আবু বকর সিদ্দীক
কুরবানি ও আকীকা আলাদাভাবেই করা উত্তম। তবে কেউ যদি উট,গরু বা মহিষ কুরবানি করে এবং তাতে নিজের বা পরিবারের কোনো সদস্যের আকীকার অংশ রাখতে চায়, তাহলে তা জায়েয। এর দ্বারা কুরবানী-আকীকা দুটোই আদায় হবে। শর্ত হলো, কোনো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না।
দলীল-১ আকীকাও এক ধরনের কুরবানী। কেননা হাদীস শরীফে আকীকার উপর ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। আর ‘নুসুক’ অর্থ কুরবানী। হাদীসের ভাষ্য এই-
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا أحب العقوق كأنه كره الاسم، قالوا يا رسول الله! نسألك عن أحدنا يولد له، فقال : من أحب منكم أن ينسك عن ولده فليفعل، على الغلام شاتان مكافأتان، وعلى الجارية شاة
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আকীকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,আমি ‘উকূক’ পছন্দ করি না। যেন তিনি ‘আকীকা’ নামটি অপছন্দ করলেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, তাহলে আমাদের নবজাতকদের ব্যাপারে করণীয় কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের থেকে যারা তার সন্তানের পক্ষ থেকে ‘নুসুক’ তথা ‘কুরবানি’ করতে চায়, সে যেন তা করে। ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি সমপর্যায়ের (তথা আকীকা করার উপযুক্ত) বকরী। আর মেয়ের জন্য একটি বকরী।
(দ্র. মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৭৯৬১; মুসনাদে আহমদ : ৬৭১৩, ৬৭২২; সুনানে আবু দাউদ (আকীকা অধ্যায়) ২৮৪২; সুনানে নাসায়ী : ৭/১৬২, ১৬৩)
এর দ্বারা বুঝা গেল, আকীকাও এক ধরনের কুরবানী। এছাড়া আকীকাও যে এক ধরণের কুরবানি এ বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বায় বর্ণিত একটি আছার দ্বারা-عن هشام، عن الحسن، وابن سيرين: ” أنهما كانا يكرهان من العقيقة ما يكرهان من الأضحية، وقال: وهي عندهما بمنزلة الأضحية، يأكل ويطعم
হিশাম রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি প্রখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. এবং মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে,তারা আকীকাতেও সে সব বিষয় অপছন্দ করতেন কুরবানিতে যা অপছন্দ করতেন। হিশাম রহ. বলেন, আকীকা হলো তাদের নিকট কুরবানির মতো। তার গোশত ব্যক্তি নিজে খাবে এবং অপরকেও খাওয়াবে।[ দ্র. মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা,হাদীস নং-২৪৭৪৩]
সুতরাং আকীকাও যখন কুরবানির মতো, তখন একটি গরু, উট বা মহিষ দ্বারা একাধিক ব্যক্তির (সর্বোচ্চ সাত জন পর্যন্ত) আলাদা-আলাদা কুরবানী আদায় হওয়ার হাদীসগুলো থেকে কুরবানী-আকীকা একত্রে আদায়ের অবকাশও প্রমাণিত হয়।
দলীল-২ সালাফের যুগেই দুই ধরনের কুরবানী এক পশু দ্বারা আদায় হওয়ার বিষয়টি হাদীস-আছারের দ্বারা প্রমাণিত।
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, يجزئ المتمتع أن يشارك في دم
অর্থ: ‘দমে জিনায়াত আদায়কারীর সাথে তামাত্তু হজ¦কারীও তার দমে শুকর আদায়ের জন্য শরীক হতে পারবে’।(দ্র.মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা,হাদীস নং-১২৯৪১)
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. বলেন, ” الجزور ، والبقرة ، عن سبعة يشترك فيه المضحون ، والمتمتعون ، والمحصورون “
অর্থ: ‘উট ও গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানী হতে পারে। আর এতে শরীক হতে পারে কুরবানীকারী, তামাত্তু হজ্বকারী এবং হজ্বের ইহরাম গ্রহণের পর হজ্ব আদায়ে অপারগ ব্যক্তি’।
(দ্র. সুনানু সায়ীদ ইবনে মানসূর,হাদীস নং-৩১০; তাহকীক, ডক্টর সা’দ আল হুম্মায়িদ হাফি.) দেখুন, তিন ধরনের কুরবানী একটি পশু দ্বারা আদায় হওয়ার বিষয়টি সালাফের যুগ থেকেই কত স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
সুতরাং আকীকাও যেহেতু এক ধরণের কুরবানি,তাই একটি উট, গরু বা মহিষে কুরবানির পাশাপাশি আকীকার জন্য অংশ রাখলে এর দ্বারা কুরবানি ও আকীকা উভয়টি আদায় হবে।
দলীল-৩ ‘কুরবানির সাথে আকীকা করা যাবে’ এ বিষয়টি ইসলামের সোনালী যুগের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ইমাম আবু হানীফা রহ.(১৫০ হি.) প্রণীত মাযহাবের স্বীকৃত ফতোয়া। নিম্নে হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থাবলী থেকে উদ্ধৃতি পেশ করা হলো-
ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (৩৭০হি.) লিখেন,
قال أبو جعفر: (وإذا كانت كلها لله تعالى، وأرادوها من وجوه مختلفة من هدي وقران وأضحية وغيرها: أجزأهم جميعًا).
অর্থ: কুরবানিতে যখন প্রত্যেকের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা,কিন্তু কারণ ভিন্ন ভিন্ন, একজনের উদ্দেশ্য হাদি,অপরজনের উদ্দেশ্য হজ্বে কেরানের দম,আরেকজনের উদ্দেশ্য কুরবানি বা অন্য কিছু, এক সাথে সকলেরটা আদায় হবে। (শরহু মুখতাসারিত তাহাবী,৭:৩৫২.দারুল বাশায়িরিল ইসলামিয়া)
ইমাম মালিকুল উলামা কাসানী রহ. (৫৮৭ হি. ) বলেন:
وكذلك إن أراد بعضهم العقيقة عن ولد ولد له من قبل؛ لأن ذلك جهة التقرب إلى الله تعالى – عز شأنه – بالشكر على ما أنعم عليه من الولد، كذا ذكر محمد – رحمه الله – في نوادر الضحايا
অর্থ: যদি কেউ কুরবানির সাথে আকিকার নিয়ত করে,তাহলে আদায় হয়ে যাবে। কেননা আকিকার দ্বারা উদ্দেশ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। সন্তান দানের মাধ্যমে আল্লাহ তার উপর যে অনুগ্রহ করেছেন,সেটার শুকরিয়া আদায়ের জন্য আকিকা করা হয়। এমনটা বলেছেন ইমাম মুহাম্মদ রহ.।(বাদায়িউসসানায়ে’,৬:২৯১.দারুল হাদীস ক্বাহেরা)
ইমাম ইবনু আবেদীন শামি রহ.(১২৫২ হি.) লিখেন,
كذا لو أراد بعضهم العقيقة عن ولد قد ولد له من قبل لأن ذلك جهة التقرب بالشكر على نعمة الولد ذكره محمد
অর্থ: এমনিভাবে যদি কেউ কুরবানির সাথে আকিকার ইচ্ছা করে,তাহলে আদায় হয়ে যাবে। কারণ, আকিকাও সন্তান দানের মাধ্যমে আল্লাহ তার উপর যে অনুগ্রহ করেছেন,সেটার শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি উপায়।(হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন,৬:৩৩৬;এইচ,এম সাইদ)
এ বিষয়ে আরো দেখুন-
১. আল-মাবসুত,ইমাম সারাখসি রহ. ১১:১৫;(মাকতাবায়ে রশিদিয়্যাহ)
২. আল মুহিতুল বুরহানী, ৮:৪৭৭,(ইদারাতুল কুরআন)
৩. ফাতাওয়া কাজিখান, ৩:২৪৬(মাকতাবাতুল ইত্তেহাদ)
৪. ফাতাওয়া বাযযাযিয়া, ৩:১৫৭(মাকতাবাতুল ইত্তেহাদ)
৫. তাবয়িনুল হাকায়িক,৬:৪৮৪(দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
৬. আল-ফাতাওয়াল হিন্দিয়াহ,৫:৩৫১(মাকতাবাতুল ইত্তেহাদ)
দলীল-৪
বর্তমান সময়ে আরববিশ্বের জনপ্রিয় ইসলামিক ওয়েবসাইট ‘ইসলাম ওয়েব’-এর ফতোয়াও হলো, কুরবানির সাথে আকীকা করা যাবে। ফতোয়াটির আরবী ভাষ্য হলো-
فذبح البقرة أو البدنة بنية أن يكون جزء منها عقيقة والآخر أضحية محل خلاف بين أهل العلم، بين مانع ومجيز، فأجاز الشافعية والحنفية ذلك… ومنعه المالكية والحنابلة…
ونرجو أن يكون في الأمر سعة، فلو ذبح الأخ السائل بقرته بنية أن يكون بعضها أضحية والآخر عقيقة فلا بأس، وإن ذبح للعقيقة بهيمة مستقلة وللأضحية أخرى فهذا أفضل للخروج من الخلاف.
অর্থ: ‘উট অথবা গরু যবেহ করা এই নিয়তে যে, এর সাত ভাগের কিছু ভাগ হবে আকীকা আর কিছু ভাগ হবে কুরবানি, এভাবে পশু যবেহ করা জায়েয হবে কিনা? এ বিষয়ে আহলে ইলমের মাঝে মতভেদ রয়েছে। শাফেয়ী ও হানাফী মাযহাবে এর অনুমোদন দেয়া হয়েছে… আর মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবে এর অনুমোদন দেয়া হয়নি।…
বিষয়টির মাঝে কিছুটা প্রশস্ততা থাকা উচিত। সুতরাং প্রশ্নকারী যদি তার গাভীটিকে যবেহ করেন এই নিয়তে যে,তার( সাত ভাগের) কিছু ভাগ হবে কুরবানি আর কিছু ভাগ হবে আকীকা,তাহলে এতে কোন অসুবিধা নেই।
তবে যদি তিনি আকীকার জন্য একটি স্বতন্ত্র পশু যবেহ করেন আর কুরবানির জন্য আরেকটি স্বতন্ত্র পশু যবেহ করেন, মতভেদ থেকে মুক্ত থাকার জন্য এটিই উত্তম হবে। (ইসলাম ওয়েব, ফতোয়া নং-১০২৭৪৫)
লেখক: সহকারী মুফতি, জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া রামপুরা ঢাকা
-এটি