মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ ।।
আমাদের জীবনে বিভিন্ন রকমের পরিস্থিতি আসে। সকল পরিস্থিতি সবসময় আমাদের কাছে বাঞ্ছিত হয় না। কবির ভাষায়, ‘নদীতে বাতাস সবসময় মাঝিমাল্লার ইচ্ছার অনুকূলে প্রবাহিত হয় না।’ বিপরীত দিকেও প্রবাহিত হয়। তবুও মাঝিকে দাঁড় টেনে যেতে হয়। গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে হয়। আমাদের জীবন-নদীতেও কখনো অনুকূল বাতাস বয়, কখনো প্রতিকূল। চারপাশের পরিস্থিতি কখনো বাঞ্ছিত ও প্রীতিকর হয়, কখনো অবাঞ্ছিত, অপ্রীতিকর। মুমিনের কর্তব্য, সর্বাবস্থায় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্মরণ রেখে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। এতেই কল্যাণ।
সমগ্র মানবতার মহান শিক্ষক আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী দারুণ সান্ত্বনার-বাণীই না আমাদের শুনিয়েছেন। তিনি বলেন-
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ، صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ
ঈমানদারের অবস্থা কী অপূর্ব! তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণের। আর এ শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য। যদি সে সুখ-সচ্ছলতা পায় তাহলে শোকর করে, ফলে তা তার জন্যে কল্যাণের হয়। আর যদি দুঃখ-অনটনের শিকার হয় তাহলে সবর করে, ফলে তা-ও তার জন্য কল্যাণের হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই পবিত্র হাদীস যেমন আমাদের জন্য পরম সান্ত¡নার বাণী তেমনি তা জীবনের বিচিত্র পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও করণীয় সম্পর্কে পরম নির্দেশনা-বাণীও।
পরিস্থিতি-মূল্যায়নের মানদণ্ড কিন্তু তা বাঞ্ছিত বা অবাঞ্ছিত হওয়া নয়। কারণ সব মানুষের জীবনই উভয় ধরনের পরিস্থিতি দিয়ে ঘেরা। এ থেকে কারো নিস্তার নেই। পরিস্থিতি-মূল্যায়নের মানদণ্ড হচ্ছে, তা কি শোকরের পরিস্থিতি, না সবরের- তা চিন্তা করা। শোকরের হলে আল্লাহর শোকরগোযারি করতে হবে। আর সবরের হলে সবর অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতি বাঞ্ছিত হোক আর অবাঞ্ছিত তা ভালো কি মন্দ, তা নির্ধারিত হবে আমার নিজের কর্মের দ্বারা। কাজেই পরিস্থিতির দিকে নয়, দৃষ্টি দিতে হবে নিজ কর্মের দ্বারা পরিস্থিতিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেই দিকে।
এখন সাধারণভাবে সবাই যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী করোনা-ভাইরাসের বিস্তারের কারণে সব অঙ্গনে একটি স্থবিরতা ও কর্মহীনতার পরিস্থিতি- এক্ষেত্রেও উপরের মূলনীতি প্রযোজ্য।
নিঃসন্দেহে তা একটি বিপদ। এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে রোনাজারি করা, তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করা কাম্য। এর পাশাপাশি আমরা চাই বা না চাই আমাদের অনেকের জীবনেই কম বেশি যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে একে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে ভালো কাজে ব্যবহারের চিন্তাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ণের উপায় কী? উপায় হচ্ছে একে ‘কর্মের অবসর’ হিসেবে মূল্যায়ন করা। আমাদের ব্যস্ত জীবনে অবসর খুব কম। অথচ আমাদের দ্বীনী-দুনিয়াবি অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় আছে, যা অর্জনে আমাদের কিছু অবসর দরকার। বিদ্যমান অবসরটিকে এ ধরনের কিছু কাজে ব্যয় করার চিন্তা করা যায়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিফযে কুরআন। কুরআনে কারীম বা এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হিফয করে ফেলা। এটি এমন এক মোবারক কাজ, যে কাজে সব বয়সের ও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই অংশ নিতে পারেন। শর্ত এইটুকু যে, কুরআন মাজীদ সহীহ-শুদ্ধভাবে তিলাওয়াতে সক্ষম হতে হবে। যাদের তিলাওয়াত শুদ্ধ তারা বর্তমান অবসর সময়টুকু এই মোবারক কাজে ব্যয় করতে পারেন। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাদের এখনো দেখে দেখে কুরআন মাজীদ শুদ্ধ করে পড়ার যোগ্যতা তৈরি হয়নি তাদের অবসর সময়ের একটি অংশ কুরআন শুদ্ধ করার মেহনতে ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়।
দ্বিতীয় কাজ, কুরআন-মাজীদের বাণী ও শিক্ষা জানার জন্য নির্ভরযোগ্য তাফসীর-গ্রন্থ অধ্যয়ন করা। এক্ষেত্রে যেমন উলামা-তলাবার উপযোগী তাফসীর-গ্রন্থ আছে তেমনি আছে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত পাঠকের উপযোগী গ্রন্থও। বিজ্ঞ আলিমগণের সাথে পরামর্শ করে প্রত্যেকে যদি তার উপযোগী তাফসীর-গ্রন্থ নির্বাচন করে একটু একটু পড়তে থাকেন তাহলে এটাও হতে পারে বিদ্যমান অবসরকে কাজে লাগানোর এক উত্তম উপায়।
তালিবে ইলম ভাইয়েরা তাদের উস্তায ও মুরব্বীদের পরামর্শ অনুযায়ী আরবী বা উর্দূ ভাষার নির্ভরযোগ্য কোনো একটি তাফসীর-গ্রন্থ নির্বাচন করে নিতে পারেন। এ অবসরে যদি কোনো একটি তাফসীর-গ্রন্থও আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলা যায় তাহলে তা অনেক বড় কাজ হতে পারে।
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ভাই-বোনেরাও তাফসীরে উসমানী, তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের কোনো একটি আদ্যোপান্ত পাঠ করার সংকল্প করতে পারেন। এই সবগুলো তাফসীরেরই বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়, ইংরেজি অনুবাদও দুর্লভ নয়।
এছাড়া সীরাত ও শামাইল বিষয়ে আলাদা অধ্যয়নের প্রয়োজন। এ দুই বিষয়েও প্রাচীন ও আধুনিক উভয় ধারারই আরবী-উর্দূ গ্রন্থ এবং সেগুলোর অনেকগুলোরই বাংলা-ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া যায়।
এছাড়া আছে হাদীস শরীফের নির্বাচিত অধ্যয়ন। আমাদের জীবনের সকল অঙ্গনেই আছে হাদীস ও সুন্নাহ্র নির্দেশনা। জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনের আইন-কানূন ছাড়াও হাদীস শরীফে আছে আকীদা-বিশ্বাস, আদব-আখলাক, ইবাদত-বন্দেগী, দুআ-যিকির, আখেরাতের স্মরণ, পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ইত্যাদি কত বিষয়ে কত উন্নত শিক্ষা। হাদীসের কিতাবের সংশ্লিষ্ট অধ্যায়গুলো থেকে এই আলোকিত শিক্ষা অর্জনের মধ্যেও কাটতে পারে আমাদের এই অবসর।
চিন্তা-ভাবনা করলে এরকম আরো কত প্রয়োজনীয় বিষয় বের হয়ে আসতে পারে, যা আমাদের জীবন ও কর্মের সংস্কার ও উন্নয়নে অশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
এখানে যে অধ্যয়নের কথা বলা হল তা শুধু ব্যক্তির নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়; বরং এ বিষয়ে শামিল করা যায়, নিজের স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের অন্যদেরও।
পরিবারের সকল সদস্যের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন ও দ্বীনদারি গঠনের প্রচেষ্টা আমাদের অপরিহার্য কর্মের তালিকাভুক্ত। তাই তাদেরও ইলমি উন্নতির লক্ষ্যে উপরোক্ত সকল বিষয়ে যদি ‘ঘরোয়া দরস’ বা ‘পারিবারিক পাঠচক্রের’ আয়োজন করা যায় তাহলে তা শুধু আমাদের ইলমি উন্নতির পথই খুলবে না, পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও একসাথে কিছু সময় কাটানোর এক উত্তম উপায়ও হতে পারে।
সারকথা এই যে, আমাদের জীবনের অবসরগুলো, তা ইচ্ছাকৃত অবসর হোক বা অনিচ্ছাকৃত, তা যদি ভালো ও গঠনমূলক কাজে কাটে তাহলে আখেরে তা আমাদের জন্য কল্যাণকরই সাব্যস্ত হবে।
আমরা কি আমাদের বর্তমান অবসরটিকে ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করব?
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
এনটি