রফিকুল ইসলাম জসিম,
নিজস্ব প্রতিবেদক
কলেজ জীবনের প্রথমবার সশরীরে ক্লাস করতে পেরেছেন আজ। ২০২০-২১ সেশনে কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও করোনার কারণে সশরীরে ক্লাস করার সুযোগ হয়নি তাদের। প্রায় এক বছর অনলাইনেই ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে এসব শিক্ষার্থী। আজ রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) তাদের সশরীরে ক্লাস করার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।
গত বছর মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোনো ১৬ লাখ ৯০ হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাবোর্ডগুলোর হিসেবে অন্তত সাড়ে ১৪ লাখ একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। অনেক আগে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথম কলেজে পা রাখার দিন হলেও করোনার কারণে এবার সেই আনন্দটুকু করার সুযোগ হয়নি বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর।
কলেজ বন্ধ থাকায় তাদের ক্লাস শুরু করা হয়েছে অনলাইনে। নতুন ক্লাস, নতুন বই, নতুন বন্ধু, নতুন জীবনে নবসূচনা- সবই এবার ছিল ভিন্ন রকম। তবে কলেজজীবনে প্রথম দিনের ক্লাস নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে না করতে পারার আক্ষেপ ছিল শিক্ষার্থীদের মাঝে। এদিন অনলাইনে যুক্ত হতে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় অনেককে।
করোনা অতিমারির জন্য ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর আজ খুলল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে শোনা গেল, ‘আহা, আজি এই বসন্তে/ এত ফুল ফুটে...’ গান বেজে চলেছে অবিরত। কেননা, নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব শিক্ষার্থীর জন্যই তীর্থস্থান। আজ ছিল শিক্ষার্থীদের স্মরনীয় দিন। তাই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভাবনা তুলে ধরেছেন আওয়ার ইসলাম নিউজ টুয়েন্টি ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম জসিম...
বি.এ.এফ শাহীন কলেজ শমশেরনগরের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল হাসান জানান,কলেজ জীবনের প্রথম সশরীরে ক্লাসে ফুল ও চকোলেট দিয়ে আমাদেরকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন তার অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম৷
২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় GPA-5 পেয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় বিএএফ শাহীন কলেজ শমশেরনগরে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলেজে ভর্তি হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হয় নি স্বশরীরে কলেজে অবস্থান করে ক্লাসে অংশগ্রহণ করা। অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভালো না থাকাই নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নিজ ঘরে অবস্থান করে ক্লাস করতে না পেরে ছুটে যেতে হয়েছে পুকুর পাড়ে কিংবা গাছতলায়।
এভাবে পুকুর পাড়ে,গাছতলায় বসে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু যখন ঝড়বৃষ্টির মৌসুম চলে আসলো তখন থেকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। পরবর্তীতে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা একটু উন্নতি হলেও অনলাইন ক্লাসের শতভাগ সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয় নি। শহরাঞ্চলের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো থকায় শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যতটুকু সুবিধা ভোগ করেছে, ততটুকু সুবিধা পায় নি আমার মতো গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশ আসে তখন মনের মধ্যে নতুন এক আবেগের সৃষ্টি হয় কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে পারবো বলে। অনেকবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ ঘোষণা করলেও করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিকে না আসায় সম্ভব হয় নি শ্রেণি কার্যক্রম চালানো। অবশেষে ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। তখন থেকেই আনন্দের জোয়াড় বইতে শুরু হয়ে যায় । কলেজে ভর্তি হওয়ার ১ বছরের মধ্যে ১ দিনও সশরীরে ক্লাস করতে না পারার আক্ষেপের অবসান ঘটতে থাকে।
কলেজের নির্দেশনা মোতাবেক আজ ১২ সেপ্টেম্বর (রবিবার) প্রথমবারের মতো ক্লাস করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলেজে অবস্থান করি। এ যেন নতুন এক জীবনের নব সূচনা। শীতের মৌসুমে পাতাহীন গাছগুলো যেমন বসন্তের শুরুতে নতুন পাতা নিয়ে প্রকৃতিতে ফিরে আসে, ঠিক তেমনি দীর্ঘদিনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানহীন জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন জীবনের সূচনা হওয়ার আনন্দটা বলে বোঝাবার মতো নয়।
নতুন পরিবেশে নতুন বন্ধুবান্ধবদের পেয়ে যেন মনের মধ্যে এক আনন্দের বন্যা বইতে শুরু হলো। কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাসটার মজাটা ছিল দারুণ।
নতুন শ্রেণিকক্ষে নতুন বেঞ্চে নতুন বন্ধুবান্ধবদের সাথে যখন আনন্দে মেতে উঠছিলাম তখন ক্লাসে অবস্থান করল আমাদের শ্রেণী শিক্ষক। ফুল ও চকোলেট দিয়ে আমাদেরকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন তার অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম৷ এভাবে সীমাহীন আনন্দের সাথে কেটে যায় কলেজ জীবনের প্রথম দিনটা৷ সত্যিই আজকের দিনটা আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।
সুজা মেমোরিয়াল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ বখতিয়ার হুসাইন জানান, কলেজ জীবনের প্রথম সশরীরে ক্লাসে আসতে পেরে বন্ধুদের খুব কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে।
সালটা ২০২০ এসএসসির রেজাল্টের পর আমি প্রায়ই শুধু ভাবতাম কলেজ লাইফ আসলে কতো মজার মাত্র কয়েকটা ক্লাস আর নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে শুধু মজা আর চিল করবো। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে ❝করোনা ভাইরাস( Covid 19)❞ নামক এক প্রাণঘাতি জীবাণুর হুহু করে সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া, যার ফলে ১৭ই মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সকল স্কুল-কলেজ!
১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল কলেজ সীমিত পরে খুলে দিবে! আর আমাদের HSC 2022 এর জন্য ক্লাস হবে প্রতিদিন! তো আজই সেই ১২ ই সেপ্টেম্বর রাতে কলেজ গিয়ে কি করবো আর কিভাবে যাবো তা নিয়ে ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম। নতুন কলেজের প্রথম দিন বলে খুব সকাল ঘুম থেকে উঠে বই খাতা গুছিয়ে নিলাম! সকাল ০৯ঃ০০ ঘটিকায় পৌছে গেলাম গন্তব্যস্থল ❝আমার নতুন কলেজে❞।
কলেজ জীবনের ১ম ক্লাস খুব ভালো লাগলো ১ম এ পদার্থ বিজ্ঞানের স্যার ক্লাসের Present নেওয়ার পর শুরু করে দেন তার ৫০ মিনিটের ক্লাস। তারপর আসলেন আরেক নতুন স্যার, যিনি জীববিজ্ঞানের প্রভাষক! তিনি এসে আমাদের সিলেবাস এবং কলেজ জীবনের ১ম দিন হিসেবে ৪০ মিনিটের লেকচার দিলেন! আজ ক্লাসে আসতে পেরে বন্ধুদের খুব কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। লেখাপড়ার ক্ষতি হলেও কিছু করার নেই। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পরিশ্রম করতে হবে।
সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এল.সুষ্ময় জানান, ভালোই লাগলো আজকের দিনটা।অনেকের সাথে দেখা হলো, গল্প হলো- অনেকদিন পর আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।
অনেকদিন পর প্রিয় প্রতিষ্ঠানের মুখ দেখে অনেক ভালো লাগল।আশা করি করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার পুরোপুরি ভাবে শুরু হবে।স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই প্রতিষ্ঠানে আসল,বেঞ্চে বসার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখল সবাই।আশা করি করোনা পরিস্থিতি তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং আগের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলা পুরোদমে চালু হবে।
বি.এ.এফ শাহীন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান জানান, কলেজ জীবনের প্রথম এই দিনটা উপভোগ করলাম তা ছোট কথায় বলে শেষ করা যাবেনা। সত্যিই আজ সেই স্বপ্ন টা পূরণ হলো- প্রথম ক্লাস করার অনুভূতিটা অন্য রকম ছিল।
প্রাথমিক পর্যায় শেষ, মাধ্যমিক পর্যায় ও শেষ। আশা ছিল কলেজ জীবন এ ঠিকমতো লেখাপড়া করে জীবনের একদাপ এগিয়ে নিয়ে যাবো ।কিন্তু নাহ, পারলাম না। অজানা এক রাজা পৃথিবী কে নিজের দখলে করে নেই এই একটি ছোট ভাইরাস ব্যাস, দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
ফলে কলেজে আর উঠা হয়ে উঠল না।কিন্তু আজ দুঃখ নয়, হাসির একটি অনুভূতি বলবো।দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আদেশ দিলে আমরা আজকে কলেজে এ গেলাম । মনে ,মনে টানটান উত্তেজনা। কি হবে,কি ঘটবে,নতুন পরিবেশ,নতুন অদেখা মুখগুলি দেকবো,খুব খুশি হচ্ছিলাম।
আজ সেই স্বপ্ন টা পূরণ হলো। গেইটে আমাদের কলেজের প্রধান এবং সহকারী শিক্ষক সমূহ আমাদের নববরণ করে নিলেন।ক্লাসে গেলাম ।নতুন নতুন অদেখা মুখগুলো দেখতে পেলাম।
সবার সাথে ব্যাস ভালো পরিচয় হলো। গড়ে উঠল নতুন বন্ধুত্ত্ব।সত্যি কথা বলতে কলেজ জীবনের প্রথম এই দিনটা কিভাবে উপভোগ করলাম তা একটি ছোট কথায় বলে শেষ করা যাবেনা। সত্যিই প্রথম ক্লাস করার অনুভূতিটা অন্য রকম ছিল।যাই হোক সব মিলিয়ে দিনটা খুব ভালো কাটলো।
বি.এ.এফ শাহীন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সায়ক সিংহ জানান, আজ করোনা মহামারীর পর প্রথম কলেজ খুলল। দিনটা আমার অতীত বর্তমান জোড়া লাগাতে লাগাতেই চলে গেল ফুড়ুৎ করে। বাড়ি এসে গায়ে চিমট কেটে দেখতে হয়েছে স্বপ্নে নাকি সত্যি বাস্তবে ক্লাসটা করলাম। এ আনন্দ কোথায় রাখি?
“খোলো খোলো দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে….”ঐ দরজাটা খোলার প্রতীক্ষায়বপুরো দেড় বছর অপেক্ষা করে ছিলাম। অবশেষে সে দিন আসলো, গাড়ি ধরে রওয়ানা দিলাম গন্তব্যে। এটা কি সত্যি? বন্ধুরা সবাই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রস্তুত পুরোপুরি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আস্তে আসতে খুলল তো দরজাটা! 'চুল ছোট? কালো বেল্ট? মাস্ক? স্যানিটাইজার? ঠিক আছে ঢোকো।' সার বেঁধে ঢুকলাম, দেখি এই তীব্র রোদেও সবার মুখে এক অদ্ভুত হাসি! অবিশ্বাস্য কিছু ফিরে পাবার হাসি।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা ফুল হাতে অভ্যর্থনা করলেন আমাদের। হ্যাঁ সত্যি আমাদের কলেজ আবার খুলেছে! পাক্কা দেড় বছর বন্ধ, ভাবিনি আবার কখনো ফিরে পাবো সেই স্কুল-কলেজ, সেই পুরোনো বন্ধু, সেই শিক্ষক-শিক্ষিকা, সেই স্বাভাবিক জীবন! অবিশ্বাসটা সাথে নিয়েই ক্লাসরুমে গেলাম। শ্রেনী শিক্ষক আমাদের সবাইকে একটা করে চকোলেট দিলেন, আর দিলেন একটা মুচকি হাসি। পড়ালেন, উপদেশ দিলেন, হাসি ঠাট্টা করলেন ঠিক আগের মতোই। ঠিক আগের মতোই ক্লাস শেষে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজল। আহ! সেই ঘন্টা! ঠিক আগের মতোই আমরা হুড়োহুড়ি করে বেরুলাম। সত্যি বলছি ঠিক আগের মতো করে!
-এটি