করোনার অজুহাতে বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। গতবার দেশের কওমি মাদরাসাগুলো অনুমতি দিলেও এবার তালে হৃদয় গলছে না সরকারের। বন্ধ রেখেছে কওমি মাদরাসাও। আগামী ১৩ জুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি হলেও ভিন্ন মোড় নিতে দেখা গেছে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনিকে। সবমিলিয়ে কতদিন বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনই বলা যায় না। দীর্ঘ এ অবসরে কী করবেন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা? জানতে মুখোমুখি হয়েছিলাম তিন শিক্ষাবিদ আলেমের। তারা বলছেন অবসরে বেশি করে কিতাব মোতালায়া করবে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাবিদদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন আওয়ার ইসলামের নিউজরুম এডিটর মোস্তফা ওয়াদুদ।।
শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মুহতামিম, ফরিদাবাদ মাদরাসা
দেশের বিখ্যাত এ আলেম শিক্ষাবিদ শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা অবসের বেশি করে কিতাব মোতালায়া করবে। তারা নিজস্ব আসাতিযায়ে কেরামের কাছে গিয়ে তাদের দিকনির্দেশনা মোতবেক মোতালায়া করবে। মোতালায়া তাদের জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা নিজেরাও মোতলায়া করতে পারে। যার যেই বিষয়ে বেশি আগ্রহ রয়েছে, সেই বিষয়ে তিনি মোতালায়া করবেন। মোটকথা পড়াশুনার বাইরে আর কিছু করবে না তারা।
সবশেষে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আমল জারি রাখবে। বিশেষত নিয়মিত নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা, তাসবিহাত আদায় করা। এগুলো নিয়মিত জারি রাখবে।
মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মুহতামিম, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া
এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া মুহতামিম মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সাথে। তিনি বলেন, অবসরে ছাত্রদের সময়গুলো কাজে লাগানোর জন্য আমরা প্রত্যেক ক্লাসে শিক্ষক নিযুক্ত করে দিব। তারা তাদের ক্লাসের প্রত্যেক ছাত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর নেবেন। প্রত্যেক ছাত্রকে ক্লাসের পড়ার পরিমাণ নির্ধারণ করে দিবেন। প্রত্যেকের হাতে লেখা ও অন্যান্য যে সকল বিষয় রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে নেগরানি করবেন। মোটকথা ঘরে থেকেও যেন তাদের সময়টা কাজে লাগে এবং মাদরাসার ধাঁচে সাজাতে পারে সেই জন্য যে সকল প্রক্রিয়া নেয়া দরকার সবই করবেন তারা।
নিজেদের মাদরাসার বিষয়ে এ শিক্ষাবিদ আলেম বলেন, ‘আমরা একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ভার্চুয়াল বা অনলাইন ক্লাস চালু করব। কিন্তু সে ভার্চুয়াল কিংবা অনলাইন ক্লাসের মাঝে বিভিন্ন রকমের সমস্যা আছে। বিশেষত অনেক সময় নেটওয়ার্ক থাকে না। আবার মোবাইল এর ব্যবস্থা করা সকলের পক্ষে সম্ভব না। আবার অনেক সময় ভিন্নদিকে আসক্তি তৈরি হয় শিক্ষার্থীদের। এইসব বিষয় বিবেচনা করে আমরা এই ভার্চুয়াল পড়াশোনাকে আপাতত আমলে নিচ্ছি না
ঘরে থেকেও মাদ্রাসার পড়াশোনা করবেন তারা। যা মাদ্রাসায়ও করতে পারেন। কিন্তু এর বাইরেও কি পড়াশোনা ছাড়া আর কোন কাজ করবে শিক্ষার্থীরা? এমন প্রশ্ন করলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেন, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করার বিষয়ও আমাদের কর্মসূচিতে রয়েছে। ছাত্ররা স্থানীয় মসজিদে মুসল্লিদের কোরআন শরীফ শিখাবে। সূরা মশক করাবে। প্রত্যেক ছাত্রকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় দিয়ে দেয়া আছে। যেমন ওযু গোসলের ফরজ সম্পর্কে মুসল্লিদের তালমি দেয়া, সূরা শেখানো, নামাজের মাঝে কয়টি ফরজ, কয়টি ওয়াজিব; এই বিষয়গুলো তারা শিখাবে।
মাওলানা মোহাম্মদ আবূ মূসা, শায়খুল হাদীস, আব্দুল হাফিজ তাহসিনুল কোরআন মাদরাসা (জামিয়া আফতাবনগর)
সবশেষে এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম আব্দুল হাফিজ তাহসিনুল কোরআন মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস মাওলানা মোহাম্মদ আবূ মূসার সাথে। তিনি বলেন, অবসরে শিক্ষার্থীদের জন্য আমি ছয়টি পরামর্শ দিব।
এক. যারা হাফেজে কোরআন তারা বেশি করে কোরআনুল কারীম তেলাওয়াত করবে। আর যারা গাইরে হাফেজ তারাও কোরআন তেলাওয়াত করবে। আর তারা সবাই কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি অন্যান্য কিতাবও মুতালায়া করবে।
দুই. শিক্ষার্থীদের জন্য যেটা আবশ্যক সেটা হল, যে যে ক্লাসে পড়বে সেই ক্লাসের কিতাবের মাবাদিয়াত বা ভূমিকাগুলোতে যে পরিভাষাগুলো রয়েছে। অথবা কিতাবেব শুরুতে যা যা পড়ানো হয় সেগুলো পড়ে নেবে। কেননা তারা যদি এই ভূমিকাগুলো এখনই পড়ে নেয় তাহলে ক্লাস যদি কিছুদিন পরেও শুরু হয়। তবুও পড়াশোনায় তেমন কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। সময়গুলো অপচয় কিংবা নষ্ট হবে না। কেননা মাদরাসাগুলোতে সাধারণত এই সময়ে মাবাদিয়াত বা ভূমিকাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। অতএব তারা যদি এখনই এগুলো মুতালায়া করে নেয় তাহলে শিক্ষকদের জন্যও সুবিধা হবে। আবার ছাত্রদের জন্যও সুবিধা হবে। যেমন উলুমে হাদিস, উসুলে হাদিস, উসূলে ফিকাহ, উসুমে নাহম ইত্যাদি যেগুলো বিষয়ভিত্তিক আলোচনা আছে সেগুলো তারা এখনই মুতালায়া করে নেবে।
তিন. যে যে বিষয়ের প্রতি বেশি ঝোক রাখে সে সে বিষয়ে বেশি অধ্যায়ন করবে। অর্থাৎ মোতালায়ার প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ করবে।
চার. মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে সে তার বাবা-মা কিংবা এলাকার মুরব্বিদের যথাযথ খেদমত করতে পারে না। সামাজিক কাজে ততটা মনোনিবেশ করতে পারেনা। এখন যেহেতু অবসর সময় আছে, অবসর সময়ে শিক্ষার্থীরা চাইলে তাদের বাবা-মা, এলাকার মুরুব্বি বা সামাজিক অন্যান্য কার্যক্রম এর প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে। এতে করে তার সময়টা সুন্দরভাবে কেটে যাবে। আবার এলাকার মানুষের কাছেও তার প্রভাব তৈরি হবে।
পাঁচ. ইনাবাত ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। বেশি করে রব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করা, যেন আল্লাহ তায়ালা এ মুসিবত থেকে আমাদের খুব শীঘ্রই মুক্তি দান করেন।
ছয়. যে যে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে কিংবা ভর্তি হবে সেখানে কোনো তালীমি মুরুব্বির মাধ্যমে নিজেকে পরিচালনা করা। যেকোনো সিদ্ধান্ত তালীমি মুরুব্বি ছাড়া কখনো না নেওয়া।
এমডব্লিউ/