মুফতি আব্দুর রহিম: সাহাবায়ে কেরামের যামানায় ও রিসালতের যুগে প্রথম দু’প্রকারের প্রচলন ভালোভাবে হয়েছিলো। হাদীস অস্বীকারকারীরা রিসালতের যুগে হাদীস লেখার বিষয়টি স্বীকার করেন না। তারা মুসলিম শরীফ ইত্যাদিতে আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করে থাকেন। হাদীসটি হচ্ছে, صحيح مسلم (৪ / ২২৯৮( عَن أَبِي سَعِيدٍ الخُدرِيِّ رضي الله عنه ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَقَالَ: " لَا تَكتُبُوا عَنِّي، وَمَن كَتَبَ عَنِّي غَيرَ القُرآنِ فَليَمحُهُ، وَحَدِّثُوا عَنِّي،
তাদের দাবী হচ্ছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. কে হাদীস লেখতে নিষেধ করা একথার প্রমাণ বহণ করে যে, রাসূূলুল্লাহ সা. এর যুগে হাদীস লেখা হয়নি। তাছাড়া এ হাদীস দ্বারা এটাও জানা যায় যে, হাদীসগুলো প্রমাণ্য নয়। অন্যথায় রাসূল সা. তা গুরুত্বসহকারে লেখাতেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাদীস লেখা সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা ছিলো ইসলামের প্রথম যুগে। এর কারণ ছিলো তখন পর্যন্ত কুরআনে কারীম এক কপিতে সংকলিত হয়নি; বরং বিক্ষিপ্ত আকারে সাহাবায়ে কেরামের নিকট লিখিত ছিলো। অপরদিকে সাহাবায়েকেরামও তখন পর্যন্ত কোরআনে কারিমের ভাবধারা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন না যে, কুরআন ও গাইরে কুরআনের মাঝে পার্থক্য করতে পারবেন। এই অবস্থায় যদি হাদীসও লেখা হতো তবে এই সম্ভাবনা ছিলো যে, তারা কুরআনকে হাদীসের সাথে গড়বড় করে ফেলতেন। এ ভয়ে ও এই সম্ভাবনাকে দূর করার জন্য হাদীস লেখতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু যখন সাহাবায়ে কেরাম কুরআনের ভাবধারা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত হয়ে গেলেন। তখন হুজূর সা. হাদীস লেখার অনুমতি দিলেন।
যার বিভিন্ন ঘটনা কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে।
১. سنن الدارمي (১ / ৪২৯): عَن عَبدِ الله بنِ عَمرٍو رَضِيَ الله عَنهُمَا، أَنَّهُ أَتَى رَسُولَ الله صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَفَقَالَ: يَا رَسُولَ الله ، إِنِّي أُرِيدُ أَن أَروِيَ مِن حَدِيثِكَ، فَأَرَدتُ أَن أَستَعِينَ بِكِتَابِ يَدِي مَعَ قَلبِي، إِن رَأَيتَ ذَلِكَ، فَقَالَ: رَسُولُ الله صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ- إِن كَانَ قَالَهُ - ্রعِ حَدِيثِي، ثُمَّ استَعِن بِيَدِكَ مَعَ قَلبِكَ
অর্থ: আবদুল্লাহ ইবনে আমর রহ. রাসূলুল্লাহ স.-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল ! আমি হাদীস বর্ণনা করতে চাই। তাই যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে লেখনীরও সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।” তিনি বললেনঃ “আমার হাদীস কণ্ঠস্থ করার সাথে সাথে লেখার মাধ্যমে হাতের সাহয্যও নিতে পারো।
২.
سنن الترمذي ت شاكر (৫ / ৩৯): عَن أَبِي هُرَيرَةَ، قَالَ: كَانَ رَجُلٌ مِنَ الأَنصَارِ يَجلِسُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ، فَيَسمَعُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ الحَدِيثَ فَيُعجِبُهُ وَلَا يَحفَظُهُ، فَشَكَا ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ الله إِنِّي أَسمَعُ مِنكَ الحَدِيثَ فَيُعجِبُنِي وَلَا أَحفَظُهُ، فَقَالَ رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ: ্রاستَعِن بِيَمِينِكَ ، وَأومَأَ بِيَدِهِ لِلخَطِّ
অর্থ: আবু হুরায়রা রহ. বলেন, এক আনসারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ স. এর নিকটে আসতেন ও হুজূর সা. এর মজলিসে বসতেন। তিনি হুজূর সা. এর হাদীস শুনে খুব পছন্দ করতেন, তবে তিনি তা মুখস্ত রাখতে পারতেন না। তাই তিনি হুজূর সা. এর নিকট অভিযোগ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা কিছু বলেন, আমার কাছে খুবই ভালো লাগে, কিন্তু মনে রাখতে পারি না। নবী করীম স. বললেন: “তুমি ডান হাতের সাহায্য নাও।” তারপর তিনি হাতের ইশারায় লেখে রাখার প্রতি ইঙ্গিত করলেন।
৩. হাদীস চর্চাকারীর জন্য তিনি নিম্নোক্ত দু’আ করেছেন: سنن أبي دأود (৩ / ৩২২): نَضَّرَ الله امرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا، فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ،
অর্থ: “ আল্লাহ সেই ব্যাক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন, যে আমার কথা শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখল, তাঁর পূর্ণ হিফাযত করল এবং এমন লোকের কাছে পৌঁছে দিল, যে তা শুনতে পায়নি।”
৪. মহানবী স. আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করে বললেন: صحيح البخاري (১ / ২০): احفَظُوهُنَّ وَأَخبِرُوا بِهِنَّ مَن وَرَاءَكُم
অর্থ : “এই কথাগুলো তোমরা পুরোপুরি স্মরণ রাখবে এবং যারা তোমাদের পেছনে রয়েছে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবে”।
سنن أبي دأود (৩ / ৩২২): قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم تَسمَعُونَ وَيُسمَعُ مِنكُم وَيُسمَعُ مِمَّن سَمِعَ مِنكُم
৫. হুজূর (সাঃ) সাহাবীগণকে সম্বোধন করে বলেছেন: “ আজ তোমরা (আমার নিকট দীনের কথা) শুনছো, তোমাদের নিকট থেকেও (তা) শুনা হবে এবং যারা তোমাদের থেকে শুনেছে তাদের নিকট হতেও শুনা হবে।
৬.
سنن الترمذي ت شاكر (৫ / ৩০): عَن أَبِي هَارُونَ العَبدِيِّ، قَالَ: كُنَّا نَأتِي أَبَا سَعِيدٍ، فَيَقُولُ: مَرحَبًا بِوَصِيَّةِ رَسُولِ الله صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ، إِنَّ رَسُولَ الله صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রإِنَّ النَّاسَ لَكُم تَبَعٌ، وَإِنَّ رِجَالًا يَأتُونَكُم مِن أَقطَارِ الأَرَضِينَ يَتَفَقَّهُونَ فِي الدِّينِ، فَإِذَا أَتَوكُم فَاستَوصُوا بِهِم خَيرًا
অর্থ: আবু হারুন আল আবদী রহ. বলেন: আমরা হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. এর নিকট এলে তিনি আমাদেরকে বলতেন, “হুজূর সা. এর ওসীয়্যাত বহনকারীদের জন্য মারহাবা। হুজূর সা. এরশাদ করেছিলেন, মানুষজন তোমাদের অনুগামী হবে। জমীনের বিভিন্ন অঞ্চল হতে দ্বীন শিক্ষার জন্য লোকজন তোমাদের নিকট ছুটে আসবে। তাঁরা এই উদ্দেশ্যে তোমাদের নিকট এলে তাঁদের প্রতি সদয় হয়ো এবং তাঁদের নিকট হাদীস বর্ণনা করিও।”
৭.
صحيح البخاري (৪ / ১৭০): عَن عَبدِ الله بنِ عَمرٍو، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: ্রبَلِّغُوا عَنِّي وَلَو آيَةً،
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হুজূর সা. এরশাদ করেছেন, “আমার নিকট থেকে একটি আয়াত জানা থাকলে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।
৮. ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরের দিন এবং ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী স. বলেন:
صحيح البخاري (১ / ২৪): لِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الغَائِبَ
“ উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট আমার কথাগুলো পৌঁছে দেয়।”
৯.
سنن أبي دأود (৩ / ৩১৮): عَن عَبدِ الله بنِ عَمرٍو، قَالَ: كُنتُ أَكتُبُ كُلَّ شَيءٍ أَسمَعُهُ مِن رَسُولِ الله صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَأُرِيدُ حِفظَهُ، فَنَهَتنِي قُرَيشٌ وَقَالُوا: أَتَكتُبُ كُلَّ شَيءٍ تَسمَعُهُ وَرَسُولُ الله صَلَّىٰ اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَبَشَرٌ يَتَكَلَّمُ فِي الغَضَبِ، وَالرِّضَا، فَأَمسَكتُ عَنِ الكِتَابِ، فَذَكَرتُ ذَلِكَ لِرَسُولِ الله صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ، فَأومَأَ بِأُصبُعِهِ إِلَى فِيهِ، فَقَالَ: ্রاكتُب فَوَالَّذِي نَفسِي بِيَدِهِ مَا يَخرُجُ مِنهُ إِلَّا حَقٌّ
অর্থ: আবদুল্লাহ ইবনে আমর রহ. আরও বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ স.-এর নিকট যা কিছু শুনতাম, মুখস্ত রাখার জন্য তা লেখে নিতাম। কুরাইশের লোকেরা আমাকে তা লেখে রাখতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ স. একজন মানুষ, কখনও রাগান্বিত হয়ে আবার কখনও প্রফুল্লচিত্তে কথা বলেন।” তাই আমি হাদীস লেখা থেকে বিরত থাকলাম, অতঃপর তা রাসূলুল্লাহ স. কে জানালাম। তিনি আঙ্গুলের সাহায্যে স্বীয় মুখের দিকে ইঙ্গিত করে বললেনঃ “ তুমি লেখে রাখ। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, এই মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না”। তাঁর সংকলনের নাম ছিল الصحيفه الصادقة। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, الصحيفه الصادقة হাদীসের এমন একটি সংকলন যা আমি নবী স. এর নিকট শুনেছি”। এই সংকলনে এক হাজার হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল।
১০.
سنن الترمذي ت شاكر (৫ / ৩৯): عَن أَبِي هُرَيرَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ خَطَبَ فَذَكَرَ القِصَّةَ فِي الحَدِيثِ قَالَ أَبُو شَاهٍ: اكتُبُوا لِي يَا رَسُولَ الله . فَقَالَ رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ: ্রاكتُبُوا لِأَبِي شَاهٍ وَفِي الحَدِيثِ قِصَّةٌ: ্রهَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌগ্ধ
অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রহ. বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ স. ভাষণ দিলেন। আবূ শাহ ইয়ামানী রহ. আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ ভাষণ আমাকে লেখে দিন। নবী করীম স. ভাষণটি তাঁকে লেখে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এই সব হাদীস একথার স্পষ্ট দলীল যে, হাদীস লেখার যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো তা সাময়িক সমস্যার কারণে ছিলো। যখন সেই সমস্যা চলে গেলো তখন শুধু অনুমতি নয়; বরং নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
হাদীস লেখতে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে ইমাম নববী রহ. আরেকটি ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, ব্যাপক লেখা কোন কালেই নিষিদ্ধ ছিলো না; বরং কোন কোন সাহাবী এমন করতেন যে, কোরআনের আয়াতগুলো লেখার সাথে সাথে রাসূল সা. এর ব্যাখ্যা-তাফসীরও লেখে ফেলতেন। এ পদ্ধতি ছিলো মারাত্মক আশঙ্কাজনক। কারণ, এতে কুরআনের আয়াতের সাথে হাদীস মিশে যাওয়ার বিরাট আশঙ্কা ছিলো। এজন্য শুধু এই পদ্ধতি সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। কুরআন থেকে আলাদা হাদীস লেখা সম্পর্কে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। আল্লামা নববী রহ. এর এই ব্যাখ্যা খুবই যুক্তিযুক্ত। নাসায়ী শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। হাদীসটি ইমাম নাসায়ী রহ. বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়শা রা. তার একজন গোলামকে কুরআনে কারীম লেখার নির্দেশ দিয়েছেন। যখন সে حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الوُسطَى (সূরা বাকারা : ২৩৮) আয়াতে পৌঁছলো, তখন আয়শা রা. তাকে الوُسطَى শব্দের পর صلوة العصر লেখার নির্দেশ দিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, العصر শব্দটি কোরআনে কারিমের অংশ ছিলো না। বরং ব্যাখ্যারূপে বাড়ানো হয়েছিলো। যেহেতু তৎকালীন যুগে মূলপাঠ এবং ব্যাখ্যায় পার্থক্য করার সেসব চিহ্ন প্রচলিত ছিলো না, যেগুলো পরবর্তীতে প্রচলিত হয়েছে, তাই এই শব্দটি মূল পাঠের সাথে লেখে দেওয়া হয়েছে।
এ থেকে বুঝা যায়, রাসূল সা. কর্তৃক বর্ণিত ব্যাখ্যাগুলো হয়তো অন্যান্য সাহবিও এভাবে লেখেছেন। এখন এই প্রচলনের ব্যাপক অনুমতি দেয়া হলে, কুরআনের মূল পাঠ ণির্নয় ও তার হেফাজত মাথা ব্যথার কারণ হয়ে যেতো। বস্তুত হাদীস লেখার নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এই বিরাট আশঙ্কার দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছিলো; কিন্তু কুরআনে কারীম থেকে আলাদা হাদীস লেখার প্রচলন সর্বযুগে অব্যাহত ছিলো।