।।মাওলানা মুহাম্মদ ওলীউর রহমান।।
যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে একটি। যাকাত আরবী শব্দ। এর মূল ধাতু হচ্ছে যাকয়ুন। এর চারটি অর্থ রয়েছে। যেমন- ১.পবিত্রতা ২.বৃদ্ধি পাওয়া ৩. প্রশংসা ৪. প্রাচুর্যতা। শরিয়তের পরিভাষায় যাকাত বলা হয়- সম্পদশালীদের উপর আল্লাাহর নির্ধারিত সেই অংশ যা আদায় করা ওয়াজিব। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, পবিত্র হয় এবং অন্য দিকে দারিদ্র্য সমস্যা দূরিভূত হয়। পবিত্র কুরআনের মোট ১৮টি সূরার ২৯টি আয়াতে যাকাতের আলোচনা হয়েছে। যাকাত পূর্ববর্তী সব শরিয়তের মধ্যেই যাকাতের ব্যবস্থা ছিল। ইসলামপূর্ব আরব জাহিলিয়াত সমাজে নানা রকম সুদ ব্যবস্থা চালু ছিল।
সুদ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার নিস্পেষণে কাতর মানব সমাজের কাছে যাকাতের আলোচনাই ছিল বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলাম মানুষের মন-মগজ ও চিন্তা বিশ্বাসকে কুফর-শিরক ও সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে তাওহিদের বিশ্বাস তথা ঈমানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সমাজের দরিদ্র জনগণের প্রতি সচেতন হয়ে তাদের অভাব অনটন মোচন করে তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতিও সমান গুরুত্ব প্রদান করেছে।
যাকাতের প্রয়োজনীয়তা-
রাসূল (সা.) বলেন, দ্বীন ইসলাম পাঁচটি জিনিসের উপর ভিত্তিশীল। এ কথার সাক্ষ্যদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত দান করা, আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা এবং রামজান মাসের রোজা রাখা। -মোত্তাফাকুন আলাইহি
যাকাত, ফিতরা, উশর ও অন্যান্য সাদাকাতের যে ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে তা দরিদ্র মানুষের প্রতি ধনিদের কোন অনুকম্পা বা অনুগ্রহ নয় বরং এসব হচ্ছে বিত্তবানদের সম্পদে বিত্তহীনদের অধিকার। পবিত্র কোরআনে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সাথেই আবার কোথাও পরকালের আলোচনার সাথে, কখনো স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৪৩) অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন, ‘আর আমার অনুগ্রহ প্রতিটি বস্তুকে ঘিরে রেখেছে, যারা অল্লাহকে ভয় করে, যাকাত প্রদান করে এবং আমার আয়াতসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আমি এটাকে তাদের জন্য লিখে রাখব।’ (সূরা আ’রাফ-১৫৬)
যাকাত আদায় না করলে আত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয়না। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুণ-তার দ্বারা তাদেরকে আপনি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন এবং তাদের জন্য আপনি দোয়া করুন। -সূরা তাওবা -১৩০
জাকাত না দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর যারাই স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মহাপীড়াদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং উহা দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশে এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, ইহাই উহা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে, সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর।’ (সূরা তাওবা-৩৪-৩৫) যাকাত না দেওয়ার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘অভিশাপ ঐ ব্যক্তির উপর যে যাকাত দিতে অস্বীকার করে।’ -আহমদ ও নাসায়ী।
আধুনিক বিশ্বে এ যাবত যত অর্থনৈতিক মতবাদ গড়ে উঠেছে কোনটাই বিশ্ববাসীর পরিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারে নাই। একমাত্র ইসলামী অর্থনীতিতেই রয়েছে দারিদ্র্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান, অসহায়, বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ। আর ইসলামী অর্থনীতির মূল ভিত্তি এবং মেরুদন্ড হচ্ছে যাকাত। এখানে সুদকে হারাম ঘোষণা করে প্রত্যেক ধনবান ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ‘বিত্তবানদের সম্পদে প্রার্থী ও সর্বহারাদের নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে।’ –সূরা যারিয়াত-১৯
যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ফরয-
চার প্রকার সম্পদের উপর যাকাত ফরজ। যেমন- ১. স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ। ২. বাণিজ্যিক পণ্য। ৩. মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু। ৪. জমিতে উৎপাদিত শস্য ও ফলমূল।
স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থের যাকাত-
একবার দু’জন মহিলা রাসূল (সা.)-এর কাছে আসল। তাদের দু’জনের হাতে স্বর্ণের কংকন ছিল। রাসূল (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমারা তোমাদের অলংকারের জাকাত দিয়েছ কী? তারা বলল, না। রাসূল (সা.) বললেন, ‘তোমারা কি পছন্দ কর যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে আগুনের দুটি বালা পরিয়ে দিবেন? তারা বলল, না? তখন তিনি বলেন, তাহলে তোমারা এ স্বর্ণের জাকাত আদায় কর। -তিরমিযিী
সাড়ে সাত তোলা (৮৫ গ্রাম) সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৫৯৫ গ্রাম) রূপা অথবা তার সমমূল্যের সম্পদ যদি কোন ব্যক্তির জীবন ধারনের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণাদির অতিরিক্ত হয় এবং পূর্ণ এক বছর সে ঐ সম্পদের মালিক থাকে তখন তার উপর যাকাত ফরজ হবে। স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ ও ব্যবসায় নিয়োজিত পণ্যের বছরান্তে ৪০ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা ২.৫% যাকাত বাবত আদায় করতে হবে। সোনার নেসাব অনুযায়ী সোনার যাকাত এবং রূপার নেসাব অনুযায়ী রূপার যাকাত আদায় করতে হবে। নগদ টাকা এবং ব্যবসায় নিয়োজিত পণ্যের যাকাত আদায় করার সময় সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যকে পরিমাণ ধার্য করতে হবে।
গৃহপালিত পশুর যাকাত-
চারণভুমিতে বিচরণশীল ৩০টি গরু অথবা মহিষের জন্য ১ বছর বয়সের ১টি গরু অথবা মহিষের বাচ্চা যাকাত দিতে হবে। অনুরূপ ৪০ থেকে ১২০টি ছাগলের জন্য বছরে ১টি ছাগল যাকাত দিতে হবে। ৩০ টির কমে গরু অথবা মহিষে এবং ৪০টির কমে ছাগলে যাকাত নেই। তবে ব্যবসার উদ্দেশ্যে যদি গরু ছাগল, হাঁস, মুরগী বা অন্যান্য পশু-পাখি ক্রয় করে রাখা হয় তাহলে এগুলো ব্যবসায় পণ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে এগুলোর মূল্যের উপর যাকাত আসবে।
উশর তথা উৎপাদিত শস্য ও ফল মূলের যাকাত-
উশর তথা শস্য ও ফল ফসলের যাকাত আমাদের দেশে খুব কমই আদায় করা হয় এবং এর আলোচনা ও কম হয়। যার দরুন এ সম্পর্কে অনেকে জানেইনা যে, উৎপাদিত ফসলেরও যাকাত আদায় করতে হয়। উশর এর অর্থ হলো এক দশমাংশ। জমি থেকে উৎপন্ন সকল প্রকার শস্য, শাক-শব্জি ও ফলের এক দশমাংশ যাকাত বাবত আদায় করাকে উশর বলে। কারো কারো মতে গোলাজাত শস্য বা ফসল ছাড়া অন্য ফষলের উপর যাকাত নেই। জমির ফসল আহরণের সাথে সাথে উশর পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বৎসর অতিক্রান্ত হওয়া প্রয়োজন নেই। বৎসরে একাধিকবার ফসল আসলে একাধিক বার উশর আদায় করতে হবে।
যেসব জমিতে সেচ প্রয়োজন হয় না, অর্থাৎ ফসল উৎপাদনের জন্য পানি সিঞ্চন করতে হয় না বরং প্রাকৃতিকভাবে নদী বা বৃষ্টির পানি দ্বারাই ফসল ফলানো হয়, এরকম জমি থেকে আহরিত ফসলের দশ ভাগের একভাগ আর যে জমিতে পানি সিঞ্চন করে ফসল উৎপাদন করতে হয় এরমক জমি থেকে উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত বাবত আদায় করতে হবে। বিশ ভাগের এক ভাগকে বলা হয় নিসফে উশর।
অবশ্য এ থেকে চাষ, কর্তন, মাড়াই ইত্যাদির খরচ বাদ যাবে। ফসলের নেসাবের পরিমাণ হলো ৫ ওয়াসাক। অর্থাৎ কেউ যদি ৫ ওয়াসাক তথা আনুমানিক ২৫ মন শস্য পায় তাহলে সে উশর বা নিসফে উশর আদায় করতে হবে। তবে ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, ৫ ওয়াসক হওয়া জরুরী নয় বরং ফসল পৌণে দুই সেরের বেশি হলেই উশর আদায় করতে হবে। -দুররুল মুখতার, ২য় খন্ড
অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ তথা যে সম্পদের উপর যাকাত নেই-
অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ বা উপকরণ হলো- বসবাস কিংবা ভাড়ায় নিয়োজিত ঘর, বাড়ি, দোকান কোঠা, স্থায়ী সম্পত্তি, দালান কোঠা, পেশাগত সামগ্রী, কারখানার যন্ত্রপাতি, যোগাযোগের বাহন ইত্যাদির উপর যাকাত নেই। তবে এসব থেকে ভাড়া বাবত অর্জিত আয় অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যুক্ত করে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করতে হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করে রাখা জমি, দালান ও দোকান ঘর, এপার্টমেন্ট, গাড়ি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মূল্যের উপর যাকাত ধার্য হবে। ঘরের আসবাব পত্র, তৈজসপত্র, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক পরিচ্ছদ, নিজের ও নিজের উপর সরাসরি নির্ভরশীল আত্নীয় স্বজনদের দৈনন্দিন খরচের উপর যাকাত দিতে হবেনা।
যাকাতের পাওনাদার-
যাকাতের পাওনাদারদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ৬১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাকাতের পাওনাদার হল কেবল ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্তাকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্ল¬াহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হল আল্ল¬াহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ যাকাতের অর্থ ব্যয় হবে সমাজের অসহায়, দরিদ্র মানুষের আথিক নিরাপত্তার কাজে। যাতে একটি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকেনা। কেউ সম্পদের পাহাড় গড়বে এবং কেউ অনাহারে মরবে ইসলাম এই বৈষম্য চিরতরে উৎখাতের ব্যবস্থা দিয়েছে যাকাতের বিধানের মাধ্যমে।
যাকাত হিসাবের পদ্ধতি-
যারা যাকাত আদায় করবেন তাদের যাকাতযোগ্য সম্পদের একটি নমুনা হিসাব পেশ করা হলো যাতে হিসাবের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়।
দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি বিত্তবান মানুষের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। দেশের চলমান করোনা সংকটের সময় যে বিশাল জনগোষ্ঠী অভাব-অনটন ও দুঃখময় পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন এ অবস্থায় যাকাত, উশর, ফিতরা আদায়সহ অসহায় মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখক- মুহাদ্দিস, জামিয়া আয়শা সিদ্দিকা জাহানপুর, ইসলামপুর, সিলেট। পেশ ইমাম ও খতীব, পূর্বভাটপাড়া জামে মসজিদ, ইসলামপুর, সিলেট।
-কেএল