মুফতি আব্দুর রহিম: হাদীস অস্বীকারকারীদের দ্বিতীয় মতের সারমর্ম ছিলো- ‘হুজূর সা. এর হাদীস সাহাবীদের জন্য প্রমাণ ছিলো কিন্তু আমাদের জন্য প্রমাণ নয়।’ কিন্তু এটি এতোই স্পষ্ট ভ্রান্ত যে, এর খন্ডনের জন্য বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই। তবে সারমর্ম হচ্ছে হুজূর সা. (নাউযুবিল্লাহ) এর রিসালাত শুধু সাহাবিদের যুগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। অথচ নিম্নের আয়াতগুলো তা সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
১. يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ الله إِلَيكُم جَمِيعًا (সূরা আরাফ : ১৫৮)
২. وَمَا أَرسَلنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا (সূরা সাবা : ২৮)
৩. وَمَا أَرسَلنَاكَ إِلَّا رَحمَةً لِلعَالَمِينَ (সূরা আম্বীয়া : ১০৭)
৪. تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الفُرقَانَ عَلَى عَبدِهِ لِيَكُونَ لِلعَالَمِينَ نَذِيرًا (সূরা ফুরকান : ১)
তাছাড়া মৌলিক প্রশ্ন হলো, কুরআন বুঝার জন্য রাসূলের শিক্ষার প্রয়োজন আছে কি না? যদি না হয়, তাহলে রাসূল কেন প্রেরিত হয়েছেন? আর যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সাহাবিদের তো শিক্ষার প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষার প্রয়োজন নেই! অথচ সাহাবায়ে কেরাম স্বয়ং কুরআন অবতরণের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছেন! অবতরণের কারণ সম্পর্কে বা শানে নুযুল সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়কিফহাল ছিলেন। তাদের সামনেই কুরআন নাযিলের পরিবেশ ছিলো। এসব থেকে আামরা বঞ্চিত।
হাদীস অস্বীকারকারীরা এর জবাবে সে পুরনো কথাই বলেন, যে রাসূল সা. এর আনুগত্য সাহাবায়ে কেরামের উপর মিল্লাতের কেন্দ্র হিসেবে ওয়াজিব ছিলো। রাসূল হিসেবে নয়। এ বিষয়টির জবাব প্রথমেই দেয়া হয়েছে।
হাদীস অস্বীকারকারীদের তৃতীয় মত ছিলো- ‘হাদীসগুলো প্রমাণ্য ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিকট তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে পৌঁছেনি।’ কিন্তু তাদের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এর উপর নিম্নোক্ত প্রমাণাদি রয়েছে।
১. আমাদের নিকট কুরআনে কারীমও ঐ সব মাধ্যমেই পৌঁছেছে যেসব মাধ্যমে হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছেছে। এবার যদি এসব অনির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে কুরআনে কারীম থেকেও হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। হাদীস অস্বীকারকারীগণ এর জবাবে বলেন, কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘য়ালা إِنَّا نَحنُ نَزَّلنَا الذِّكرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ (সূরা হিজর : ৯) বলে এর হেফাজরেত জিম্মাদারি নিয়েছেন। হাদীসের ব্যাপারে এমন কোন জিম্মাদারি নেননি।
প্রথম জবাব হচ্ছে, আয়াতটিও আমাদের নিকট সেসব মাধ্যমেই পৌঁছেছে যেগুলো আপনার উক্তি অনুযায়ী অনির্ভরযোগ্য। এর কী প্রমাণ যে, এই আয়াতটি কেউ নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করেনি?
দ্বিতীয় জবাব হচ্ছে, এই আয়াতে কোরআনে কারীমের হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়েছে। আর কুরআনে কারীম সর্বসম্মতিক্রমে তার অর্থ ও শব্দ উভয়ের নাম; শুধু শব্দের নাম নয়। সুতরাং এই আয়াত শুধু কোরআনে কারীমের শব্দকেই হেফাজতের জিম্মাদারি নেয় না, তার অর্থকেও হেফাজতের জিম্মাদারি নেয়। আর কুরআনে কারীমের অর্থের শিক্ষা হাদীসের মাধ্যমেই হয়েছিলো।
যদি বলা হয় যে, কুরআনুল কারীম যে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটি আমাদের নিকট এই মাধ্যমগুলোর কারণে প্রকাশিত হয়নি; বরং এর অলৌকিকত্ব ও ভাষাগত বালাগাত ও অলঙ্কারের কারণে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত সেই অলৌকিকত্ব হাদীসের মধ্যে নেই।
এর জবাব হচ্ছে, প্রথমত কুরআনুল করীম মু‘জিযা হওয়া আজকালের লোকদের জন্য চ্যালেঞ্জের আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত। আর চ্যালেঞ্জের আয়াতগুলোও সেসব মাধ্যমেই আমাদের কাছে পৌঁছেছে যে মাধ্যমে হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছেছে। তাই এওতো হতে পারে যে, এই অনির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মাধ্যমে কেউ এ আয়াতগুলোকে এজন্য বাড়িয়ে দিয়েছে যে, মানুষ যেন বুঝতে পারে কুরআন আল্লাহর পক্ষ হতে!
দ্বিতীয়ত: কুরআন মু‘জিযা হওয়া নির্ভর করছে একথা মেনে নেয়ার উপর যে, কুরআনের চেলেঞ্জের উত্তরে কেউ এমন কালাম পেশ করতে পারেনি। আর একথাটি হাদসের মাধ্যমেই আমরা জানতে পেরেছি।
২. যখন আপনি মেনে নিয়েছেন যে, হাদীস মানা ওয়জিব, তার ফলাফল বের হয় হাদীস কিয়ামত পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকবে। না হয় বলতে হবে যে, আল্লাহ তা‘য়ালা হাদীস মানা ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু তার হেফাজতের ব্যবস্থা করেননি। যেন বান্দার উপর সাধ্যাতীত বিষয়ের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। অথচ এ বিষয়টি আল্লাহ তা‘য়ালার আয়াত لايكلف الله نفسا الا وسعها এর সম্পূর্ণ বিরোধী।
৩. হাদীস অস্বীকারকারীরা বলে, হাদীসসমূহ অর্থাৎ (خبر واحد) স্বয়ং মুহাদ্দিসগণের ভাষায় ظني বা ধারণামূলক। আর কোরআনে কারিমের স্পষ্ট বিবরণ অনুযায়ী ধারণামূলক বিষয়ের অনুসরণ করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, وَمَا يَتَّبِعُ أَكثَرُهُم إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغنِي مِنَ الحَقِّ شَيئًا(ইউনুস : ৩৬)
এর উত্তর হচ্ছে : তাদের এই উক্তিও শুধু ধোকাবাজি। বাস্তব ঘটনা হলো , ظن শব্দটি আরবী ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহৃত। ১. অনুমান-আন্দাজ। ২. প্রবল ধারণা। ৩. প্রমান নির্ভর নিশ্চিত জ্ঞান।
কুরআন কারিমের নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে ظن শব্দটি, يقين এর অর্থে বা নিশ্চিত বিশ্বাসের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُلَاقُو رَبِّهِم (বাকারাহ : ৪৬) ২. قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُلَاقُو الله (বাকারাহ : ২৪৯) ৩. وَظَنَّ دَأوودُ أَنَّمَا فَتَنَّاهُ} (সোয়াদ : ২৩)
হাদীসকে অনুমান-আন্দাজের অর্থে ظني বলা হয় নাই। বরং কোথাও প্রবল ধারণার অর্থে আবার কোথাও ইয়াকীনের অর্থে ظني বলা হয়েছে। আর কুরআনে কারীমে যে ظن এর অনুসরণ করা হতে বারণ করা হয়েছে তা অনুমান-আন্দাজের অর্থে ব্যবহৃত। না হয় প্রবল ধারণাকে শরীয়তের অনেক মাসআলাতে প্রমাণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এটাকে প্রমাণ সাব্যস্ত করা ব্যতিত মানুষ একদিনও বেঁচে থাকতে পারবে না। কেননা গোটা বিশ্ব এই প্রবল ধারণার উপরই প্রতিষ্ঠিত। হাফেজ ইবনে হাজার (রহঃ) লেখেন, খবরে ওয়াহিগুলো এ ধরণের ظن বা ধারণাকে সৃষ্টি করে বটে, তবে যেসব খবরে ওয়াহিদ বিভিন্ন নিদর্শনাবলি দ্বারা সহায্য ও শক্তিপ্রাপ্ত, সেগুলো প্রমাণ নির্ভর নিশ্চিত জ্ঞানের ফায়দাও দেয়। যেমন: যেসব হাদীস হাফেজ ও ইমামগণ কতৃক বর্ণিত হয়েছে।
৪. যেসব হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছেছে, সেসব সূত্র অনির্ভরযোগ্য হওয়ার ফতুয়া লাগিয়ে দেয়া অজ্ঞতার প্রমাণ। বস্তুত হাদীসের হিফাজতের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা এক কথায় অতুলনীয়। তার বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের সংরক্ষন ইতিহাস জানা দ্বারা জানা যায়।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর, ঢাকা।
-এএ