কাওসার আইয়ুব।।
এক.
ইবরাহিমের মাথায় মুকুট। ঝলঝল করছে দেখতে। মুক্তা খচিতো খাটে মখমলের বিছানায় বসে আছে ইবরাহিম। পাশে ঘুমটা পরা বসা তার স্ত্রী। মোহনীয় ফুলের ঘ্রাণ। কাঁচা-পাকা ফুলগুলো শিশিরে ভেজা। বিস্তৃত বাগানের ভেতর তাদের এ মনোরম পরিবেশ।
বাগানের মাঝে দীর্ঘ সবুজ মিনার। পাশে বহমান নদী। ঝরণার বুক চিড়ে আসা মিষ্টি পানির নহর। দু’দিকে সারি সারি ফুলবাগান। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।
-মা তোমার জন্য সুসংবাদ এনেছি!
-কী সুসংবাদ বেটা!
-জানো মা তোমার দেয়া মহরানা কবুল করেছে। বিয়েতে রাজি হয়েছে সে। আমরা বিয়ে উদযাপন করছি।
আবছা অন্ধকার। রাতের শেষ ভাগ। অনেকটা নিরিবিলি। কিছুটা শীতল হাওয়া বয়ছে। উম্মে ইবরাহিমর রিতীমতই শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে ওঠে। কে যেন এসে ডেকে যায় তাকে। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি। মাত্রই ঘুম ছেড়ে উঠেছেন। স্বপ্নটা বেশ মনে পড়ছে তার।
ফজর হতে খানিক বাকি। এইতো আজান হচ্ছে। নামাজ শেষে তাসবিহগুলো আদায় করে নিচ্ছেন উম্মে ইবরাহিম, সকাল হয়েছে। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। প্রভাতের সোনালী রোদ। এক অপূর্ব দৃশ্য। উম্মে ইবরাহিম দরজা খুলেন। রাতে দেখা স্বপ্নের কথা ভাবছেন।
তার জীবনে এতো ভালো স্বপ্ন দেখেনি কখনো। এতো আনন্দঘন সকাল কাটায়নি উম্মে ইবরাহিম। যখনি স্বপ্নের কথা মনে পরছে তার ভেতরটা আনন্দে বড়ে উঠছে।
তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। ঠিক করেছেন, ব্যপারটি পারার ইমাম সাহেবকে অবশ্যই বলবেন। ইমাম আবু উবায়েদ মসজিদে বসা, উম্মে ইবরাহিম স্বপ্নের কথা বলতে অনেক আগ্রহ নিয়ে এসেছেন। বোরকা আবরিত। তাই বাইরে থেকে চিনার উপায় নেই।
-ইমাম সাহেব হুজুর! ইমাম সাহেব হুজুর!
-জী! বলুন, কী হয়েছে? উম্মে ইবরাহিম! এতো ব্যস্থ হয়ে ডাকছেন যে?
- ইমাম সাহেব হুজুর একটি শুভ স্বপ্নের কথা বলতে এসেছি।
-জী! অবশ্যি বলে ফেলুন।
তিনি পুরো ঘটনা খুলে বলেন।
দুই.
উম্মে ইবরাহিম বসরা শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারে এক পরহেজগার নারী। বংশ পরিচয়ে হাশেমী। তার সময়ে শত্রুরা মুসলিম ভূমিতে আক্রমণ করে বসে। মুসলমানদেরকে এলো পাতারে মারতে শুরু করে। তখন মুসলমানদের আত্মমর্যাদায় চরম আঘাত হানে, কাফেরদের এ নিষ্ঠুরতা।
তখন ইসলামি নেতারা হাইয়া আলাল জিহাদ, হাইয়া আলাল জিহাদ, বলে বসরা নগরির অলিতে গলিতে ডাকছে। তরুণ যুবকদেরকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে।
আবদুল ওয়াহেদ রহিমাহুল্লাহ তিনিও মঞ্চে গিয়ে অগনিঝরা ভাষণ দিচ্ছেন। জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি ছিলেন এক জন বড় আলেম এবং বীর মুজাহিদ। এক মজলিসে আবদুল ওয়াহেদ রহিমাহুল্লাহ জিহাদের উপকারিতা আলোচনা করছেন।
পুরুষ-নারী সহ সকলেই তার বক্তব্য শুনছে। বলছেন-শহিদের মর্যাদা আলেমদের অনেক উপরে। আল্লাহর জন্য মারা গেলে জান্নাতে পরম সুখে থাকবে। জান্নাতি যুবকদের স্ত্রী হবে সুনয়নাহুর। হুরদের অনেক গুনাগুণ বর্ণনা করছেন আবদুল ওয়াহেদ।
ঐ সম্মেলনে উম্মে ইবরাহিম ছিলো। হুরদের রূপ-সোর্ন্দযের কথা শুনে তিনি নিজ ছেলের পুত্রবধু বানাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই আবদুল ওয়াহেদের কথা শুনে সম্মেলনের মাঝেই সোজা হেঁটে তার কাছে যান।
উজ্জিবিত কণ্ঠে বলেন- হে বসরার ইমাম আবদুল ওয়াহেদ! আপনি তো আমার ছেলে ইবরাহিমকে ভালো করে চেনেন। বসরার অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা তার সঙ্গে নিজেদের মেয়েদেরকে বিবাহ দিতে চেয়েছে। আমি তাদের কারো ব্যাপারে সন্তুষ্ট নই। আমি মনে করি তারা ইবরাহিমের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু আপনি এখন যে মেয়ের কথা বললেন, তাকে আমার পছন্দ হয়েছে। অনেক ভালো লেগেছে তার বর্নণা।
আমার ইবরাহিমকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারলে অনেক খুশি হবো। আমি ঐ জান্নাতি মেয়েটিকে আমার ছেলের বউ বানাতে চাই। সে আমার বউমা হলে আমি অনেক সুখি থাকবো।
-আবদুল ওয়াহেদ আপনি কি ঐ মেয়েটির সাথে আমার ছেলেকে বিয়ে পড়িয়ে দিতে পারবেন? আমার ঘরে দশহাজার দিনার আছে সে টাকা বিয়ের মহরানা হিসেবে নিয়ে নিন এবং ইবরাহিমকে আপনাদের সাথে জিহাদে নিয়ে নিন যেন আল্লাহ তাআলা তাকে শাহাদাতের সৌভাগ্য নসিব করেন।
সে আমার জন্য এবং ইবরাহিমের বাবার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ পেশ করতে পারে।
- আপনার ছেলে শাহাদাতের মর্যাদা পেলে, আপনার জন্য আপনার সন্তানের জন্য এবং তার বাবার জন্য মহাসাফল্য হবে। আল্লাহর কসম এটা মহাসাফল্য হবে। ইবরাহিমের মা ইবরাহিমকে ডাকলো,
-জী! মা আমি হাজির।
-হে আমার আদরের সন্তান! তুমি কি নিজের জীবনকে যুদ্ধের ময়দানে উৎসর্গ করে দেয়ার শর্তে জান্নাতি এ মেয়েটিকে বিবাহ করতে রাজি আছো? -
আল্লাহর কসম আমি সন্তুষ্ট আছি মা। ইবরাহিমের মা আল্লাহর দিকে ফিরেন।
-হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো, আমি আমার আদরের ছেলেকে এ মেয়েটির সাথে বিয়ে দিচ্ছি, এ শর্তে যে, আমার ছেলে নিজেকে জিহাদের ময়দানে কোরবান করে দিবে। নিজের জীবনকে জিহাদের ময়দানে উৎসর্গ করবে। কখনো পিষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। কখনোই যুদ্ধের ময়দান থেকে পালন করবে না। সুতরাং তাকে কবুল করে নাও ইয়া রাব্বুল আলামিন।
এ কথা বলে ইবরাহিমের মা বাড়ি যায়। দশ হাজার দিনার নিয়ে আসে এবং বাজারে গিয়ে আদরের সন্তানকে এক নতুন ঘোড়া ও অস্ত্র ক্রয় করে দেয়। ইবরাহিম যুদ্ধে যেতে রণসাজে সজ্জিত হয়। তেলাওয়াতকারীরা তাকে ঘিরে কুরআন তেলাওয়াত করছে-
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ
ইন্নাল্লাহাশতারা মিনাল মু’মিনিনা আংফুসাহুম ও আমওয়ালাহুম বি আন্না লাহুমুল জান্নাহ।
অর্থ-নিশ্চয় আল্লাহ তয়ালা মুমিনদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। সুরা তাওবা- ১১১
ইবরাহিমের মা ইবরাহিমকে বিদায় দিচ্ছে, -হে আমার আদরের পুত্র তোমাকে সাবধান করছি এই যুদ্ধে কোনো দূর্বলতা দেখাবে না। তুমি তোমার সর্বস্ব দিয়ে লড়ে যাবে।
তুমি তোমার সর্বস্ব উজাড় করে লড়বে। বিদায় জানাতে মা তার আদরের ছেলেকে একটি কাফনের কাপড় দেয়, শেষবারে মতো কপালে চুমু খেয়ে নেয়।
-ও আমার আদরের সন্তান। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে এ দুনিয়াতে আর কখনোই একত্র না করেন। শেষ বিচারের দিনে মহামান্বিত রবের রহমতের ছায়ায় যেনো হয় আমাদের দেখা। মা’য়ের হৃদয় বিদারক কথাগুলো ইবরাহিমকে আরও বেশি উদ্ধিপ্ত করে। মুজাহিদগণ যাত্রা শুরু করে।
আবদুল ওয়াহেদ বলেন, আমরা শত্রুদের এলাকায় পৌঁছলাম। শত্রুদের মুখোমুখি হই। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ইবরাহিম প্রথম সারিতে থেকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে। ইবরাহিম দুটি পুরস্কারের অপেক্ষায় ছিলো।
একটি হচ্ছে বিজয়, অপরটি শাহাদাত। তার মায়ের দেয়া দোয়া তাকে আরো বেশি তেজদীপ্ত করে দিয়েছে। বাহাদুরির সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করছে ইবরাহিম।
তার ঘোড়া যেদিকে যাচ্ছে কাফেররা পরাজিত হচ্ছে। কাফেরদের গর্দান দ্বিখণ্ডিত করে দিচ্ছে। ইবরাহিম শত্রুদের শরীরে কাটা হয়ে দাঁড়ায়। শত্রুরা তার সাহসিকতা দেখে, একটি যুবককে ঠেকাতে যৌথভাবে আক্রমণ শুরু করে। ইবরাহিমকে শহীদ করে দেয়। ইবরাহিম শাহাদাতের সৌভাগ্য লাভ করে।
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
‘ওয়ালা তাহসাবান্নাল্লাযিনা কুতিলো ফী সাবীলিল্লাহি আমওয়াতা বাল আহইয়াউন ইংদা রব্বিহিম ইউরযাকুন’
অর্থ-যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত ও রিজিক প্রাপ্ত।সুরা আলি ইমরা-১৬৯।
জান্নাতি যুবক-১ পড়ুন- আবু কুদামার মুখে এক শহিদের গল্প
-এটি