এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ।।
মাওলানা আইনুদ্দিন আল আজাদ রহ. নিছক একটি নাম নয়,একটি বিপ্লব, একটি চেতনা,একটি সংগ্রাম। ইসলামী সংগীত কিংবদন্তি। একজন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী।একজন ডিজাইনার।
তার কথা খুবই মনে পড়ছে। তার না থাকার শূন্যতা প্রতিটি সময়ই পীড়া দিচ্ছে। যার ছোঁয়াতে ধন্য হয়েছে সাংস্কৃতি ভুবন।যার সুরে তৃপ্ত হয়েছে প্রতিটি তৃষ্ণার্থ হৃদয়।যার বয়ানে খুঁজে পেয়েছে সত্যের সন্ধান।তিনি আমার,তোমার, আমরা,আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও লাখো তৌহিদি জনতার হৃদয়ের স্পন্দন, বাংলার সুর সম্রাট মাওলানা আইনুদ্দিন আল আজাদ রহঃ।
মাওলানা আইনুদ্দিন আল আজাদ রহ. স্মৃতির পাতায় লিখে রাখার মত একটি নাম। তিনি ১৯৭৭ সালের ০১ মার্চ ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ থানার হাজরাতলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রাম থেকেই শুরু হয় শিক্ষার হাতেখড়ি। অতঃপর দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে তিনি অধ্যায়নের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর সুর ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ। ইসলামী সংগীতের প্রতি অসামান্য ঈর্ষা ও ভালোবাসা থাকাতেই তিনি হাঁটতে শুরু করেন ইসলামী সাংস্কৃতির পথে ।যখন দেশব্যাপী অপসংস্কৃতির সয়লাব। অশুদ্ধ শব্দ ও সুরে পৃথিবী ভরাট। ঠিক তখনই তিনি কিশোর ও তরুণ সমাজের অবক্ষয় রোধে কাজ শুরু করেন। তিনি গান, বাদ্য ও উদ্দাম নৃত্য-গীতের মোকাবেলায় শুদ্ধ ও নির্মল নাশিদ-সঙ্গীত পরিবেশন করতে শুরু করেন। পাশাপাশি ওয়াজ-নসীহত, বক্তৃতাও দিতে থাকেন।
তার একনিষ্ঠ খুলুসিয়াত প্রচেষ্টার দরুণ খুব অল্পদিনের মধ্যেই তার সুর ও কথায় অসংখ্য মানুষ মুগ্ধ হয়ে যায়। দেশ-বিদেশে তার অনেক ফ্যান ফলোয়ার তৈরি হয়। হাজারো মানুুষের ভক্তি ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে সামনের এগিয়ে যান। এই পথ চলার ধারাবাহিকতায় বড় গুণীজনদের পরামর্শে তৃণমূল পর্যায়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক ভিত গড়ে তোলার ইচ্ছে পোষণ করেন। এই লক্ষ্যেই ২৮ মে ২০০৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কলরব’।
তার স্বপ্ন ছিল এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই সঙ্গীত প্রেমিকরা তাদের স্বপ্নকে পূরণ করবে। বিশ্ববাসী সত্য ন্যায়ের কন্ঠ শুনবে । চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে সুস্থ সংস্কৃতির স্বচ্ছ আলো। শুদ্ধতার সুর। ঠিক তিনি আজ নেই তবে তাঁর প্রেরণা আর স্বপ্ন বুকে নিয়ে ইসলামি সাংস্কৃতির বিজয়ের পানে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান কলরবসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো।
ইসলামী সংস্কৃতি কর্মীদের অক্লান্ত পইরিশ্রমের ফলে ইসলামি সংস্কৃতি আজ উন্নতির পথে। এখন ইসলামি গান অখ্যাত আর কিছু নয়। এক সময় মিডিয়া ইসলামি গানকে অবহেলার চোখে দেখলেও সবাই এখন গুরুত্বের সাথেই দেখছে। ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে ইসলামি গানের সুরের মুর্ছনা।আজ অব্দি ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আইনুদ্দিন আল আজাদ রহ. এর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করে যাচ্ছে নিরলস।
আজাদ রহ. ছিলেন একজন খোদাভীরু ব্যক্তি। সংগীতের সাথে সাথে তিনি কোরআন ও সুন্নাহের প্রতিও ছিলেন অনুরাগী।তাই তিনি তাঁর শিষ্যদের জন্য ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আবশ্যকীয় করে দিয়েছিলেন। পোশাকের দিক থেকে জুব্বা আর পাগড়ি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন।
যা আজ ইসলামি সাংস্কৃতি জগতে আগত সব শিল্পী ও সাংস্কৃতিকর্মীদের কাছে একটি ইউনিফর্ম এর রূপ লাভ করেছে।সত্যিই তিনি ছিলেন একজন দীনের দায়ী।তিনি কেমন মানুষ ছিলেন তা দেশের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, লেখক, কলামিষ্ট ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে শোনা যায়। যিনি গেয়েছেন সত্যের গান।দিয়েছেন বাতিলের বিরুদ্ধে হুংকার। যার হুংকারে কেঁপেছে বাতিলের মসনদ।যার মাধ্যমেই সাংস্কৃতি জগত উজ্জিবিত।
তিনিই শিখিয়েছে সহস্র জনতার সম্মুখে কিভাবে সত্যের গান গাইতে হয়।কিভাবে ইসলামের সুর উঁচু করে রাখতে হয়।তিনি যেমন লিখেছেন ঠিক তমনি গেয়েছেন।না ছিল লেখায় ভিরু ভাব, না ছিল কন্ঠে অস্ফুট সুর। সদা লিখেছেন মাজলুম জনতার গান।সদা গেয়েছেন আল্লাহ পাকের শান।এ যেন ছিল মহান খোদার অশেষ দান।বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে ইসলামি সাংস্কৃতি অঙ্গনের কথা বলতে গেলেই যার নাম প্রথমেই উঠে আসে।যার নাম না নিলেই নয়। তিনিই আজাদ রহ.।
আজাদ রহ. তাঁর গানে জাতিকে সব সময় নতুনত্বের স্বপ্ন দেখাতেন।গানে গানে ফুটিয়ে তুলতেন সময়ের সুর। তাঁর গান ছিলো অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। সমাজের অসংগতি অবলকন করলে তার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠত।তিনি গেয়েছেন, ‘সন্ধানী চোখ দুটি খুঁজে ফেরে বারে বার/ কোথা পাব সে সমাজ যেথা নেই হাঁহাঁকার’।
রাজনীতির মুখোশ পরে যারা দেশকে একক আধিপত্যের মত ব্যবহার করত তাদের বিরুদ্ধে গেয়েছেন ‘দেশটা নয়তো কারো বাপের ভিটা/ করবে মন চাইলে যখন যেটা’। সমাজের মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করতে লিখেছেন, ‘কি হবে বেঁচে থেকে / অযথা বিদ্যা শিখে/যদি না গড়তে পারি শোষণ বিহীন সমাজটাকে।দুর্নীতিবাজদের বিরোদ্ধে সুরে সুরে তিনি গর্জে উঠেছেন, ‘দুর্নীতিরই আখড়ায় বসে জাহির করে জ্ঞাণ/কলম দিয়ে কা,মায় টাকা আবার ধরে সাধুর ভান/ওরা শিক্ষিত শয়তান।’শুধু কি তাই! তিনি শাহাদাতের তামান্না নিয়েও গেয়েছেন, "বিপ্লব মানে জীবন দেয়া বসে থাকা নয়,সে কোনদিন আসবে নারে করো যদি ভয়,।
এভাবেই তিনি গায়তেন সময়ের সাহসী গান।এমন অসংখ্য গান রয়েছে তার। আজকালকার কত শত গানের মাঝে তিনি অনন্তকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন ষোল কোটি মানুষের হৃদয়ে। তার গান ও সুরে তিনিই দুর্লভ শিল্পী।
হঠাৎ করেই নিভে গেল এই আজাদী প্রদীপ। ঝরে গেল ফুটন্ত গোলাপ।আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।আজ সেই ঝরে যাওয়া দিনটি আবার স্মৃতিময় হয়ে ধরা দিয়ে যাচ্ছে।প্রতিটিবছর ঘুরে ঘুরেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তার শূন্যতার কথা। তার প্রয়োজনের অনুভব।দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল সেই প্রিয় মানুষটির না থাকা এগারোটি বছর। সেদিন ছিল শুক্রবার আঠারো-ই জুন দুই হাজার দশ। কোরআনের দাওয়াত নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন দূর বহুদূর।
পথিমধ্যে নাটোরের লালপুরে তিনি এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দেন।আজও তিনি স্মৃতিচারণ হয়ে আছে প্রতিটি হৃদয়ের মনিকোঠায়। আজও কানে বাজে "দেশটা নয়তো কারো বাপের ভিটা" "সমাধান চাও যদি" "কি হবে বেঁচে থেকে" "স্বাধীনতা পাইনি আমি সেই স্বাধীনতা" ইত্যাদি গজলের কথা ও সুর।
সবই পড়ে আছে আজ, নেই শুধু তুমি হে আইনুদ্দিন! নেই আজাদী হুংকার।নেই বিপ্লবী আওয়াজ।অতএব আমরা এতোটুকু বলতে পারি, সাংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিদের তাকে স্মরণ করা আর অনুসরণ করার বিকল্প নেই। তাঁর কথা ও সুর আজও আমাদেরকে সাক্ষী দিচ্ছে, কেমন ছিলেন তিনি।কেমন লিখেছেন তিনি। কেমন গেয়েছেন তিনি।
সত্যি আজ অনুভব করছি তার প্রয়োজনীয়তা।আমরা হারিয়েছি একজন ইসলাম দরদী মুসলিমকে।সংগীত সম্রাট শিল্পীকে।মানব দরদী সেবককে।এত গুনি একজন বহুমুখী মানুষকে হারিয়ে আমরা দুঃখিত। আমাদের হৃদয় ব্যাথিত।আজ এই ব্যাথিত হৃদয়ের শত আকুতি মিনতি দিয়ে আমরা দু'আ করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।এবং তাঁর পরিবার-পরিজনদেরকে সহিহ-সালামতে রাখেন।আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক।
-এটি