সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আম্মাজান আয়েশা রা.-এর ওপর অপবাদ; একাল সেকাল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: মেয়েদের দেখে সবচেয়ে বেশি চোখ হেফাযতকারী ছেলের উপরেই মাঝে মাঝে চরিত্রহীনতার অভিযোগ আসে। অশ্লীলতা থেকে সবচেয়ে দূরে থাকা মেয়েটার উপরেই আসে চূড়ান্ত অশ্লীলতার অভিযোগ। নির্দোষ মানুষের পৃথিবীটা তখন খুব সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। জীবনটা মেঘে আধার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। তাই আল্লাহ স্বয়ং তাদের ইজ্জতের হেফাজত করেন। যেমনটা করেছিলেন মরিয়াম (আ)-এর ক্ষেত্রে। করেছিলেন আমাদের মা আয়েশা (রা)-এর ক্ষেত্রে। চারপাশের সকল মেঘ দূরীভূত হয়ে ঝকঝকে সূর্য উঠে। কিন্তু যাদের হৃদয়কে বক্রতা জেকে বসে, তারা কপটতা করবেই। সেকালে করেছে, একালেও করবে। আজকের গল্প তেমন একটা ঘটনাকে নিয়ে।

ঘটনাটা সীরাতের পাতায় ‘ইফকের ঘটনা’ নামে পরিচিত। ঘটনাটি ঘটে পঞ্চম হিজরীর শাবান মাসে। বনু মুসতালিকের যুদ্ধে। এ যুদ্ধে আগে থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো যে, তেমন কোন রক্তপাত ঘটবে না। মুসলিমরা বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় জিতবে। তাই মদিনার বিপুল সংখ্যক মুনাফিকরা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন- “এই অভিযানে অসংখ্য মুনাফিক অংশগ্রহণ করে যা অন্য কোনো অভিযানে আগে দেখা যায়নি।"

রাসূল (সা) যখন কোনো সফরে বের হতেন, তখন স্ত্রী নির্বাচনের জন্য লটারী করতেন। বনু মুসতালিকের যুদ্ধে অভিযানে সফরসঙ্গী হিসেবে লটারীতে আয়েশা (রা)-এর নাম আসে। আয়েশা (রা) যাত্রাকালে প্রিয় ভগ্নী আসমা (রাঃ)-এর একটি হার ধার নেন। হারটির আংটা এতো দুর্বল ছিলো যে বারবার খুলে যাচ্ছিলো। সফরে আয়েশা(রাঃ) নিজ হাওদাতে আরোহণ করতেন। এরপর হাওদার দায়িত্বে থাকা সাহাবিগণ হাউদা উঠের পিঠে উঠতেন। তখন আয়েশা (রা)-এর বয়স ছিল কেবল চৌদ্দ বছর। তিনি এতো হালকা গড়নের ছিলেন যে, হাওদা-বাহক সাহাবিগণ সাধারণত বুঝতে পারতেন না যে, ভিতরে কেউ আছে কি নেই।

সফরকালে রাতের বেলায় এক অপরিচিত জায়গায় যাত্রা বিরতি হয়। আয়েশা (রা) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দূরে চলে গেলেন। ফেরার সময় হঠাৎ গলায় হাত দিয়ে দেখলেন ধার করা হারটি নেই। তিনি প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলেন। প্রথমত, তার বয়স ছিল কম আর তার উপরে হারটি ছিল ধার করা। হতভম্ব হয়ে তিনি হারটি খুঁজতে লাগলেন। বয়স কম হবার কারণে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিলো না। তিনি ভেবেছিলেন যাত্রা আবার শুরু হবার আগেই তিনি হারটি খুঁজে পাবেন আর সময়মতো হাওদাতে পৌঁছে যাবেন। তিনি না কাউকে ঘটনাটি জানালেন, না তার জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ দিলেন।

খুঁজতে খুঁজতে তিনি হারটি পেয়ে গেলেন কিছুক্ষণ পর। কিন্তু ততক্ষণে কাফেলা রওনা হয়ে গেছে। তারা ভেবেছিলেন, আয়েশা (রা) হাওদার মধ্যেই রয়েছেন। এদিকে আয়েশা(রাঃ) কাফেলার স্থানে এসে কাউকে পেলেন না। তিনি চাদর মুড়ি দিয়ে সেখানেই পড়ে রইলেন। ভাবলেন, যখন কাফেলা বুঝতে পারবে তখন আবার এখানে ফিরে আসবে।

সে সফরে সাকাহ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সফওয়ান (রা)। সাকাহ বলতে কাফেলার রক্ষণাবেক্ষণকারীদের বুঝানো হয়। তাদের কাজ ছিলো কাফেলাকে কিছু দূর থেকে অনুসরণ করা। কেউ পিছিয়ে পড়লে কিংবা কোনো কিছু হারিয়ে গেলে তা কাফেলাকে পৌঁছে দেয়া। সফওয়ান (রা) ছিলেন খুব বড়ো মাপের সাহাবী। তিনি পথ চলতে চলতে অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। আর চাদর মুড়ি দেয়া অবস্থাতেও আয়েশা (রা)-কে চিনতে পারলেন। কারণ, পর্দার বিধান নাযিল হবার পূর্বে তিনি আয়েশা (রা)-কে দেখেছিলেন। আয়েশা (রা) তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাকে সজাগ করার জন্য সফওয়ান (রা) জোরে-

“ইন্না-লিল্লাহ” বলে আওয়াজ দিলেন। বললেন, “এ যে রাসূল (সা)-এর সহধর্মিণী! আল্লাহ আপনার উপরে রহম করুন! কি করে আপনি পিছে রয়ে গেলেন?”

আয়েশা(রাঃ) কোনো কথার জবাব দিলেন না। সফওয়ান(রা) একটি উট এনে তাতে আয়েশা (রা)-কে আরোহণ করতে বলে দূরে সরে দাঁড়ান। আয়েশা (রা) উটের পিঠে আরোহণ করলে তিনি উটের লাগাম ধরে সামনে পথ চলতে থাকেন। অনেক চেষ্টা করেও ভোরের আগে তারা কাফেলাকে ধরতে পারলেন না।

ঘটনাটি এতোটুকুই। এবং যে কোনো সফরে এমনটা ঘটা একদম স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের হৃদয়ে বক্রতা আছে তারা ঘটনাটিকে লুফে নিলো। কুৎসা রটাতে লাগলো। তবে যাদের হৃদয় পবিত্র তারা এসব শোনামাত্রই কানে আঙ্গুল দিয়ে বলতেনঃ আল্লাহ মহাপবিত্র! এটা সুস্পষ্ট অপবাদ ছাড়া কিছুই না।

আবু আইয়ুব (রা) তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে উম্মে আইয়ুব! যদি তোমার ব্যাপারে কেউ এমন মন্তব্য করতো, তুমি কি মেনে নিতে?” তার স্ত্রী জবাব দিলেন, “আল্লাহ মাফ করুন, কোনো অভিজাত নারীই তা মেনে নিতে পারে না।” তখন আবু আইয়ুব (রা) বললেন, “আয়েশা (রা) তোমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি অভিজাত। তাহলে তার পক্ষে এটা কিভাবে মেনে নেয়া সম্ভব!”

এ ঘটনা সব জায়গায় ছড়ানোর মূল হোতা ছিলো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। আমিরুল মুনাফিকুন। মুনাফিকদের সর্দার। ঘটনাক্রমে আরো তিনজন সম্মানিত সাহাবী এই কুচক্রে জড়িয়ে পড়েন। হাসসান ইবনে সাবিত (রা), হামনা বিনতে জাহশ (রা) আর মিসতাহ ইবনে আসাসাহ (রা)।

এদিকে আয়েশা (রা) মদিনা পৌঁছানোর পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তিনি ঘটনাটি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। রাসূল (সা) আর আবু বকর (রা) তাকে কিছুই জানালেন না। আয়েশা (রা) আর রাসূল (সা) এর মধ্যে খুবই উষ্ণ সম্পর্ক ছিলো সবসময়। রাসূল (সা), আয়েশা (রা)-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এক সাথে দৌড় খেলতেন, ইচ্ছা করে হেরে যেতেন। আয়েশা (রা) পাত্রের যে দিক দিয়ে পান করতেন, রাসূল (সা) সেদিক দিয়ে পানি পান করতেন।

আয়েশা (রা) অসুস্থ হলে তিনি দয়া আর কোমলতা প্রদর্শন করতেন। কিন্তু এবারের অসুস্থতায় আগের মতো কোমলতা প্রদর্শন করলেন না। আয়েশা (রা) লক্ষ্য করলেন রাসূল(সা) আর আগের মতো তার সাথে প্রাণ খুলে কথা বলেন না।

পুরো ব্যাপারটায় তিনি খুব কষ্ট পেলেন। তাই রাসূল(সাঃ) এর অনুমতি নিয়ে পিতৃগৃহে চলে গেলেন। তখনো তিনি আসল ঘটনাটি জানতেন না। পরবর্তীতে, একদিন রাতের বেলা প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে বের হলে মিসতাহ (রা)-এর মা তাকে পুরো ঘটনাটি জানান। নিজের ছেলেকে মা হয়ে অভিশাপ দেন। আয়েশা (রা)-এর কাছে তখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তিনি রাত-দিন অবিরত কাঁদতে থাকলেন।

এদিকে তার বিরুদ্ধে অপবাদকারীরা আরো জোরে শোরে তাদের কুৎসা রটাতে থাকে। প্রায় ১ মাস হয়ে যায়। কোনো মীমাংসা হয় না। মুনাফিক আর গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া সবাই বিশ্বাস করতো আয়েশা (রা) নির্দোষ ছিলেন। তারপরেও স্বচ্ছতার স্বার্থে রাসূল (সা) ঘটনার তদন্ত করলেন। তিনি উসামা (রা) আর আলী (রা)-এর সাথে পরামর্শ করলেন। উসামা (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পরিবার সম্পর্কে আমরা ভালো ভিন্ন আর কিছুই জানি না।” আলী (রা) ঘটনার আরো সুষ্ঠু তদন্তের জন্য রাসূল (সা) কে ঘরের দাসীদের জিজ্ঞেস করতে বললেন। দাসীকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বললো, “তার মধ্যে আমি দোষের কিছুই দেখি না। কেবল এতোটুকুই যে, তিনি যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়েন, আর বকরী এসে সব সাবাড় করে নিয়ে যায়।”

রাসূল (সা) বুকভরা কষ্ট নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। বললেন, “লোকসকল! মানুষের কি হয়েছে? তারা আমার পরিবার সম্পর্কে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তারা মিথ্যা বলছে আমার পরিবারের বিরুদ্ধে।”

রাসূল (সা) এরপর আবু বকর (রা)-এর গৃহে আগমন করেন। আয়েশা (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে আয়েশা! লোকেরা কি বলাবলি করছে তা তো তোমার জানা হয়ে গেছে। তুমি আল্লাহকে ভয় করো। আর লোকেরা যেসব বলাবলি করছে তাতে লিপ্ত হয়ে থাকলে তুমি আল্লাহর নিকট তওবা করো। আল্লাহ তো বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন।”

আয়েশা (রা) সে কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা সম্পর্কে বলেন, “আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে লক্ষ্য করে একথাগুলো বলার পর আমার চোখের অশ্রু সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। আমার সম্পর্কে কুরআন নাযিল হবে! আমার নিজেকে নিজের কাছে তার চাইতে তুচ্ছ মনে হয়েছে। তখন আমি বললামঃ আমার সম্পর্কে যেসব কথা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি কখনোই তওবা করবো না। আমি যদি তা স্বীকার করি তবে আল্লাহ জানেন যে আমি নির্দোষ আর যা ঘটেনি তা স্বীকার করা হয়ে যাবে। আমি ইয়াকুব (আ)-এর নাম স্মরণ করতে চাইলাম। কিন্তু মনে করতে পারলাম না। তাই আমি বললাম- ইউসুফ (আ) এর পিতা যা বলেছিলেন, তেমন কথাই আমি উচ্চারণ করবোঃ

“সুন্দর সবরই( উত্তম) আর তোমরা যা বলছো সে ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি।” (সূরা ইউসুফঃ১৮)

এ পর্যায়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হলো আয়েশা (রা) সম্পর্কে-

“যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্যে ততটুকু আছে যতটুকু সে গোনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্যে রয়েছে বিরাট শাস্তি।

যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।” (সূরা নূরঃ ১১,১৯)

আয়াত নাযিলের পর আয়েশা (রা) এর মা প্রচণ্ড খুশী হন। মেয়েকে বলেন: যাও মা! আল্লাহর রাসূলের শুকরিয়া আদায় করো। আয়েশা (রা) তখন এক বুক অভিমান নিয়ে বললেন: আমি কখনোই তার শুকরিয়া আদায় করবো না। বরং যেই আল্লাহতা’অ্যালা আমার নিষ্কুলষতার সাক্ষ্য দিয়েছেন, আমি কেবল তারই শুকরিয়া আদায় করবো।

বর্তমান সময়ের ইসলাম-বিদ্বেষীরা প্রশ্ন তোলে যে,

“যেহেতু আয়াত নাযিল হতে এক মাসের বেশী সময় লাগে, এতে কি বোঝা যায় না যে, মুহাম্মদ আসলে কনফিউজড ছিলেন যে তিনি কি ধরনের আয়াত উপস্থাপন করবেন? তিনি আসলে মাসিকের অবস্থা দেখে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন, আয়েশা নির্দোষ কি না! তা না হলে এক মাস অপেক্ষা কেনো?”

একেবারে কট্টর ইসলাম-বিদ্বেষী লেখকদের লেখা না পড়লে এ ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভব। সত্যি বলতে, আমি যখন পুরো ঘটনাটি পড়েছি নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে, তখন আমার ঈমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করছি।

লেখকরা যখন কোনো কিছু লিখেন তখন সে লেখায় তাদের জীবনের ছাপ ফুটে উঠে। এটা ফুটে উঠতে বাধ্য। এ ব্যাপারটা মানবীয়। যদি কুরআন সত্যিই রাসূল (সা)-এর নিজের আবিষ্কার হতো, তবে তিনি তৎক্ষণাৎ এ বিষয়ে আয়াত রচনা করতেন। কারণ, পৃথিবীতে তিনি তখন আয়েশা(রাঃ)-কেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। এক মাস অপেক্ষা করে জল-ঘোলা করার সুযোগ দিতেন না। এক মাসের বেশি বিলম্ব করাটাই প্রমাণ করে, কুরআন তার নিজের লেখা নয়।

আর কতোটা কুৎসিত মানসিকতার হলে, পুরো ব্যাপারটিকে মাসিকের দিকে টানা যায়? তারা বুঝাতে চান যে, রাসূল (সা) আসলে মাসিকের অবস্থা দেখে বুঝতে চেয়েছিলেন যে, সত্যিই আয়েশা (রা) এ গুনাহের কাজ করেছিলেন কিনা! এটা একটা হাস্যকর যুক্তি। কারণ--

প্রথমত, আয়েশা (রা) থেকে বেশ কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু তিনি কখনো মা হতে পারেননি। তাই অবশ্যই এভাবে রাসূল (সা) তাকে বিচার করবেন না।

দ্বিতীয়ত, আয়েশা (রা) তখন রাসূল(সাঃ) এর নিকটে ছিলেন না। তিনি পিতৃগৃহে চলে গিয়েছিলেন।

তৃতীয়ত, ওহী নাযিলের ঠিক আগেও রাসূল(সাঃ) গুনাহ করে থাকলে আয়েশা (রা)-কে তওবা করতে বলেছিলেন। যার অর্থ, ওহী নাযিলের আগে তিনি নিজে সিদ্ধান্ত দেননি এ ব্যাপারে।

স্যার উইলিয়াম মেইবার তার “লাইফ অফ মুহাম্মদ” গ্রন্থে ইফাক নিয়ে ভয়াবহ সব কথা লিখেছেন। যার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি নিজে থেকে গল্প ফেঁদেছেন। বর্তমান কালের ইসলাম বিদ্বেষীরা ধর্ম-গ্রন্থের মতোই এসব বানোয়াট কথাকে আঁকড়ে ধরেছে। তিনি আয়েশা(রাঃ) কে চরিত্রহীন প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যেমনঃ একবার হাসসান (রা) অনুতপ্ত হয়ে আয়েশা (রা) কে কবিতা শোনান-

“তিনি পবিত্র, ধৈর্যশীলা, নিষ্কলঙ্ক-নির্দোষ।

তিনি সরলা নারীর গোশত খান না।”

স্যার উইলিয়াম মেইবার এই কবিতা নিয়ে লিখেন- "হাসসান অতি চমৎকার কবিতা রচনা করলেন। তাতে আয়েশা এর পবিত্রতা, সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা আর নিখুঁত কমনীয় দেহের বর্ণনা ছিলো। তোষামদে ভরা এ স্তুতিকাব্য আয়েশা ও হাসানের মনোমালিন্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখলো।”

এ ধরনের মন্তব্য খুব হাস্যকর। কারণ, হাসসান(রাঃ) যখন এ কবিতাটি পাঠ করেন তখন আয়েশা(রাঃ) এর বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। তখন তার দেহ কমনীয় কি করে হয়? যখন আমরা জানি, পনের-ষোল বছর বয়সেই তার দেহ ভারী হয়ে গিয়েছিলো।

তিনি লিখেছেন, “যেহেতু নিখুঁত কমনীয় দেহের প্রতি আয়েশার ভীষণ গর্ব ছিলো, তাই লাইনটি শুনে তিনি অতি মাত্রায় উৎসাহিত হয়ে পড়েন। উৎসাহের আতিশায্যে কবিকে থামিয়ে বলেন- কিন্তু তুমি তো এমন নও।”

আসলে লেখকের গোলমাল পাকিয়েছে এই লাইনে- “তিনি সরলা নারীর গোশত খান না।” সম্ভবত তিনি জানেন না, আরবী ব্যাকরণে “কারো গোশত ভক্ষণ করা” বলতে গীবতকে বোঝানো হয়। এ লাইন দ্বারা হাসসান (রাঃ) বুঝিয়েছিলেন, আয়েশা (রা) কখনো কোনো নারীর গীবত করেন না। এ কথা শুনে আয়েশা (রাঃ)-এর ইফকের ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিলো। হাসসান(রা) নিজেই তার উপর অপবাদ আরোপ করেছিলেন। তাই তিনি বুঝিয়েছিলেনঃ হে হাসসান! তুমি তো এমন নও। তুমি তো ঠিকই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিলে। তিনি মোটেই এ কথা বোঝাননি যে, তিনি দেখতে খুব সুন্দর আর হাসসান (রা) কুশ্রী।

অনেক কুযুক্তি দেয়ার পরেও শেষে স্যার উইলিয়াম মেইবার অবশ্য কিছুটা হতাশ হয়ে লিখতে বাধ্য হন- “আয়েশার আগের জীবন আমাদের জানায়, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলেন।”

ইসলাম বিদ্বেষীরা যেখানে কুৎসা রটনা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না, সেখানেও আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের জন্য চমৎকার কিছু শিক্ষা রেখে দিয়েছেন। আমরা শিখতে পেরেছি, একজন সতী নারীর উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করা হলে তার কী করা উচিত? উন্নত দেশে যেখানে ধর্ষণের শাস্তি হয় না, সেখানে কুরআন সতী নারীদের উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি আরোপ করেছে-

“যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতঃপর স্বপক্ষে চার জন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। এরাই না’ফারমান।” (সূরা নূরঃ৪)

মিসতাহ (রা) ভুলক্রমে এ কুৎসায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। অথচ তার ভরন-পোষণ করতেন আবু বকর(রাঃ)। নিজের মেয়েকে এ অপবাদ দিতে দেখে, আবু বকর (রা), মিসতাহ (রা)-কে আর সাহায্য করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তখন এ আয়াত নাযিল হয়ঃ

“তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চমর্যাদা ও আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্নীয়-স্বজনকে, অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষক্রটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।” (সূরা নূরঃ২২)

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ