আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ‘আমরা পাঠদান-পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী কোনো পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারছি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে’। ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আয়োজিত শিক্ষা সমাবেশের বিশেষ আকর্ষণ চরমপত্রে এসব বলা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ( ১৭ সেপ্টেম্বর) শাহবাগ জাতীয় যাদুঘর চত্ত্বরে জাতীয় শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে “বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো সংস্কার ও চলমান সংকট নিরসনের দাবিতে শিক্ষা সমাবেশে” চরমপত্র পাঠের আয়োজন করে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন।
ইশা ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে চরমপত্র পাঠ করেন সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল,শেখ মুহাম্মাদ আল-আমিন।
চরমপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি। কোনো দেশের জন্য সময়ের হিসাবে ৫০ বছর কম-না বেশি, এ নিয়ে মত-দ্বিমত থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষাব্যবস্থা ও এর কাঠামোকে সময়োপযোগী করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও শিক্ষাকে সময়োপযোগী ও কর্মমুখী করা সম্ভব হয়নি, শিক্ষার বিদ্যমান সংকট নিরসনে তেমন তোড়জোড় লক্ষ করা যায়নি।
চরমপত্রে আরো বলা হয়েছে, বস্তুত শিক্ষাই সব শক্তির মূল- এই প্রবাদ বাক্যটি চারশো বছরের পুরনো। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন কথাটি বলেছিলেন এবং তিনি তার যথার্থ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। শত শত বছর পরেও কথাটি তার মূল্য হারায়নি। শিক্ষাই শক্তি। শিক্ষা হচ্ছে যে কোন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের মূল চালিকা শক্তি। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত,সভ্য এবং অগ্রসর। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, ‘পড়ো’। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনেও সর্বপ্রথম শিক্ষা গ্রহনের আহবান করা হয়েছে। বস্তুত একটি জাতিকে উন্নতির ক্রমবর্ধমান পথে ধাবিত হতে গেলে ও চূড়ায় পৌঁছাতে হলে শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা রকম সংকটের মুখোমুখি।একদিকে এই সংকট সবার কাছে শিক্ষা না পৌঁছানোর এবং অন্যদিকে যাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে তা যথাযথ মানসম্পন্ন না হওয়ার। এই সংকটের অন্যান্য দিকগুলো হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া; পরীক্ষাগুলোয় বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়া; শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ অথবা গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাব থাকা। শিক্ষার্থীরা যে নোট বই ও কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে এবং গণিত ও ভাষার ক্ষেত্রে তাদের যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, তাও শিক্ষার সংকটকে আরোও ঘনীভূত করছে।
আরো বলা হয়, আমরা পাঠদান-পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী কোনো পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারছি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে। আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে। বর্তমান তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে আমরা তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তর এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন তা আমাদের শিক্ষা কাঠামো করতে ব্যার্থ হচ্ছি। আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য যখন সীমিত ছিল, তখন শিক্ষার পেছনে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সরকারগুলো দিতে পারেনি। কিন্তু সক্ষমতা যখন বাড়ল, তখনো বিনিয়োগের পরিমাণ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি।
আরো পড়ুন: বিজ্ঞান ভিত্তিক, কর্মমূখী ও সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব ইশার
আরো বলা হয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষকদের বলা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’।কিন্তু শিক্ষকদের জীবনধারণকে সহজ ও সামাজিক মর্যাদাবান করার ক্ষেত্রে সমাজ ক্রমাগত কার্পণ্য দেখিয়েছে। সমাজের পক্ষে রাষ্ট্রও সেই কার্পণ্যের ধারা বজায় রেখেছে। ফলে জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত এই কারিগরেরা, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে এই দায়িত্ব যাঁরা পালন করেন, সেই শিক্ষকেরা তাঁদের দু-একটি অধিকার আদায়ে রাজপথে নামলে পুলিশের জলকামানের সামনে পড়তে হচ্ছে।
শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে কখনো পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এ রকম একটি চিন্তা আমাদের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি। যেদিন থেকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা পেল সেদিন থেকে শিক্ষা পণ্যের মোড়কে হাজির হতে থাকল। এটি ঘটছে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী চিন্তার ফলে।আমরা মনেকরি, শিক্ষা যখন পণ্য হয়, তখন শিক্ষার মধ্য দিয়ে উচ্চতর জ্ঞানসাধনার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়, প্রধান হয়ে ওঠে বাজারের চাহিদা।
আবার, দেশে দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীও বাড়ছে। সমান্তরালে উচ্চশিক্ষিত বেকারও বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত জনশক্তি ব্যবহার করার কার্যকর পরিকল্পনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তার মূল লক্ষ্য গবেষণা ও উদ্ভাবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অপরাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
আরো বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা মূলত গবেষণাধর্মী। কিন্তু উচ্চশিক্ষাতে গবেষণা নেই বললেই চলে। পড়াশোনার লক্ষ্যই যেন হয়ে পড়েছে সরকারি বা বড় অংকের বেতনের চাকরি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘দেশের সবাই যদি চাকরির পেছনে ছোটে, তাহলে তো দেশটা চাকরে ভর্তি হয়ে যাবে; মালিক থাকবে না।’ বাস্তবতা হচ্ছে, প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা না হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। চলমান সার্টিফিকেটসর্বস্ব বেকার তৈরির শিক্ষাই চলতে থাকবে। দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে অস্থিরতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে, তা দেশের জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।
আরো পড়ুন: স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা শিক্ষার সংকট থেকে বের হতে পারিনি: নূরুল করীম আকরাম
শিক্ষাখাতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ছয় মাসের মধ্যেই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে নানা রকম কনিশন গঠন করা হয়েছিলো। ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশন,১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি, ১৯৭৯ সালে অর্ন্তর্বতীকালীন শিক্ষা কমিটি, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০, শিক্ষা সংস্কার কমিটি ২০০২, জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩, জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন কমিশন। বর্তমান সরকারও শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার জন্য ২০০৯ সালে অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় শিক্ষা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। কিন্তু শিক্ষার সংকট সমাধান না হয়ে তা তীব্র থেকে আরো তীব্র হয়েছে।
ঐ কমিশনগুলোর অতিমাত্রায় ইহজগতিকপ্রীতি ও ধর্মবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। তারা স্বজাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখেন ব্রাহ্মণ্যবাদী ও নাস্তিক্যবাদী প্রকরণে এবং তারা যে সাম্রাজ্যবাদ, ইহুদিবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বলয়াবৃত, তা তাদের কৃতকর্মে প্রতিফলিত। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে বিভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুবর্তী এসব লোকের উপলব্ধিতে বিজাতীয় সম্প্রকাশ ঘটেছে।ফলে এদেশের শিক্ষা কাঠামো দীর্ঘ ৫০ বছরের পশ্চিমা ও ঔপনিবেশিক কাঠামোর খোলশ মুক্ত হতে পারেনি।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে যা স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম এবং বাংলাদেশে মহামারির পুরোটা সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ইউনিসেফের রিপোর্টে শিক্ষার্থীদের নানাবিধ ক্ষতির কথাও উঠে এসেছে। যেমন-
১.দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে গেছে। ২. শিশু শ্রম, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩. জাতির ভবিষ্যৎ মেধা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ৪. বড় ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। ৫. পরীক্ষা নিতে না পারায় শেখার দক্ষতা যাচাই হয় নি। ৬. গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বেড়েছে। ৭. শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ৮. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে কর্মজীবনে প্রবেশে পিছিয়ে গিয়েছে।
আরো পড়ুন: ‘আদর্শিক প্রজন্ম গড়তে শিক্ষার সকল স্তরে কুরআন-নামাজ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে’
শিক্ষা সংকট দূরীকরণে ও দেশপ্রেমীক জনশক্তি তৈরিতে আমরা মনে করি প্রশিক্ষিত শিক্ষক, মানসম্মত পাঠ্যবই, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকল্প ও সদিচ্ছা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মীয় চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর যেমন- ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ, অধ্যবসায় ইত্যাদির বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে সকল শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে জনসম্পদ গড়তে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। ত্রিধারার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চূড়ান্ত শিক্ষা কাঠামো ও শিক্ষা আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা বলতে চাই, জোড়াতালি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, এমনকি সরকারি কাজকর্মও চলতে পারে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে জোড়াতালির কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা হচ্ছে বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ জায়গা, যার সুফল একটি জাতি ও পুরো দেশ পায়। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে অলাভজনক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করুন। দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করুন।
এনটি