মোস্তফা ওয়াদুদ: কওমি মাদরাসা খুলে দিয়ে নিরীহ আলেমদের মুক্তি দিয়ে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার আহবান জানিয়েছেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর মেঝো ছেলে ও আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহ এর আমীর মাওলানা আনাস মাদানী।
তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসা খুলে দিয়ে কুরআনের পরিবেশ তৈরি করে দিন। এতে দেশ থেকে আজাব-গজব দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
সরকারের প্রতি জোর দাবী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের নিরীহ আলেমদের ছেড়ে দিন। কোনো নিরীহ আলেম যেনো হয়রারির শিকার না হোন। এজন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।’
আজ বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহিমাহুল্লাহর জীবন, কর্ম, অবদান ও চলমান সংকট থেকে উত্তরণে উলামায়ে কেরামের করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
এ সময় লিখিত বক্তব্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহিমাহুল্লাহর জীবন, কর্ম, অবদান সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, আমার আব্বাজান শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী রহ. তাঁর কর্মজীবনের প্রায় ৮০ বছর দ্বীনের বহুমুখী খেদমত করেছেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে তাঁর বিরাট অবদান। তাঁর কর্মময় জীবন নিয়ে পূর্ব থেকেই চলছে গবেষণা, এমনকি অনেকে তার জীবন নিয়ে পিএইচডিও করছেন। অসাধারণ দায়িত্ববোধ, গভীর জীবন দর্শন ও নিরলস শ্রমশীল এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.। ধর্মীয় অধিকার আদায়, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ও স্বীকৃতিসহ নানা আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে বৃদ্ধ বয়সেও সাহসী পদক্ষেপ নেন। জনআকাঙ্খার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি। দেশের সর্বস্তরের আলেম সমাজ আব্বাজান রহ.-এর প্রতি আস্থা রেখেছেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না। তাই তাকে বিশ্বাস করেছেন তারা। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন, শায়খুল আরব ওয়াল আজম হোসাইন আহমদ মাদানি রহমাতুল্লাহি আলাইহির খলিফা, হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সভাপতি, হাইয়াতুল উলইয়ার চেয়ারম্যান, একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। পীরে কামেল, শায়খুল হাদিস, লেখক, খতিব, ওয়ায়েজ, মাদ্রাসার পরিচালক, সংগঠনের আমির, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষকসহ বহু অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি সাদা মনের বিশাল হৃদয়ের এক মহানুভব ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছিলেন উম্মাহর কল্যানকামী। জনসাধারণের উদ্দেশ্যে তিনি যেমন বয়ান করেছেন, তেমনি আলেম সমাজকেও নসিহত করেছেন খোলামন নিয়ে। তার মিশন ছিল, আলেমগণ শুধু বস্তুগত এবং জাগতিক দৃষ্টি লালন করবেন না। বরং তিনি আধ্যাত্মিকভাবে এগিয়ে যাবেন। তিনি আলেমদের জাগাতে চেয়েছেন শেকড় থেকে। তিনি বলতেন, আলেমগণ এক হয়ে গেলে দেশে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। উলামায়ে কেরামের অনৈক্যের সুযোগে সুবিধাবাদী কিছু নাস্তিক-মুরতাদ সরকারকে ভুল বুঝিয়ে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রলুব্ধ করে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আলেমদের ঐক্য গড়তে হবে। বর্তমান সময়ে আমাদের সবচে বড় দুর্বলতা অনৈক্য।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর জীবনী নিয়ে স্মারক প্রকাশিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে জোর দাবি উঠেছে, তার বর্ণিল জীবনকে কাগজের পাতায় স্মারক হিসেবে প্রকাশ করার জন্য। এ প্রেক্ষাপটে আল্লামা আহমদ শফীর পরিবারবর্গ এবং তার হাতেগড়া সংগঠন আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহর যৌথ উদ্যোগে বর্ণাঢ্য স্মারক প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
এখানে হেফাজতের কমিটি গঠন বা এ জাতীয় কোনো বিষয়ের সম্ভাবনা নেই। এটি হজরত রহ.-এর জীবন-কর্ম শীর্ষক একটি আলোচনা সভা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সেমিনারের আরও একটি উদ্দেশ্য হলো, হজরত রহ.-এর খলিফাদের সামনে হজরতের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা। যেন তার খলিফাগণ হজরতের জীবনাচারণ দেখে অনুপ্রাণিত হন। তার পথে চলতে উৎসাহিত হন। পাশাপাশি বর্তমান সময়ে কওমি অঙ্গনে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা ঘটে গেছে এবং ঘটে চলছে, যা নিতান্তই আশঙ্কাজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই আশঙ্কাজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে কিভাবে উত্তরণ পাওয়া যায়, এই সেমিনারে সে বিষয়েও উলামায়ে কেরামগণ আলোচনা করবেন এবং পরামর্শ দিবেন। এসব উদ্দেশ্য নিয়েই মূলত আজকের সেমিনারের আয়োজন।’
পিতার বক্তব্যকে স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘আলেমদের উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন, আলেম সমাজ নবির উত্তরসূরী। কুরআন সুন্নাহর আলোকে জাতিকে নির্দেশনা দেয়া তাদের কর্তব্য। কল্যানের প্রতি আহ্বান জানানো এবং অকল্যান প্রতিরোধ করতে আলেমদেরকে স্বয়ং আল্লাহ এবং নবিজি সা. আদেশ করেছেন। তাই কোনো অবস্থাতেই আলেম সমাজের পক্ষে এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমার আব্বাজান আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. এ দায়িত্ব কখনো এড়িযে যাননি। ২০১৩ সালে হেফাজতের ঘটনা পরবর্তী সময়ে হজরতের আচরণগুলো তার প্রমাণ। তিনি সরকারের সঙ্গে শত্রুতাও দেখাননি, এবং তাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপদেশ দিতেও কসুর করেননি। অনেকবার সরকারকে তিনি সতর্কও করেছেন। ফলে এই মধ্যমপন্থায় থাকার কারণে তিনি সরকার থেকে অনেক দাবি আদায় করতে পেরেছেন। কওমি স্বীকৃতি তার মধ্যে অন্যতম।
তিনি বলেন, কওমি মাদরাসায় যে আশঙ্কাজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি বর্তমানে বিরাজমান, এ সম্পর্কে আব্বাজান রহ. আগেই সতর্ক করেছিলেন। তিনি এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পদ্ধতিও বাতলে দিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসের খতমে বুখারী ও দোয়া মাহফিলে হজরত রহ. বলেছিলেন, কওমি আলেমদের হীনমন্যতায় ভোগার দিন শেষ হয়েছে। এখন আলেমদের শিক্ষা সরকারীভাবেও মর্যাদা পেয়েছে। সুতরাং ছাত্র জীবনের দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে অজির্ত ইলমকে নানা ক্ষেত্রে আরো কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, নানা পর্যায় থেকে কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে এবং আলেমদেরকে আদর্শচ্যুত করার বহুবিদ ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে। এ পর্যায়ে আলেমগণ যদি নীতি ও লক্ষ্যে অবিচল ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেন, তবে কোন ষড়যন্ত্রই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষতি করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।
আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. এর হাজার হাজার রুহানি শিষ্য ও খোলাফাদের জন্য তিনি নিজহাতে গড়ে তুলেছেন আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহ বাংলাদেশ নামে একটি দ্বীনি সংগঠন। এখন হজরত রহ. নেই। তাই এই সংগঠন এখন খলিফাদের। একটি সংগঠন তার সদস্যদের তৎপরতায় এগিয়ে যায়। তাই আমরা সকলে মিলে যদি চেষ্টা করি, আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহ বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এই সংগঠন ইতোমধ্যেই হজরতের পূর্ণাঙ্গ জীবনী ও স্মারক বের করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা ইউসুফ মাদানী। দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা আনাস মাদানী। বক্তব্য রাখেন মুফতি ফয়জুল্লাহ, পটুয়াখালীর মাওলানা আব্দুল হক কাউসারীসহ আরও অনেকেই।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন মাওলানা রুহুল আমিন খান উজানী। উপস্থিত ছিলেন, ফরিদাবাদ মাদরাসার শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মুহাদ্দিস মুফতি নুরুল আমিন। হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস মাওলানা নুরুল ইসলাম জাদীদ, মাওলানা ইসমাতুল্লাহ কাসেমী ফরিদপুর, বেফাকের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক মুফতি আবুু ইউসুফ, মাওলানা আমিনুল ইসলাম ময়মনসিংহ, মাওলানা আব্দুল কাদের বরিশাল, ড. মাওলানা কামরুল ইসলাম, সিলেটের মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরী, জমিয়তের মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা সালমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন মুফতি নাসিরুদ্দিন কাসেমী।
এমডব্লিউ/