আল্লামা আশরাফ আলী নিজামপুরী: পবিত্র কুরআনুল কারীম নিঃসন্দেহে সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য এক অনন্য জীবনসূত্র। কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত, দাওয়াত ও হেদায়াত বিশ্বমানবতার জন্য এক অতুলনীয় আবে-হায়াত। সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষ যারা আজও মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণী ও আল-কুরআনের শিক্ষার সঙ্গে অপরিচিত, এমনকি অমুসলিমদের কাছেও কুরআনের মূল তা'লীম ও শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব
বিশেষ করে 'ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া'-উম্মতের উলামায়ে কেরামর উপর অর্পিত হয়ে আছে দীর্ঘ চৌদ্দশ বছর ধরে।
আমার প্রিয় হাফেয ভাইয়েরা! ত্রিশ পারা কুরআন তোমাদের সিনা মুবারকে তোমরা ধারণ করে আছ। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কিতাব এই কুরআন। এই মহামূল্যবান কুরআন হিফয করার কারণে তুমি যে কত মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছ, তা কি এক বারও ভেবে দেখেছ?! তুমি যদি তোমার মূল্য অনুধাবন করতে না পার? তো তোমার ব্যাপারে কবি বলেছেন- যে নিজের মূল্য নিজেই বুঝে না, তার চাইতে বড় বোকা পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
আমার প্রিয় হাফেয ভাইয়েরা! তোমরা নিজের মূল্য অনুধাবন করে পথচলার চেষ্টা করবে এবং সিদ্ধান্ত নিবে আমাকে হাফেয হওয়ার সাথে সাথে বড় মাপের আলেমও হতে হবে। সুতরাং, কোনো অবস্থায় সময়ের অপচয় করবে না! সময় খুবই মূল্যবান সম্পদ। পৃথিবীর মার্কেটে সব বস্তু পাওয়া যায়, সময়ের কোন মার্কেট নেই, সময় ক্রয়-বিক্রয় হয় না।
মতেআমার প্রিয় হাফেয ভাইয়েরা! তোমাদের সময় আরো মূল্যবান, সময়কে সময় দিতে হবে। সময় তাদের জন্য অপেক্ষা করে, যারা সময়ের সদ্ব্যবহার করে।و كن مستفيدًا كلّ يوم زيادةً * من العلم و اسبح في بحور الفوائد -সেদিন কে যেন আমাকে বললেন- মেকআপ করে কুরআন তিলাওয়াতের কথা।
আমার বিশ্বাস হয়নি, একজন পুরুষ আবার একজন হাফেযে কুরআন সে আবার মেকআপ করবে কেন?! সৌন্দর্য বা স্বাস্থ্য সুখের মূল নয়; আখলাক ও চরিত্রই সুখের মূল, এই সৌন্দর্য বয়স ভারী হওয়ার পর আর থাকবে না-
حسن صورت چند روزاں حسن سیرت مستقل،*
اُس سے خوش ہوتاہے آنکھیں اِس سے خوش
ہوتاہے دل،
বর্তমান সমাজে অনেক হাফেযে কুরআন শুধু হাফেয সাহেব হয়েই ক্ষ্যন্ত হয়ে যায়, আলেম হয় না! এর কারণ কী? তা কি কোনো দিন চিন্তা করেছ?!। শুধু হাফেয হওয়ার পর আলেম না হয়ে দ্বীনের কোনো প্লাটফর্মে খেদমত করা যায়?! হাফেয হওয়ার পর অনেকেই আলেম হয় না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে পরে আসছি। প্রথমে আল্লাহর নবীর দু'টি হাদীছ শুনি- হযরত আবু হুরাইরাহ রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত নবী করীম সা.ইরশাদ করেন- তোমরা ‘জুব্বুল হুযুন’ থেকে আল্লাহর নিকট পানা চাও! সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল! জুব্বুল হুযুন কী?’ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন- ‘এটি জাহান্নামের একটি গর্ত, এই গর্তের ভয়াবহ আজাবের কারণে জাহান্নাম নিজেই দৈনিক চারশত বার এই গর্ত থেকে পানাহ চায়’।
উপস্থিত ছাহাবায়ে কেরাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম'কে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই ভয়াবহ গর্তের মধ্যে কারা প্রবেশ করবে?’ উত্তরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘যারা কুরআন তিলাওয়াত করার সময় রিয়া করবে এবং আল্লাহর রেযামন্দির স্থলে মানুষকে দেখানোর জন্য কুরআন তিলাওয়াত করবে’।
'মিশকাত শরীফে'র ব্যাখ্যা গ্রন্থ 'মুযাহেরে হক্ব' এবং 'মেরকাত' কিতাবে উল্লেখ রয়েছে- ‘যারা শুধু মানুষেকে খুশী করার জন্য এবং শোহরত অর্জন করার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করবে তারাও এই হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’।
সুতরাং, শুধু সুর আর কন্ঠ দিয়ে কুরআন তিলাওয়াতে তেমন একটা সাওয়াবের বা সফলতার পথে যে আশা করা যায় না। সত্যের উপর অবিচল থাকা এবং এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে পারাই আসল সফলতা। বাইহাক্বী শরীফে হযরত বুরাইদা রাযিআল্লাহু আনহু থেকে হাদীছ বর্ণিত আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যারা কুরআন তিলাওয়াত করবে শুধু বিনিময় গ্রহণ করার জন্য, কিয়ামত দিবসে তারা এমনভাবে দণ্ডায়মান হবে তাদের চেহারায় গোশত থাকবে না শুধু হাড্ডি থাকবে’।
মুখমণ্ডলে যদি শুধু হাড্ডি থাকে তখন কেমন দেখাবে! একটু কল্পনা করা দরকার। হাদীছের মর্মার্থ হলো- তুমি যখন সম্মানিত বস্তুকে নিকৃষ্ট বস্তু দ্বারা অসম্মান করলে, আল্লাহ পাক তোমার সম্মানিত অঙ্গকে অসম্মানিত অবস্থায় প্রদর্শন করবেন।
যেমন, কেউ যদি নিজ মুখমণ্ডল দ্বারা জুতা পরিষ্কার করে, জুতা ঠিকই পরিষ্কার হয়ে যাবে কিন্তু এর চাইতে নিকৃষ্ট কাজ আর হতে পারে না। হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন- ‘যারা সার্কাস প্রদর্শন করে দুনিয়া কামাই করে, তাদের চাইতেও জঘন্য তারা, যারা দ্বীনের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জন করে।
আমার প্রিয় হাফেয ভাইয়েরা! আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- "সুললিত কন্ঠে এবং তারতীলের সাথে তেলাওয়াতকারী কে?! ‘উত্তরে নবীজী বলেছিলেন-
"من إذا سمعته يقرأ اريت أنه يخشیٰ الله’
অর্থ- তুমি যখন তিলাওয়াতকারীর তিলাওয়াত শুনবে; তখন তুমি অনুভব করতে পারবে যে, তিলাওয়াতকারীর মধ্যে আল্লাহর ভয় কাজ করছে।
হে হাফেযে কুরআন! তুমি বড় হও! আরো বড়। পুরো জাতি তোমার কথা শুনার জন্য অপেক্ষায় আছে। আল্লাহ তোমাকে কবুল করুন, হায়াতে ত্বায়্যিবাহ দান করুন।
আবেগী, হুজুগী এবং অতী উৎসাহী তোমাদের ভক্তরা মনে করেন- মঞ্চে উঠা এবং এদিক সেদিক ছোটাছুটির মাধ্যমে তোমার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু বাস্তবতা এমন নয় বরং এসবের মাধ্যমে তোমার সর্বনাশ ডেকে আনছে।
আমাদের মুরুব্বিদের কথা- ‘কুরআন তিলাওয়াত এমন নম্র, ভদ্র এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় হতে হবে যাতে তিলাওয়াতকারীকে দেখে কেউ এটা ভাবতে না পারে যে, তিলাওয়াতকারীর তিলাওয়াত করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে; মুখ বিকৃতি করে কানে আঙুল দিয়ে তিলাওয়াত করা কুরআনের আদবের খেলাফ’।
মহান আল্লাহ তা'আলা সত্য কথা বলার, সত্য পথে চলার এবং সত্য পথে জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামীন!
লেখক- গবেষক, বহু গ্রন্থ প্রনেতা এবং সিনিয়র মুহাদ্দিস হাটহাজারী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়।
-কেএল