খলীফা বৃদ্ধির কোন কসরত করেননি। ইসলাহী মাহফিল আর জোড় ইত্যাদির নামে পাবলিকের সমাগম আহ্বান করেননি। তাঁর যেই পরিমাণ ভক্ত আর অনুরক্ত ছিল, আহ্বান করলে বছরে দু’য়েকবার লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটাতে পারতেন। চাইলে কয়েক হাজার খলীফা বা মাজায রেখে যেতে পারতেন।

অথচ তাঁর খিলাফত লাভে ধন্য হয়েছেন মাত্র চার জন। মাওলানা কাসিমীর আত্মশুদ্ধি ছিল দুনিয়ার মোহ বর্জনের, মহান আল্লাহর উপর সর্বাত্মক ভরসা রাখার, লোক দেখানো ও শোনানোর কাজ থেকে দূরে থাকার, আত্মম্ভরিতা পরিহার করার, একান্তে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ও সর্বোপরি মহানবী সা,এর অনুকরণে আল্লাহর গোলামী ও জীবন যাপনের ।

দুনিয়া ত্যাগী মহান এই সাধক রেখে গেছেন কোটি কোটি টাকা মূল্যের বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রেখে যাননি নিজের বা নিজের পরিবারের জন্য কোন প্লট, ফ্ল্যাট বা মাথা গোঁজার সাধারণ বাড়ি। বিশাল বিশাল ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন । এগুলোতে নিজের ছেলে, জামাই বা নিকটাত্মীয় কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যাননি। এমনকি শিক্ষক হিসেবে ও তাদেরকে নিয়োগ করেননি। আত্মশুদ্ধিতে কি পরিমাণ বলীয়ান হলে একজন মানুষ নিজের স্বার্থ ও আপনজনের স্বার্থকে এভাবে বিলিয়ে দিতে পারেন, অবিস্মরণীয়।

দরসের মসনদে হযরত (রহ.)এর পাণ্ডিত্য ছিল সর্বজন স্বীকৃত। হাদীসের দরস প্রদানে হযরত (রহ.) তাঁর দেওবন্দী উস্তাদদের রীতি অনুসরণ করে চলতেন। বিশেষ করে আল্লামা আনজার শাহ কাশ্মিরি রহ. ও আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপূরী রহ. এর পাঠদান পদ্ধতি ছিল তাঁর কাছে প্রিয়। দরসের পাশাপাশি তিনি ছাত্রদের আমল-আখলাকের উন্নতির বিষয়েও সবসময় মেহনত করতেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ইসলাহী বয়ান করতেন। ছাত্রদের নাহু-সরফের উন্নতির লক্ষ্যে হযরত প্রায়ই বিশেষ দরস পরিচালনা করতেন। এক কথায় হযরত প্রতিটি ছাত্রের প্রতি পিতৃসূলভ দৃষ্টি ও অভিভাবকত্ব করতেন।

এছাড়া ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থে বহুমাত্রিক কাজে অংশগ্রহণ ছিল আল্লামা কাসেমী (রহ.)এর অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইসলাম ও মুসলিমের স্বার্থে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে ইসলামী শিক্ষার সংযোজন, ইসলাম বিরোধী নারীনীতি প্রনয়ণ, মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, মজলূম ফিলিস্তিনদের সমস্যা সমাধান, কাশ্মীরিদের বিশেষ অধিকার ফেরত দান, দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি ও ব্যাংক লুণ্ঠন এবং বিদেশে টাকা পাচার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন গণ মানুষের পক্ষে সোচ্চার নেতা।

ঈমান-আক্বিদার স্বপক্ষে, ইসলামবিদ্বেষী যে কোন তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি দেশ ও জাতির স্বার্থে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত এক অবিসংবাদিত নেতা। পড়ন্ত জীবনে তিনি হুইল চেয়ারে বসে রাজপথে অসংখ্য মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে আজীবন সোচ্চার ছিলেন তিনি । দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার পক্ষে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কথা বলতেন ।

আল্লাহর জমিনে আল্লাহর নেজাম প্রতিষ্ঠার জমিয়তের স্লোগান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু সাধনা সংগ্রাম করে গেছেন। কোনো প্রলোভন ও চাপের কাছে মাথা নত করেননি তিনি। সত্য ও ন্যায়ের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে আমরণ লড়াই করে গেছেন তিনি । আত্মবিক্রয়, আত্মপ্রতারণা করেননি কোন দিন। বীর সাজার অস্থিরতা ছিল না তাঁর অভিধানে। পার্থিব মোহ এবং শাসকদের তুষ্টি বিধানে পদলেহনের কোন ইতিহাস নেই তাঁর জীবনে । দেশ ও জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত আর বুদ্ধিমত্তার।

বিরোধী পক্ষের অনেকেই হয়তো তাকে পছন্দ করেন না বা সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তন্ন তন্ন করেও তাঁর কোন একটা বাক্য বা বিবৃতি থেকে একটা বাক্যও ভুল বের করতে পারেননি কেউ। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কথা বলতেন। মেপে মেপে কথা বলতেন। কখনোই আবেগের জোশে বেফাঁশ মন্তব্য করতেন না।

ব্যক্তি জীবনে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) ছিলেন একজন উঁচু মাপের বুজুর্গ । নফল সালাত আদায় তাসবীহ তাহলীল, জিকির-আজকার, কুরআন তিলাওয়াত, ইসলামী গ্রন্থ অধ্যয়ন ইত্যাদির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রতি রমজান মাসে ৩০ দিন মসজিদে ইতিকাফে অবস্থান করে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেই সময় দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা সীমিত রাখতেন।

পরিমিতিবোধ ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বিশিষ্ট । উগ্রবাদিতা বা অতিমাত্রিক শৈথিল্যের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন। সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত হলেও নেতৃত্বের জায়গায় তিনি ছিলেন অকুতোভয়। বিনয়, সৌজন্য ও অতিথিপরায়ণতা ছিল তাঁর চরিত্রের আলোকিত দিক। যেকোন দল ও মতের মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার এক সহজাত গুণ ছিল তাঁর।

উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের মতো জটিল রোগে তিনি ছিলেন কাতর। সাথে বার্ধক্যের ভারে ন্যুজ এই সাধক সাহীহ বুখারির সবক প্রদান করতেন এর সাথে মাদ্রাসার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতেন একই সঙ্গে ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আঞ্জাম দিতেন।

পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। প্রতিদিন বাদ ফজর তিনি প্রায় আধ ঘন্টা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ফজরের পর কুরআন তিলাওয়াত শেষ করার আগে তিনি কারো সাথে কোন কথা বলতেন না। এছাড়া ঘুমানোর আগেও তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতেন নিয়মিত। রামাজান মাসে অধিকতর সময় কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং বিভিন্ন আয়াতের প্রয়োজনীয় নোট নিতেন। তিনি বলতেন, কুরআন হল ইলমে ওয়াহীর ফল্গুধারা এবং আল্লাহ তা’আলার মা’রিফাতের ধনভাণ্ডার। এই স্রোতধারায় অবগাহন ছাড়া প্রাজ্ঞ আলিম হওয়া সম্ভব নয়।’

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) দু’টি গুণের প্রতি ছিলেন খুবই যত্নবান। এইগুণ দু’টির কারণে তিনি সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাহল, নম্রতা ও ইসতিগনায়ী। এ দু’টি গুণ অর্জনের জন্য ছাত্র ও শিষ্যদের নসিহত করতেন। বলতেন, নম্রতা অবলম্বন কর, অহঙ্কার বর্জন । ইসতিগনায়ী তথা পরমুখাপেক্ষিতা পরিহার কর। তাঁর দর্শন ছিল, এদু’টি গুণ অর্জন করতে পারলে ‘উলামায়ে কিরামের আত্ম সম্মান অটুট থাকবে । বিত্তশালী ও শাসক শ্রেণীর সাথে মাখামাখি তাঁর পসন্দ ছিল না। কাউকে অবজ্ঞা করাও তাঁর নীতি বিরোধী ছিল। প্রতিকূলতায় ধৈর্য ধারণে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

আমার জানেশীন মুরুব্বী ও অভিভাবক এই মহান সাধক আলেম ও বুযূর্গ বগত বৎসর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করে আপন মাহবুবে আ’লার সান্নিধ্য পেতে পরকালের পথে যাত্র করেন। ইন্তিকালের সময় হযরত (রহ۔)এর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। এই জ্ঞানতাপসের ইন্তেকালে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁকে হারানোর বেদনায় বহু মানুষকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা গেছে। এ যেন এক অভিভাবককে হারানোর বেদনা। যা এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও একটুও ভুলতে পারিনি।

জামিয়ায় নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আগের মতো এখনো সকালে আসি রাতে ফিরি। কিন্তু জামিয়ার চারদিকেই যেন হযরতের শূন্যতা খা খা করে। হযরতের শূন্যতার এক অব্যক্ত কষ্টে প্রতিদিনই হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যায়। যে কোন কাজে পারামর্শ ও নির্দেশনা পেতে এখনো মনের অবচেতনে হযরতের হুজরার দিকে কদম বাড়াতে উদ্যত হই। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে যাই, এক অব্যক্ত বেদনায় মুষড়ে পড়ি।

দয়াময় আল্লাহর দরবারে করজোড়ে মিনতি, তিনি যেন আমার শায়েখ, অভিভাবক, পীর ও মুরুব্বী রাহবারে মিল্লাত (রহ.)-কে আপন রহমতের চাদরে কবর জগতে আবৃত রাখেন এবং পরকালে জান্নাতের আ’লা মাক্বাম দান করেন। এছাড়া হযরতের মিশন ও ভিশনকে এগিয়ে নিতে আজীবন কাজ করে যাওয়ার তাওফীক দান করেন। আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

লেখকের ই-মেইল- [email protected]

-এটি/ বেলায়েত হুসাইন


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ