কাওসার আইয়ুব।।
সুরেলা কণ্ঠ, বিপ্লবী চিৎকার ও বুক ভরা স্বপ্নের নাম আঈনুদ্দিন আল আজাদ রহ.। নষ্ট তরঙ্গ, রুগ্ন শ্রোতের উল্টো গিয়ে সুস্থ চিন্তা, বর্ণিল মানষিকতার ফেরি করতেন তিনি।
১৯৭৭ সালের ১ মার্চ খুলনার অন্তর্গত ঝিনাইদহ জেলার হাজরাতলা গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে আজাদের শুভ আগমন ঘটে। নিজ গ্রামেই মক্তব পেরিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। এরপর ঝিনাইদহ শহরের কাস্টসাগরা দাখিল মাদরাসায় আলিম ও ফাজিল শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স শেষ করেন।
তিনি ছিলেন সঙ্গীতের সুর সম্রাট। বয়ানের ময়দানে সাহসী বক্তা। যুবকদের অত্যন্ত পছন্দের আলোচক। ইসলাম প্রচারে ছিলেন নির্বিক। সকল যানজট এড়িয়ে ইসলামের সুন্দর শান্তিময় দীনের প্রতি আহ্বান ছিল তার জীবন-কর্ম।
বিপ্লবী বক্তব্যের কারণে কারাবরণ ছিল তার ভাগ্য। শাহাদাতের তৃষ্ণা ছিল তার জীবনোদ্দেশ্য। লৌহ কপাটের ভেতর থেকে তিনি মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে এমনই বলেছিলেন।
নিচে পাঠকদের জন্য তার চিঠিটি তুলে ধরছি। যা তিনি কারগার থেকে তার প্রিয় মায়ের উদ্দেশে লিখেছিলেন।
‘চিঠি,
মা! আশা করি সুস্থ আছো। আমি তোমাদের দোয়ায় অনেক ভাল আছি।
পর সংবাদ, হয়তো তুমি আমার জন্য খুব চিন্তা করছো। হয়তো কান্নাকাটিও করছো। তুমি যদি কষ্টে থাকো, আমি যতদূর থাকি টের পাই। আবার আমার কিছু হলে তুমি বুঝতে পারো। তাই তুমি যদি চিন্তা করো, কান্নাকাটি করো, তাহলে আমার এই কারাগারের মধ্যে থাকা কষ্ট হয়ে যাবে।
আমি যদি খারাপ থাকতাম তাহলে তুমি চিন্তা করতে পারতে। আমি অন্য সকলের চেয়ে ভালো আছি। আমি এখানে ইমামতি করি। জেলের সবাই আমাকে আদর করে। খাবার খাওয়ায়। সবচেয়ে ভালো জায়গায় শুইতে দেয়। বাইরের চেয়ে এখানে অনেক ভালো আছি। শুধু এতোটুকু কষ্ট যে, বাইরে যাওয়া যায় না। সুতরাং তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই!
আমি তো চুরি ডাকাতি করে জেলে আসিনি। আমি এসেছি আল্লাহর জন্য। তুমি না আমাকে আল্লাহর জন্য সপে দিয়েছো। আমি যদি আমার পথে মারাও যাই তাহলেও তুমি দুঃখ করবে না। আমি আল্লাহর রাস্তায় মারা গেলে তুমি কাঁদবে না। বরং খুশী হয়ে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবে-এই বলে যে, আমি শহীদের মা হয়েছি। হ্যাঁ! আমি এটাই চাই!
এখনো তেমন কোনো পরীক্ষা আসেনি। সুতরাং এত সকালে অধৈর্য হলেতো চলবে না। তুমি শুধু আমার জন্য বুকভরে দোয়া করবে, আমি যেন আল্লাহর পথ থেকে সরে না যাই।
আব্বার ফোনের সংবাদ পেয়েছি। সংগঠনের ছেলেরা সবসময় আমার খোঁজ খবর নিচ্ছে। যা দরকার সব দিচ্ছে। আর সিরাজুলকে নিয়ে তোমাদের কাউকে চিন্তা করতে হবে না। সেজো ভাই, ছোটো ভাই এবং ভাবিদের সবাইকে দোয়া করতে বলবে।
মা! তোমার জন্য একটা খুশির সংবাদ আছে। জেল থেকে বেরিয়ে বাড়িতে এসে তোমাকে একা একা শোনাবো। চিন্তা করবেন না। লক্ষ্মী আমার, তুমি চিন্তা করলে আমি কষ্ট পাই। তাহলে আজ আর না।
ইতি,
তোমার আইনুদ্দিন আল আজাদ
তারিখ: ৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৯
সংগ্রামী জীবনের মহাপুরুষ ছিলেন আইনুদ্দিন আল আজাদ রহ.। তার জীবনের প্রতিটা সময়কে আল্লাহর জন্য সঁপে দিয়েছিলেন। এরপর এক বর্ণাঢ্য জীবন শেষে গত ২০১০ সালের ১৮ জুন শুক্রবার সকাল ৬ টা ৩০ মিনিটে তিনি নাটোর থেকে ফেরার পথে লালপুর নামক জায়গায় এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হোন। ইন্নালিল্লাহি ওয়িন্না ইলাইহী রাজিউন।
তিনি ছিলেন সংগ্রামী এক বীর। তাকে ভুলা যায় না। তাই আজকের আজাদ সন্ধ্যায় হোক আমাদের এ প্রতিজ্ঞা, জীবনের সবটুকু আমরা আল্লাহর জন্য সপে দিবো। আজ আমাদের মায়েরা যেন আজাদের মায়ের মতো উদার মনের হতে পারে। আল্লাহর জন্য ছেলেকে যে সপে দিবে কলিজার টুকরা সন্তানকে। আইনুদ্দিনের সেই বিপ্লবী চেতনায় হোক আমাদের হৃদয় সিঞ্চিত।শাহাদাতের তৃষ্ণায় পূর্ণ হোক আমাদের আত্মা। তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এ আজাদ সন্ধ্যায়।
এমডব্লিউ/