।।সারিব সুইজা।।
বগুড়া শহরের এক অবাক করা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। শুনলে অবাক হওয়ার মতো হলেও বর্তমানে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার ঘটনা সত্যিই বিরল। যিনি এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তিনি মরহুম আকবর আলী মিঞা। বিনামূল্যে অভুক্ত মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করে তিনি উদাহরণ তৈরি করে গেছেন। সারাদিন হোটেলে উন্নতমানের খাবার বিক্রি করার পর রাতে গরিব, ভিক্ষুক, ভাসমান ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষের মুখে বিনামূল্যে খাবার তুলে দিচ্ছে বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল।
পুরো বছরের মতো করোনা মহামারীকালীন এ রমজানেও বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করছে হোটেলটি। হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা। তার হোটেল প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতি রাতে বিনামূল্যে খাবার দিয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও এ ধারা চলবে বলে জানিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। আগের নির্দেশনা অনুযায়ীই হোটেলটির কার্যক্রম চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বগুড়া শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে অবস্থিত হোটেলটি। শহরের নাম-পরিচয়হীন মানুষের জন্য একবেলা ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে কর্তৃপক্ষ। একেবারে আলাদা রান্না করে তাদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। এ খাবারের জন্য প্রতিদিন শহরের অভাবী মানুষ হোটেলে ভিড় করেন। বিনিময়ে নেয়া হয় না কিছুই।
জানা যায়, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা তৎকালীন ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পরে ভাগ্যোন্বেষণে সপরিবারে বাংলাদেশের পাকশী, সান্তাহার এবং সবশেষ বগুড়ায় বসতি গড়েন। তিনি প্রথমে ভাইয়ের সঙ্গে মেকানিকের কাজ শুরু করেন। তখন বগুড়ায় মুসলমানদের খাবারের ভালো হোটেল ছিল না। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের হোটেলে মুসলমানদেরকে খেতে দেয়া হতো না। এমনকি পান করতে দেয়া হতো না একগ্লাস পানিও। ছুঁতে দেয়া হতো হোটেলের কোনো আসবাব।
এ অবস্থায় হোটেল দেয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন আকবর আলী মিঞা। কিন্তু তার প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। একপর্যায়ে হোটেল করার জন্য তিনি মিষ্টি তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। সেই পুঁজি নিয়ে শহরের চকযাদু রোডের মুখে মাসিক আট টাকা ভাড়ায় হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
বগুড়া শহরে সে সময় আকবর আলীর ছোট্ট পরিসরে হোটেল ছিল। মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল এটি। সে কারণে এর নাম-ডাক খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ায় সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে গ্রাহকের স্থান সংকুলান হতো না। পরে তিনি শহরের থানা রোডে হোটেলটি স্থানান্তর করেন। সে থেকেই আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল হিসেবে পরিচিতি পায়। চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি হোটেলে মাসিক ১৫-২০ টাকায় তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। সে সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল ১ টাকা প্লেট।
বগুড়ার সাদা সেমাইয়ের যে কদর দেশব্যাপী ছিল, তার মূলে ছিলেন আকবর আলী। সে সময় কলকাতা থেকে সেমাই আসত বাংলাদেশে। এ অঞ্চলের মুসলমান বা সাধারণ মানুষকে অল্প দামে খাওয়ানোর তাগিদে সেমাই তৈরি করেন তিনি। তাতে সফলও হন। দ্রুতই তিনি ব্যবসায় উন্নতি এবং সফলতা পান। সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন অভুক্ত মানুষকে খাওয়াতেন তিনি। সেটা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে গেছেন।
১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগে তিনি ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে যান। আজও সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি। পিতার আদেশ ছেলেরা আজও পালন করে যাচ্ছেন। আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের এখন চারটি শাখা। কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল, ইয়াকুবিয়ার মোড়ের মিষ্টি মেলা, কোর্ট চত্বরে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও শজিমেক হাসপাতালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। এসব শাখায় কর্মচারী রয়েছেন সহস্রাধিক। আকবর আলীর লাচ্ছা সেমাই এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়।
বগুড়া শহরে ভিক্ষা করা বৃদ্ধা ছমিরন সারাদিন ভিক্ষা করে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে স্টেশনের পাশে একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন। ১৮-১৯ বছর ধরে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খাচ্ছেন তিনি। এছাড়া ৬৫ বছরের বৃদ্ধ রমজান আলী বেপারী আয়-রোজগার করতে না পারায় আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে থাকেন।
আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয়া গ্রুপের পরিচালক মো. হাসান আলী আলাল বাবার নিয়ম পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন এক মণেরও বেশি চাল আলাদাভাবে রান্না করে খাবার বিতরণ করা হয়। রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে হোটেলের সামনের রাস্তায় এসব খাবার দেয়া হয়।
জানা যায়, মূলত খাবার বিতরণ শুরু হয়েছিল মুসাফিরদের জন্য। কালক্রমে মুসাফিরের জায়গায় এখন এসব নিম্ন আয়ের মানুষকে খাবার দেয়া হচ্ছে। এখান থেকে যে কেউ খাবার নিতে পারেন। ইচ্ছে হলে এখানে বসে খাবেন, অন্যথায় নিয়ে যাবেন নিজের সুবিধে মতো জায়গায়।
-কেএল
আমাদের কাছে আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে মেইল করুন- [email protected]