মুফতি আব্দুর রহিম: হাদীস অস্বীকারকারীরা বলে, ‘হাদীসগুলো হিজরী সনের তৃতীয় শতাব্দিতে সংগৃহীত হয়েছে। এজন্য এগুলো আসল রূপের উপর অবশিষ্ট আছে বলে বিশ্বাস করা যায় না।’ কিন্তু এই বিভ্রান্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ, সর্বপ্রথম দেখা উচিৎ যে, হাদীস সংরক্ষণের প্রতি কিরূপ গুরুত্বারোপ রাসূলে আকরাম রা. এর যুগ থেকে এ পর্যন্ত করা হয়েছে। হাদীস সংরক্ষণের পদ্ধতি শুধু লেখাই নয়; বরং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য মাধ্যমও রয়েছে। গবেষণা থেকে জানা যায় যে, রিসালত যুগে এবং সাহাবায়ে কেরামের জামানায় হাদীস সংরক্ষণের জন্য নিম্নের তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
প্রথম পদ্ধতি: বর্ণনা মুখস্ত করা
হাদীস সংরক্ষণের প্রথম পদ্ধতি হলো, তা মুখস্ত করা। এই পদ্ধতি সে যুগে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ছিলো। আল্লাহ তা‘য়ালা আরববাসিকে অসাধারণ স্মরণশক্তি দান করেছিলেন। তাঁরা শুধু নিজেদেরই নয়, বরং নিজেদের ঘোড়াগুলোর বংশ পরিক্রমা পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলতো। এক এক জনের হাজার হাজার কাব্য মুখস্ত থাকতো। অনেক সময় কোন একটি বিষয় শুধু একবার শুনে বা দেখে পরিপূর্ণ মুখস্ত করে ফেলতো। ইতিহাসে এর অগণিত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তা হতে কিছু নিচে তুলে ধরা হলো।
বুখারী শরীফে হযরত জা’ফর ইবনে আমর আদ-দামরী রা. বর্ণনা করেন, একবার আমি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আদি ইবনুল খিয়ারের সাথে হযরত ওয়াহশী রা. এর সাক্ষাতে গেলাম। ওবায়দুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আমাকে চেনেন? ওয়াহশী রা. বললেন, আমি আপনাকে তো চিনি না। তবে আমার এতটুকু স্মরণ আছে যে, আজ থেকে বহু বছর পূর্বে একদিন আদি ইবনুল খিয়ার নামক এক ব্যক্তির কাছে গিয়েছিলাম। তার ওখানে সেদিন একটি শিশুর জন্ম হয়েছিলো। সে শিশুটিকে নিয়ে চাদর মুড়িয়ে তার দুধ মাতার নিকট নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। শিশুটির পুরো দেহ ঢাকা ছিলো। শুধু পা গুলো দেখেছিলাম। সে শিশুটির পায়ের সাথে আপনার পা দুটোর খুব বেশি মিল রয়েছে।
ভাবনার বিষয় হলো, যে জাতি এতো সাধারণ বিষয়গুলোকে এতটুকু নির্ভরযোগ্যতার সাথে মনে রাখে, তাঁরা রাসূল সা. এর বক্তব্য ও কর্মগুলোকে স্মরণ রাখার প্রতি কতটা গুরুত্বারূপ করবে। অথচ তাঁরা নিজেদের জন্য এগুলোকে মুক্তির পথ মনে করেন। বিশেষভাবে তাদের সামনে যখন রাসূলে আকরাম সা. এর বাণী এসেছিলো।
سنن الترمذي ت شاكر (৫ / ৩৪) عَن عَبدِ الرَّحمَنِ بنِ عَبدِ الله بنِ مَسعُودٍ، يُحَدِّثُ عَن أَبِيهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيهِ وَسَلَّمَ، قَالَ : نَضَّرَ الله امرَأً سَمِعَ مَقَالَتِي فَوَعَاهَا وَحَفِظَهَا وَبَلَّغَهَا،
তাই স্পষ্ট বিষয় হচ্ছে, সাহাবায়েকেরাম বিস্ময়করভাবেই এর উপর গুরুত্বারূপ করেছিলেন।
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. তাঁর কিতাব “الاصابة” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, একবার আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান হযরত আবু হুরায়রা রা. এর স্মরণশক্তির পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ডেকে এনে হাদীস বর্ণনা করার আবেদন করলেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. অনেক হাদীস শুনালেন। একজন লেখক তা লেখছিলো। অতঃপর হযরত আবু হুরায়রা রা. সেখান থেকে চলে গেলেন। পরবর্তী বছর তাঁকে আব্দুল মালেক পুনরায় ডাকালেন, তাঁকে বললেন, আপনি গত বছর যেসব হাদীস লিখিয়ে ছিলেন, সেই হাদীসগুলো সেই ধারাবাহিকতার সাথে শুনিয়ে দিন। হযরত আবু হুরায়রা রা. পুনরায় হাদীস শুনাতে আরম্ভ করলেন। লেখক এগুলো তাঁর লেখার সাথে মিলাচ্ছিলেন। কোন জায়গায় একটি হরফ, একটি বিন্দু এবং ক্ষুদ্রাংশও পরিবর্তন হয়নি। চমৎকার ব্যাপার হলো, যে ধারাবাহিকতা, ঠিক তা-ই ছিলো যে ধারাবাহিতায় গত বৎসর শুনিয়েছিলেন।
এ জাতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনাবলি একথার স্পষ্ট দলীল যে, আল্লাহ তা‘য়ালা তাদেরকে এই অসাধারণ স্মরণশক্তি শুধু হাদীস সংরক্ষণের জন্যই দান করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এমন স্মরণশক্তিই হাদীস লেখার মতো নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: আমলী নমুনা
হাদীস সংরক্ষণের দ্বিতীয় যে পদ্ধতি সাহাবায়েকেরাম অবলম্বন করেছিলেন, তা ছিলো আমল। অর্থাৎ তারা হুজূর সা. এর বক্তব্য ও কর্মগুলোর উপর হুবহু আমল করে তা স্মরণ রাখতেন। অনেক সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে, তারা কোন আমল করে বলেছেন, هكذا رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يفعل এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। কারণ, যে বিষয়টির উপর কেউ নিজে আমল করে সেটি পাথরের উপর খোদায়ের ন্যায় হয়ে যায়।
তৃতীয় পদ্ধতি: লিখে রাখা
হাদীস লেখার মাধ্যমেও সংরক্ষণ করা হয়েছিলো। ঐতিহাসিকভাবে হাদীস লেখার চারটি স্তর রয়েছে।
১. অগোছালো আকারে হাদীস লেখা।
২. কোন এক ব্যক্তি কর্তৃক হাদীস সংকলন করা, যা তিনি নিজে মুখস্ত রাখার জন্য করেছিলেন।
৩. বিভিন্ন অধ্যায়ে হাদীসগুলো বিন্যস্ত করা ব্যতিত সংকলন করা।
৪. বিভিন্ন অধ্যায়ে হাদীসগুলো সুবিন্যস্তরূপে সংকলন করা।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর, ঢাকা।
-এএ