মুফতি আব্দুর রহিম: এ পর্যন্ত হাদীসের পরিচয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখন علم الحديث এর পরিচয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। علم الحديث এর পরিচয় নিয়ে মুহাদ্দিসগণের মাঝে অনেক মত রয়েছে।
আল্লামা আইনী রহ. তার عمدة القاري কিতাবে লেখেছেন, علم الحديث علم يعرف به أقوال رسول الله صلى الله عليه وسلم وأفعاله وأحواله
আল্লামা সাখাবী রহ. তার فتح المغيث কিতাবে লেখেছেন, علم الحديث معرفة ما أضيف إلى النبى صلَّى الله عليه وسلم قولاله أوفعلا أوتقريراأوصفة
কিন্তু এই উভয় সংজ্ঞার উপর আপত্তি উঠে যে, এই সংজ্ঞা موقوف ও مقطوع হাদীসকে অন্তর্ভুক্ত করে না। অথচ ইলমে হাদীসে এসব নিয়েও আলোচনা করা হয়। এই আপত্তি হতে বাঁচার জন্য “فتح الباري” কিতাবে علم الحديث এর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়েছে, علم الحديث معرفة ما أضيف إلى رسول الله صلَّى الله عليه وسلم أوإلى صحابيِّ أو ألى من دونه قولا أوفعلاأو تقريراً
এই সংজ্ঞা যদিও موقوف-مقطوع হাদীসকে শামিল করে। কিন্তু এই সংজ্ঞাতে من دونه শব্দ থাকায় এতে রাজা বাদশাগণের কথা, কাজ ও অবস্থাও শামিল হয়ে গেছে। এমনিভাবে এই সংজ্ঞাতে علم تاريخও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। মনে হয় সংজ্ঞাদাতার উদ্দেশ্য এমনই ছিলো। এর মূল কারণ হচ্ছে একযুগ পর্যন্ত علم الحديث এর সাথে علم تاريخও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু এই সংজ্ঞা ঐ কাল পর্যন্ত সঠিক ছিলো যতদিন علم الحديث এর মাঝে علم التاريخ ও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে যখন থেকে علم الحديث একটি ভিন্ন ইলমের রূপ নিলো তখন থেকে علم الحديث এর সংজ্ঞা এমন হওয়া চাই যাতে علم التاريخ থাকবে না।
তাই সবচেয়ে উত্তম হতো যদি এই সংজ্ঞাটা এভাবে দেয়া হতো, علم الحديث هو معرفة ما أضيف إلى رسول الله صلَّى الله عليه وسلم أو إلى صحابي أو إلى من دونه ممن يقتدي بهم فى الدين قولاأوفعلاأوصفة أو تقريراً
এই সংজ্ঞার মাধ্যমে বাদশাহ ও আলেম নয় এমন সব ব্যক্তিদের কথা, কাজ ও অবস্থা علم الحديث হতে বের হয়ে ঐসব লোকদের কথা, কাজ ও অবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যারা আমাদের পথ প্রদর্শক। কারণ হাদীসের কিতাবসমূহ তাদের কথা, কাজ ও বর্ণনা দ্বারা ভরপুর।
علم الحديث এর আরো কিছু পরিচিতি কতক মুহাদ্দিসগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যিকভাবে এই সবের মাঝে বৈপরিত্ব পাওয়া যায়। এই বৈপরিত্বের মূল কারণ হচ্ছে علم الحديث এর প্রকার অনেক। কেউ এক প্রকারের সংজ্ঞা দিয়েছেন, কেউ অন্যটির সংজ্ঞা দিয়েছেন। আবার কেউ সবগুলো একত্র করে সংজ্ঞা দিয়েছেন। আমরা উপরে যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছি তা সকল প্রকারকেই শামিল করে। তথাপিও প্রত্যেককে আলাদা আলাদা বুঝা প্রয়োজন।
علم الحديث এর প্রকারভেদ
علم الحديث প্রথমত দুই প্রকার :
১. علم رواية الحديث
২. علم دراية الحديث
علم رواية الحديث এর পরিচিতি: هو علم ينقل أقوال النبى صلَّى الله عليه وسلم وأفعاله وأحواله بالسماع المتصل وضبطها وتحريها.
علم رواية الحديث সাত প্রকার:
১. رواية الأقران অর্থাৎ কোন সহপাঠী ( তথা স্বীয় শায়খের ছাত্র) থেকে, কিংবা জ্ঞান-বিদ্যায় সমতুল্য অথবা সমবয়স্ক কোন ব্যক্তি থেকে হাদীস রেওয়ায়েত করকে رواية الأقران বলে।
২. مدبج অর্থাৎ দুই সহপাঠী বা সমবয়স্ক বা সমতুল্য ব্যক্তির প্রত্যেকেই অপর থেকে হাদীস রেওয়ায়েত করাকে مدبج বলে।
৩. رواية الأكابر عن الأصاغر অর্থাৎ কোন রাবীর তার চেয়ে বয়সে কিংবা ইলমে কিংবা হাদীস মুখাস্থের দিক থেকে নিম্নের কারো সুত্রে হাদীস রেওয়ায়েত করাকে رواية الأكابر عن الأصاغر বলে।
৪. رواية الأصاغر عن الأكابر অর্থাৎ কোন রাবীর তার চেয়ে বয়সে কিংবা ইলমে কিংবা হাদীস মুখাস্থের দিক থেকে বড় কারো সুত্রে হাদীস রেওয়ায়েত করাকে رواية الأصاغر عن الأكابر বলে।
৫. السابق অর্থাৎ দুজন রাবী যদি একজন শায়েখ থেকে হাদীস আহরণ করেন এবং তাদের একজনের মৃত্যু অপরজনের পূর্বে হয়, তাহলে যিনি পূর্বে ইন্তেকাল করেন, তাকে السابق বলে।
৬. اللاحق এবং যিনি পরে ইন্তেকাল করেন তাকে اللاحق বলে।
৭. المهمل অর্থাৎ রাবী সনদ বর্ণনার সময় তার যে শায়খের নাম উল্লেখ করেন ঐ নামে তার আরেকজন শায়খ আছে, তবে উভয়ের পিতার নাম ভিন্ন অথবা উভয়ের পিতার নামও এক অথবা পিতার নামের সাথে সাথে দাদার নামও এক, অথবা নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, বংশের পরিচয় ও নিসবত সব এক। আর এখানে কোন জন রাবী, বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যে মাধ্যমে তা চিহ্নিত করেননি। ফতে প্রকৃত শায়খকে চিহ্নিত করতে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। যে শায়খের ব্যাপারে সন্দেহ লাগে তাকে المهمل বলে।
علم دراية الحديث এর পরিচিতি : هو علم يتعرف به أنواع الرواية وأحكامها وشروط الرواة وأصناف المرويَّات واستخراج معانيها .
অতএব, কোন হাদীস সম্পর্কে এ কথা জানা যে, এটি অমুক গ্রন্থে, অমুক শব্দে বর্ণিত হয়েছে, তা علم رواية الحديث। আর কোন হাদীস সম্পর্কে এ কথা জানা যে, এটি খবরে ওয়াহিদ না মাশহুর, সহীহ না দুর্বল, মুত্তাসিল না মুনকাতি’ অনুরূপভাবে এর রাবীগণ নির্ভরযোগ্য না অনির্ভরযোগ্য, তাছাড়া এ হাদীস থেকে কি কি বিধিবিধান বের হয়, এর মাঝে কোন বৈপরিত্ব্য আছে কি না? থাকলে কিভাবে এর অবসান করা যায়- ইত্যাদি বিষয় علم دراية الحديث এর সাথে সংশ্লিষ্ট।
علم دراية الحديث এবং علم أصول الحديث কে কোন কোন আলেম একই অর্থবোধক সাব্যস্ত করেছেন। আল্লামা উসমানী রহ. فتح الملهم কিতাবের মুকাদ্দামায় এ মত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া মাওলানা মুহাম্মাদ জাকারিয়া রহ. ও أوجز المسالك এর ভূমিকায় এই মতই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়টি আপত্তিকর। কারণ, আমরা উপরে علم دراية الحديث এর যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছি তা আল্লামা ইবনুল আকফানি রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে।
আমাদের জানা মতে তিনিই সর্বপ্রথম علم الحديث এর এই বিভাজন করেছেন। পরবর্তীতে সবাই তার অনুসরণ করেছে। এ কারণেই, আল্লামা সুয়ূতি রহ. تدريب الرأوي কিতাবে এই বিভাজন আল্লামা ইবনুল আকফানি রহ. এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এই সংজ্ঞায় গভীরভাবে লক্ষ্য করলে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, علم دراية الحديث - علم أصول الحديث এর مرادف বা সমর্থবোধক নয়। কারণ, এই পরিচিতির মধ্যে অর্থ বের করার কথাও উল্লেখ রয়েছে, যাতে বুঝা যাচ্ছে, হাদীস হতে মাসআলা বের করাও علم دراية الحديث এর অন্তর্ভুক্ত।
অথচ علم أصول الحديث এ আহকাম বের করার কোন আলোচনাই নেই। সুতরাং সহীহ কথা হচ্ছে, علم دراية الحديث ও علم أصول الحديث এর মাঝে عموم و خصوص مطلق এর নিসবত। علم دراية الحديث হচ্ছে আ‘ম। علم أصول الحديث হচ্ছে খাস।
এই হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, علم دراية الحديث ও দুই প্রকার।
১. علم أصول الحديث যাতে হাদীসের সনদ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
২علم فقه الحديث . যাতে হাদীসের মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করা হয়।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া জহিরুদ্দিন আহমদ মাদরাসা মানিকনগর, ঢাকা।