শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তালাক পতিত হবে কি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।আবু সাঈদ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ।।

কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে এক মাজলিসে বা একসাথে তিন তালাক দেয় তাহলে কয় তালাক পতিত হবে, এ ব্যাপারে তিনটি মাযহাব প্রসিদ্ধ আছে। যথা-
১. শি‘আদের শাখা জা’ফরীদের মাযহাব হলো: এর দ্বারা কোনো তালাক হবে না। যেহেতু সালাফে সালেহীনের কারো থেকে এ ধরনের উক্তি বর্ণিত হয়নি, তাই এ মাযহাব বাতিল। এ নিয়ে কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। (তাকমিলায়ে ফাতহুল মলহীম: ১/১১১, ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়াহ: ১৭/৯)
২. কোনো কোনো আহলে জাহের এবং ইবনে তাইমিয়াহ রহ. ও ইবনুল কাইয়্যিম রহ.-এর মাযহাব হলো: এর দ্বারা এক তালাক হবে, যদিও তালাক দাতা তিন তালাকের নিয়ত করে থাকে। (তাকমিলায়ে ফাতহুল মলহীম: ১/১১৫)
৩. সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত উমর, আলী, ‘উসমান, ইবনে মাসউদ, ইবনে উমর, ইবনে আমর, উবাদাহ বিন সামিত, আবূ হুরাইরা, ইবনে আব্বাস, ইবনে যুবায়ের, আসেম বিন উমর ও হযরত আয়িশা রা.-সহ আরো অনেক সাহাবী এবং ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী রহ.-সহ অধিকাংশ তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের মাযহাব হলো: এক মাজলিসে বা একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক হয়ে যাবে এবং অন্যত্র বিবাহের পর দ্বিতীয় স্বামীর সাথে মেলামেশা না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামীর জন্য উক্ত স্ত্রী হালাল হবে না।

তৃতীয় মাযহাবের দলীলঃ
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে নবী! বলে দিন, যখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ইচ্ছা করো, তখন তাদের ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তালাক দিও...। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ বের করে দিবেন’ (সূরা তালাক: ১-২)
এ আয়াতে তালাকের শরঈ পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
আর তা হলো, এমনভাবে তালাক দেয়া যার পরে ইদ্দত আসে এবং স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে।
এ আয়াত প্রমাণ করে যে, ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য না রেখে তালাক দিলেও তালাক হয়ে যাবে। কেননা যদি তালাক না হয়, তাহলে সে নিজের উপর জুলুমকারীও হবে না এবং স্ত্রীকে ফেরত নেয়ার পথও বন্ধ হবে না; যেদিকে এ আয়াত ইশারা করছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ বের করে দিবেন”।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এখানে পথ বের করার অর্থ হলো ফেরত নেয়ার সুযোগ থাকা, যা একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. একব্যক্তি তার স্ত্রীকে একশত তালাক দিলে হযরত ইবনে আব্বাস রা. তাকে বললেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের নাফরমানী করেছো, তোমার স্ত্রী তোমার থেকে বায়েনা হয়ে গেছে। তুমি তো আল্লাহকে ভয় করোনি যে, আল্লাহ তোমার জন্য কোনো পথ বের করে দিবেন। অতঃপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ বের করে দেন”। (ই’লাউস সুনান: ৭/৭০৮, আস সুনানুল কুবরা, বাইহাকী: ৭/৫৪২, হা. নং ১৪৯৪৪)

৩. হযরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলো। অতঃপর ঐ মহিলা অন্যজনকে বিবাহ করলে সেও তাকে তালাক দিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হলো, সেকি প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘না। যতোক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী প্রথমজনের মতো ঐ মহিলার মধু আস্বাদন না করবে’, অর্থাৎ যতোক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী তার সাথে সহবাস না করবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত সে প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে না। (সহীহ বুখারী: ৫২৬১)

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, এটা রিফা‘আ বিন ওয়াহাবের ঘটনা- যে তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছিলো, এটাই স্পষ্ট। রিফা‘আ আল কুরাযীর ঘটনা নয়, যে তার স্ত্রীকে সর্বশেষ তালাক দিয়েছিলো। যে ব্যক্তি উক্ত দু’জনকে এক মনে করেছে, সে ভুল করেছে। ভুলের উৎস হলো, তালাকপ্রাপ্তা উভয় মহিলাকেই আব্দুর রহমান বিন জাবীর রা. বিবাহ করেছিলেন। (ফাতহুল বারী: ৯/৫৮১)

৪. হযরত উয়াইমির রা. লি‘আনের পর বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি আমার স্ত্রীকে রাখি তাহলে তার উপর মিথ্যারোপ করেছি’। একথা বলে তিনি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দিলেন। (বুখারী: ৫২৫৯)
আল্লামা যাহেদ কাউসারী রহ. বলেন, কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এ কাজকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখান থেকে উম্মত এটাই বুঝেছে যে, একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হয়ে যায়, যদি উম্মতের এ বুঝ সহীহ না হতো তাহলে সঠিকটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশ্যই বলে দিতেন। (তাকমিলায়ে ফাতহুল মলহীম: ১/১১২, ই’লাউস সুনান: ৭/৭০৬)

৫. হযরত হাসান বিন আলী রা. তার স্ত্রী আয়িশা বিনতে ফযলকে একসাথে তিন তালাক দিলেন। অতঃপর তার স্ত্রীর আবেগময় কথা শুনে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, যদি আমি নানাকে (অন্য বর্ণনায় তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন) একথা বলতে না শুনতাম, “কোনোব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, তবে ঐ স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ না বসা পর্যন্ত তার জন্য হালাল হবে না”- তাহলে অবশ্যই তাকে ফেরত নিতাম । (সুনানে বাইহাকী হা. নং ১৪৯৭১)

৬. মাহমূদ বিন লাবীদ রা. হতে বর্ণিত, একব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগান্বিত হয়ে যান। (নাসাঈ হা. নং ৩৪৩১) এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রাগান্বিত হওয়াই তিন তালাক হয়ে যাওয়ার প্রমাণ। কেননা, একসাথে তিন তালাক দেয়া গুনাহের কাজ। এ গুনাহের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারাজ হয়েছিলেন।

৭. হযরত ইবনে উমর রা. তার স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দেন। এ হাদীসের শেষে আছে যে, হে আল্লাহর রাসূল! যদি তাকে তিন তালাক দিয়ে দিতাম তাহলে কি তাকে ফেরত নিতে পারতাম? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তখন তো সে তোমার থেকে বায়েন (সম্পূর্ণ পৃথক) হয়ে যেতো এবং তোমার গুনাহ হতো। (সুনানে দারাকুতনী হা. নং ৩৯২৯)

৮. ওয়াকে বিন সাহবান রা. বলেন যে, ইমরান বিন হাসীন রা.কে একব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, যে তার স্ত্রীকে এক মাজলিসে তিন তালাক দিয়েছে। ইমরান রা. উত্তর দিলেন, সে তার প্রতিপালকের নাফরমানি করেছে এবং তার জন্য তার স্ত্রী হারাম হয়ে গেছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হা. নং ১৮০৮৮)

৯. হযরত উমর রা.-এর কাছে এক ব্যক্তিকে আনা হলো, যে তার স্ত্রীকে একহাজার তালাক দিয়েছে; আর সে বলছে, এর দ্বারা আমি খেল-তামাশা করেছি। হযরত উমর রা. তাকে বেত্রাঘাত করে বললেন, একহাজার থেকে তোমার জন্য তিনটিই যথেষ্ট হয়ে গেছে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা. নং ১১৩৪০, সুনানে বাইহাকী হা. নং ১৪৯৫৭)

১০. মুহাম্মাদ বিন ইয়াছ রহ., ইবনে আব্বাস ও আবূ হুরাইরা রা.কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, গ্রামের একলোক তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বেই তিন তালাক দিয়েছে। এ সম্পর্কে আপনাদের মতামত কী? ইবনে আব্বাস রা. আবূ হুরাইরা রা.কে বললেন, আপনার কাছে একটি জটিল মাসআলা এসেছে, আপনি এর সমাধান দিন। আবূ হুরাইরা রা. বললেন, এক তালাক তাকে বায়েন করে দিয়েছে আর তিন তালাক তাকে হারাম করে দিয়েছে, যতোক্ষণ না সে অন্যজনকে বিবাহ করে। ইবনে আব্বাস রা.ও অনুরূপ উত্তর দেন। (মুআত্তা ইমাম মালেক হা. নং ৬৫৯)
এখানে মাত্র কয়েকটি হাদীস পেশ করা হলো। এছাড়া সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈ থেকে আরো অনেক হাদীস ও ফাতাওয়া আছে, যেগুলো পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। এগুলো দ্বারা প্রমাণিত হলো: ‘তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে, লা-মাযহাবী ভাইদের মতানুযায়ী তিন তালাকে এক তালাক হবে না’।
ইজমায়ে উম্মাত:

১.হাফেজ ইবনে রজব রহ. বলেন, ‘জেনে রাখো! কোনো সাহাবা, কোনো তাবেঈ ও সালফে সালেহীনের মধ্যে যাদের কথা হালাল-হারাম ও ফাতাওয়ার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য হয়, তাদের কারো থেকে এ ধরনের সুস্পষ্ট কথা বর্ণিত হয়নি যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার পর একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক ধরা হবে’। (ই’লাউস সুনান: ৭/৭১০)

২. ইবনে তাইমিয়া রহ. (যিনি এক তালাক হওয়ার প্রবক্তা) বলেন, একসাথে তিন তালাক দিলে স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে এবং তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে। এটা ইমাম মালেক, ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আহমাদের শেষ উক্তি এবং অধিকাংশ সাহাবা ও তাবেঈ থেকে বর্ণিত। (ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়াহ: ১৭/৮)

৩. ইবনুল কাইয়্যিম রহ. (তিনিও এক তালাকের প্রবক্তা) বলেন, ‘এক সাথে তিন তালাক দিয়ে দিলে তালাক হওয়ার ব্যাপারে চারটি মাযহাব আছে। (ক) তিন তালাকই হয়ে যাবে, এটা চার ইমাম, অধিকাংশ তাবেঈ ও সাহাবার মাযহাব...।’ (লাজনাতুত দায়িমাহ-এর উদ্ধৃতিতে আহসানুল ফাতাওয়া: ৫/৩৬৬)

এছাড়াও হাফেজ ইবনুল হুমাম ফাতহুল ক্বদীরে, ইবনে হাজার ফাতহুল বারীতে, ইমাম তহাবী শরহু মাআনিল আসারে, আবূ বকর জাসসাস আহকামুল কুরআনে, আবূল ওয়ালীদ বাজী আল-মুনতাকাতে, ইবনুল হাদী সিয়ারুল হাসসি ফী ইলমিত তালাকে, আল্লামা যুরকানী শরহে মুআত্তায়, ইবনুততীন শরহে বুখারীতে, ইবনে হাযাম জহেরী মুহাল্লাতে, আল্লামা খত্তাবী শরহে সুনানে আবূ দাউদে, হাফেয ইবনে আব্দুল বার তামহীদ ও ইস্তিযকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, হযরত উমর রা.-এর যুগে একই মাজলিসে তিন তালাকে তিন তালাক হওয়ার উপর সাহাবায়ে কিরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, ‘সাহাবীগণের ইজমা দলীল হওয়ার বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মধ্যে মতৈক্য কায়েম হয়েছে।’ (ফতহুল বারী: ১৩/২৬৬)

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘মাশায়েখ ও ইমামগণের মধ্যে কোনো বিষয়ে ইজমা কায়েম হলে তা অকাট্য দলীল হিসেবে বিবেচিত হবে’। (উমদাতুল আসাস: পৃ. ৪২)
ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়া রহ. বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত ও সাহাবীগণের আমলের পর আর কারো কথা মেনে নেয়া হবে না।’ (এগাসাতুল লাহফান: পৃ. ১৯২)

৪. চার ইমামের মাযহাবের বিপরীত যা আছে, তা ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থী, যদিও তাতে অন্যদের দ্বিমত থাকে। (আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের : পৃ.১৬৯)
উপরিউক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেলো যে, এক মাজলিসে বা একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হবে; এক তালাক নয়।
২য় মাযহাবের দলীল ও তার জবাব:

১. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, হযরত রুকানা রা. তার স্ত্রীকে এক মাজলিসে তিন তালাক দিলেন এবং পরে তিনি খুব মর্মাহত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তুমি কীভাবে তালাক দিয়েছো? তিনি বললেন, আমি তিন তালাক দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এক মাজলিসে দিয়েছো? তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা এক তালাক, যদি চাও তাহলে তাকে ফিরিয়ে নাও। (মুসনাদে আহমাদ: ২৩৯১)

জবাব: এ ঘটনার বর্ণনায় ভিন্নতা পাওয়া যায়। এখানে আছে যে, তিনি স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছেন। আর আবূ দাঊদ শরীফের বর্ণনায় আাছে যে, ‘বাত্তাহ’ শব্দ দ্বারা তালাক দিয়েছেন। এ দুই ধরনের বর্ণনার কারণে ইমাম বুখারী রহ. এ হাদীসকে ‘মা‘লূল’ বলেছেন। ইবনে আব্দুল বার রহ. এ হাদীসকে যঈফ বলেছেন। (আত-তালখীসুল হাবীর: ১৬০৩)
ইমাম জাসসাস ও ইবনে হুমাম রহ. মুসনাদে আহমাদের বর্ণনাকে ‘মুনকার’ বলেছেন। (তাকমিলাহ: ১/১১৫)
ইবনে হাজার রহ. বলেন, ইমাম আবূ দাউদ রহ. ‘বাত্তাহ’ শব্দ দ্বারা তালাক দেয়াকে রাজেহ বলেছেন। কোনো বর্ণনাকারী এটাকেই তিন তালাক বুঝে সেভাবে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে ইবনে আব্বাস (রা)-এর পরবর্তী হাদীস দ্বারাও দলীল দেয়া যাবে না। (ফাতহুল বারী: ৯/৪৫৪, তাকমিলাহ: ১/১১৫)

২. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে, আবূ বকর রা.-এর যুগে ও খিলাফতে উমর রা.-এর প্রথম দুই বছর (অন্য বর্ণনায় তিন বছর) তিন তালাক এক তালাক ছিলো। অতঃপর হযরত উমর রা. বলেন, লোকেরা এমন বিষয়ে তাড়াহুড়া করছে, যে বিষয়ে তাদের অবকাশ ছিলো। হায়! যদি আমি তাদের উপর তা কার্যকর করতাম। অতঃপর তিনি তা কার্যকর করলেন। (মুসলিম: ৩৬৫৪)

জবাব: ক. হাফেজ আবূ যুরআহ রহ. বলেন, এ হাদীসের অর্থ হলো, বর্তমানে লোকদের একসাথে তিন তালাক দেয়ার যে প্রচলন দেখা যাচ্ছে তা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, আবূ বকর রা.-এর যুগে ও খিলাফতে উমর রা.-এর প্রথম দুই বছরে ছিলো না। তখন লোকেরা সুন্নাত তরীকায় তিন তুহুরে তিন তালাক দিতেন। (সুনানে বাইহাকী: ১৪৯৮৪)

খ. আর যদি হাদীসের অর্থ এই হয় যে, একসাথে তিন তালাক দিলে বর্তমানে তিন তালাক ধরা হবে, অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, আবূ বকর রা.-এর যুগে ও খিলাফতে উমর রা.-এর প্রথম দুই বছর তা এক তালাক ধরা হতো। তাহলে এর উত্তর হলো: এ মাযহাবের দুটি হাদীস, উভয়টি ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। অথচ তার ফাতাওয়া হলো, একসাথে বা এক মাজলিসে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হয়ে যায়। যা দলীল নং ২ ও ১০-এ উল্লেখ করা হয়েছে। আর ইয়াহইয়া বিন মাঈন, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল কত্তান, আহমাদ বিন হাম্বল ও আলী ইবনুল মাদীনীর মতো বড় বড় মুহাদ্দিসীনের মাযহাব হলো, যখন কোনো রাবী তার হাদীসের বিপরীত আমল করেন বা ফাতাওয়া দেন, তখন তার বর্ণিত হাদীসটি আমলযোগ্য থাকে না। সুতরাং ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীসদ্বয়ও আমলের যোগ্য নয়; বিভিন্ন আপত্তির কারণে তা অগ্রহণযোগ্য। (ই’লাউস সুনান : ৭/৭১৬)

গ. এ হাদীস একটি বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন- যদি কোনোব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলতো, তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক এবং বিচারকের সামনে দাবী করতো যে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার বলে প্রথমটির তাকিদ করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো; ভিন্ন তালাক উদ্দেশ্য ছিলো না, তাহলে কাযী তার দাবি কবূল করতেন এবং তার কথাকে বিশ্বাস করে এক তালাকের ফাতাওয়া দিতেন। কিন্তু হযরত উমর রা.-এর যুগে লোকজন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের দীনদারী কমতে থাকে, তখন হযরত উমর রা. বিচার ব্যবস্থায় এ ধরনের দাবি কবূল না করার আইন র্কাযকর করেন এবং ঐ শব্দ দ্বারা তার বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নেন, তথা তিন তালাক হওয়ার ফাতাওয়া কার্যকর করেন। (তাকমিলাহ: ১/১১৪, ফাতহুল বারী: ৯/৪৫৬)
যদি তাই না হতো এবং উমর রা.-এর এ সিদ্ধান্ত শরী‘আতে মুহাম্মাদীর বিপরীত হতো, তাহলে ইবনে আব্বাস রা.-সহ সকল সাহাবায়ে কিরাম কখনোই তা মেনে নিতেন না।
যেমন- উম্মে ওলাদকে বিক্রি করা, এক দিনারকে দুই দিনারের মাধ্যমে বিক্রি করা, এবং হজ্জে তামাত্তু-এর মাসআলায় হযরত ইবনে আব্বাস রা. স্পষ্ট-ভাষায় হযরত উমর রা.-এর বিরোধিতা করেছেন। (আহসানুল ফাতাওয়া: ৫/৩৬৯)
যদি কেউ বলে যে, হযরত উমর রা.-এর ভয়ে সাহাবীরা তার প্রতিবাদ করেনি (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক), তাহলে সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে এরূপ ধারণা পুরা দীনকে ভিত্তিহীন করে দিবে, যা কোনো অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, কারো জন্য এ ধারণা করা জায়েয নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরী‘আত পরিপন্থী কোনো বিষয়ের উপরে একমত হয়েছেন। (মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া: ১৭/২২)

সর্বশেষ কথাঃ আমাদের গাইরে-মুকাল্লিদ বন্ধুদেরকে অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা মদীনার আমল দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন। সৌদি সরকার মক্কা-মদীনাসহ সে দেশের বড় বড় উলামাদের নিয়ে গঠিত কমিটিকে এ মাসআলার তাহকীক পেশ করার নির্দেশ দেয়। তারা দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একসাথে বা এক মাজলিসে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। (এঘটনা আহসানুল ফাতাওয়ার ৫ম খণ্ডের ২২৫-৩৭২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে) । এক্ষেত্রে তাদের জবাব কী হবে? আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে হক মেনে নেয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ