মুসলিমের বাৎসরিক এবাদত ও উৎসব ঈদ। বছরে দু’টি ঈদ- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। এদিন ধনী-গরীব সকল মুসলিম একসাথে ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ে। খোলা আকাশের নিচে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার নামাজ আদায়ের জন্য সাধারণত শহরের বাইরে বা শহরতলীতে বড় ময়দানকে ঈদগাহ বলা হয়। বাংলাদেশে রয়েছে বড় বড় কিছু ঈদগাহ। যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসল্লি একত্রে জামাতে নামাজ আদায় করে। এসব মসজিস নিয়ে আজকের আয়োজন। ফিচারটি সাজিয়েছেন আবদুল্লাহ আফফান
গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দান
বাংলাদেশের দিনাজপুরের অবস্থিত গোর-এ-শহীদ ঈদগাহ ময়দান। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দান। এই ঈদগাহ ময়দানে প্রায় ৬ লাখ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। ২০১৭ সালে দেশের সর্বৃহত্তম ঈদুল ফিতরের জামাত এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ঈদগাহের অবকাঠামো
গোড়-এ শহীদ ঈদগাহ ময়দানের আয়তন প্রায় ২২ একর। ৫২ গম্বুজের ঈদগাহ মিনার তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ঈদগাহ মাঠের মিনারের প্রথম গম্বুজ অর্থাৎ মিহরাব এর উচ্চতা ৪৭ ফিট। এর সাথে রয়েছে আরও ৪৯টি গম্বুজ। এছাড়া ৫১৬ ফিট লম্বায় ৩২টি আর্চ রয়েছে। পুরো মিনার সিরামিক্স দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ঈদগাহ মাঠের দুধারে করা হয়েছে ওজুর ব্যবস্থা। প্রতিটি গম্বুজ ও মিনারে রয়েছে বৈদ্যুতিক লাইটিং।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত ঈদগাহ ময়দানে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান আকর্ষণীয় ও বিশাল জামাত, গৌরবময় ও ঐতিহ্যশালী করেছে কিশোরগঞ্জকে। বর্তমানে এখানে একসঙ্গে তিন লক্ষাধিক মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করেন। বর্তমানে এই ঈদগাহের ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।
ঈদগাহের ইতিহাস
ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারের জন্য ইয়েমেন থেকে আগত শোলাকিয়া 'সাহেব বাড়ির' পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। ওই জামাতে ইমামতি করেন তিনি নিজেই। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসল্লিদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে 'সোয়া লাখ' কথাটি ব্যবহার করেন। আরেক মতে, সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়। ফলে এর নাম হয় 'সোয়া লাখি'। পরবর্তীতে উচ্চারণের বিবর্তনে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া_ সেখান থেকে শোলাকিয়া। পরবর্তিতে ১৯৫০ সালে স্থানীয় দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ এই ময়দানকে অতিরিক্ত ৪.৩৫ একর জমি দান করেন।
মাঠের বর্ণনা
বর্তমান শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আয়তন ৭ একর। ঈদগাহ মাঠটি চারপাশে উচু দেয়ালে ঘেরা হলেও মাঝে মাঝেই ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে মানুষ মাঠে প্রবেশ ও বের হতে পারে। এছাড়া এই মাঠের প্রাচীর দেয়ালে কোনো দরজা নেই। শোলাকিয়া মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫০০ করে মুসল্লি দাঁড়াবার ব্যবস্থা আছে। ফলে মাঠের ভেতর সবমিলিয়ে এক লাখ বত্রিশ হাজার ৫০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে ঈদুল ফিতরের সময় আশপাশের সড়ক, খোলা জায়গা, এমনকি বাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এভাবে সর্বমোট প্রায় তিন লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন। এবং এই মুসল্লির এই সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে।
শাহী ঈদগাহ, সিলেট
সিলেট শহরের উত্তর সীমায় শাহী ঈদগাহ বা ঈদগাহ মাঠের অবস্থান। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থাপনা সমুহের মধ্যে ১৭০০ সালের প্রথম দিকে নির্মিত সিলেটের শাহী ঈদগাহকে গণ্য করা হয়।
ঈদগাহের ইতিহাস
১৭০০ সালে প্রথম দশকে সিলেটের তদানীন্তন ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নিজের উদ্যোগে ও তত্বাবধানে ঈদগাহটি নির্মাণ করেন। প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মুসল্লী এক সাথে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন।
সিলেট শহরের এ স্থানটি নানা কারণে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও স্মরণীয়। ১৭৭২ সালে ইংরেজ বিরোধী ভারত-বাংলা জাতীয়তাবাদীর প্রথম আন্দোলন সৈয়দ হাদী ও মাদী কর্তৃক এই ঈদগাহ মাঠেই শুরু হয়েছিল। অতীতে সিলেটের বড় বড় সমাবেশের স্থান ছিল এটি। এখানে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী, কায়দে আযম, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো নেতারা এসেছেন এবং ইংরেজ বিরোধী গণ আন্দোলের আহবান জানিয়েছেন। যে কারণে এ স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক।
পরিক্রমা
একটি উচু টিলার উপর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই শাহী ঈদগাহ অবস্থিত। মুল ভূ-খন্ডে কারুকার্যখচিত ২২টি বৃহৎ সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠলে ১৫টি গম্বুজ সজ্জিত ঈদগাহ দেখা যায়। ঈদগাহের প্রাচীর সীমার চার দিক ঘিরে রয়েছে ছোট বড় ১০ টি গেইট। ঈদগাহের সামনে মুসল্লীদের অজুর জন্য রয়েছে বিশাল পুকুর। ঈদগাহের উত্তরে শাহী ঈদগাহ মসজিদ, পাশে সুউচ্চ টিলার ওপর বন কর্মকর্তার বাংলো, দক্ষিণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিলেট কেন্দ্র, পূর্ব দিকে হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গী শাহ মিরারজী র: এর মাজারের পাশের টিলার ওপর রয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।
জাতীয় ঈদগাহ
স্বাধীনতার আগে থেকেই হাইকোর্টের পাশের জায়গাটি ছিল ঝোপজঙ্গলে পূর্ণ। সেই জায়গার মাঝে ছিল একটি পুকুর। ১৯৮১-৮২ সালের দিকে সেই ঝোপজঙ্গল কিছুটা পরিষ্কার করা হয়। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি মাজার। জায়গাটি একটু পরিচিত হয়ে উঠলে সেখানে ছোট পরিসরে শামিয়ানা টানিয়ে ঈদের নামাজ পড়ানো শুরু হয়। ১৯৮৫ সালের দিকে সেই পুকুরটি ভরাট করে ফেলে কর্তৃপক্ষ। পরে ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ওই ঈদগাহকে জাতীয় ঈদগাহ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশ হাইকোর্টের অধীনে ঈদগাহটি পরিচালিত হলেও তার দেখভাল করে গণপূর্ত বিভাগ। ২০০০ সালে দুই ঈদেই ঈদগাহ প্রস্তুতের দায়িত্ব পায় ঢাকা সিটি করপোরেশন।
চারদিকে লোহার প্রাচীর দেওয়া বিশাল মাঠটিতে রয়েছে একটি মূল ফটকসহ কয়েকটি ফটক। কিবলার দিকে রয়েছে একটি মিহরাব। মিহরাবটি মূলত পাঁচটি মিনারে তৈরি। জাতীয় ঈদগাহে একটি জামাতে অন্তত এক লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। সেখানে একই জামাতে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থা। এখানে ২০ হাজার নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।
শাহ মখদুম ঈদগাহ ময়দান
রাজশাহী শহরের দরগাহপাড়ায় অবস্থিত হজরত শাহ মখদুম রহ.-এর মাজার শরিফ থেকে কয়েক শ গজ পশ্চিমে গড়ে উঠেছে এই ঈদগাহ ময়দান। দরগাহ এস্টেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপরই রাজশাহীর তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মজিদ সিএসপি, সাব ডেপুটি কালেক্টর আবদুল করিম চৌধুরী, রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রকৌশলী মুহা. হাবিবুর রহমান প্রমুখের উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর কেন্দ্রস্থল পদ্মার তীরঘেঁষে রাজশাহী হজরত শাহ মখদুম রহ. কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে এই ঈদগাহ ময়দানটি চার ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। পরে এই প্রাচীর ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়লে দরগাহ এস্টেট পরিচালনা কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সালাম ১৯৮৫ সালে সেটি ভেঙে ফেলে সাত ফুট উঁচু একটি নতুন বেষ্টনী প্রাচীর তৈরি করেন।
১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর উদ্যোগে ঈদগাহ ময়দানের ভূমি উঁচু ও সমতল করা হয়। এরপর আধুনিক স্থাপত্যের পাঁচ ফুট উঁচু বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়, যা আজও বিদ্যমান। ইট, বালু, সিমেন্ট আর রড দিয়ে নান্দনিকভাবে তৈরি ঈদগাহ মাঠের এই বেষ্টনী প্রাচীরে অসংখ্য ছোট পিলার রয়েছে। ঈদগাহ ময়দানের চারদিকে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ছয়টি প্রবেশপথ। ঈদগাহ ময়দানটির দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে আধুনিক কারুকার্যে নির্মিত হয়েছে ছোট্ট একটি মসজিদ। পাশেই রয়েছে অজুখানা।
২০১৩ সালে তৎকালীন মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন পদ্মা নদীর শহররক্ষা বাঁধকে সোজা করে এই ঈদগাহ মাঠের আয়তন দ্বিগুণ করেন। এখন এটির আয়তন দৈর্ঘ্যে ৪০০ ফুট এবং প্রস্থে ৪০০ ফুট। ওই বছরই মাঠে নতুন একটি মেহরাব তৈরি করা হয়। সেখানেই বর্তমানে ঈদের জামাত পড়ানো হয়।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম