মতিউর রহমান নদভি।।
১৮৫৭ সালে যুদ্ধপরাজয়ের পর রাজ্যের অবস্থা অতি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেলো। তার পূর্বে মোঘল ও অন্যান্য বাদশাদের রাজত্বে দেশ বা রাজ্য উন্নতি ও পরিপূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়েছিলো। ভারত উপমহাদেশ নিরাপদ ও শান্তির সাথে সাথে তৎকালীন পৃথিবীর মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছিলো। এবং দুনিয়াব্যাপী একটি দৃষ্টান্ত মূলক উন্নত রাজ্যের রূপ ধারণ করলো। কিন্তু দেশটা মোগল সম্রাটদের থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার কারণে রাজ্যের অবস্থান সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো।
১৮৫৭ সালের আক্রমনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইংরেজরা হিন্দুস্থানের স্থায়ী অধিবাসীদের মূল লক্ষ্য বানাতে শুরু করল। সুতরাং আজাদি আন্দোলনে উলামায়ে কেরাম অগ্রগামিতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্য বিশেষ কিছু উলামায়েকেরামকে চালাকি করে দোষী বানিয়ে কারগারে দেওয়া ও নেতাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া তাদের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হলো। দেশটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়লো। দীনের কেন্দ্রগুলো একেবারেই নিঃস্ব হয়ে রাজ্য কেবল নাম মাত্রই ছিলো।
ক্ষমতা ছিলো মূলত ইংরেজদের হাতে। ফলে মুসলমানদের ক্ষমতা নিজ পরিবার ও দুর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। এই পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, দেশটা দীন ও ইলমের দিক দিয়ে পিছনে চলে যায়। এমতাবস্থায় খানুদা ফরাঙ্গী নামক স্থানে এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম হলো, যিনি তার জ্ঞান, যোগ্যতা ও পূর্ণতায় জগতকে আলোকিত করলেন। যার অবদান দুনিয়া ভুলতে পারবে না।
মাওলানা আব্দুল হাই বিন আব্দুল হালিম সাহালবী লাখনভি একজন খানুদা ফরাঙ্গী সাহালের বাসিন্দা ছিলেন। ফরাঙ্গী সাহালের একটি ফ্রান্সি ব্যবসায়ীর বানানো বাড়ি ছিলো। তার দেশে ফিরে আসার পর সে রাজত্বের মালিক হয়ে গেলো। এবং যখন ১১০৫ হিজরী সনে মোল্লা কুতুবুদ্দিন সাহালবীর শাহাদত হলো, তখন তার ছেলে মোল্লা আসাদ ঐ পরিস্থিতে আওরঙ্গজেব আলমগীরের সাথে ছিলেন। মোল্লা কুতুবুদ্দীন এবং সন্তানাদিদের ফরাঙ্গী সাহাল দান করলেন। সুতরাং তার সন্তানেরা সাহালী হতে লাখনোতে স্থানান্তরিত হন। ঐ খানুদাতে তাফসির, ফিকাহ, হাদিস, লুগাত, মানতেক, ফালসাফা এবং রিয়াজিয়াত ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় দেড়শত উলামায়েকেরাম হলেন। যার আলোচনা এনায়েতুল্লাহ ফরাঙ্গী মহল্লি তার কিতাব তাজকিয়ায়ে উলামায়ে ফরাঙ্গী মাহালের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। সেই কিতাবটা তিনি ১৩৪৭ হিজরীতে লেখেন।
আব্দুল হাই লাখনবীর বংশ ধারাবাহিকতা এরূপ- আ: হাই বিন আ: হালিম বিন আমিনুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আকবর বিন আ: রহিম বিন মুহাম্মদ ইয়াকুব বিন আ: আজিজ বিন মুহাম্মদ সাঈদ বিন শহীদ কুতুবুদ্দীন আনসারী সাহালবী লাখনবী। মাওলানার বংশ ৪৩ তম মাধ্যম গিয়ে সায়্যিদিনা হযরত আবু আইয়্যুব আনসারী রা. পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। মাওলানার বংশ মদীনা মুনাওয়ারা থেকে হাররাত এবং সেখান থেকে সাহলিতে পৌছায়।
আ: হাই লাখনবী রাহ: নিজেই লিখেছেন, আমাদের পিতামহদের মধ্য হতে কিছু সংখক মানুষ মদীনা থেকে হাররাতে আসেন। সেখান থেকে দিল্লিতে, ওখান থেকে পুনরায় সাহলিতে আসেন। এবং সাহলিতে মোল্লা কুতুবুদ্দীনের কবর অবস্থিত। মাওলান আ: হাই ফরাঙ্গী মহল্লি ১২৬৪ হি: সনে বান্দাহ নামক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। ঐ সময় তার পিতা আঃ হালিম মাদ্রাসায়ে আমিরে নাওয়ায জুলফিকারের উস্তাদ ছিলেন। মাওলান নিজেই তার জন্ম তারিখ এভাবে বর্ণনা করেন।
২৬ এ জ্বিলকদ মঙ্গলবার, ১২৬৪ হি: । তিনি ইলম আমলের পরিবেশে বড় হয়েছিলেন। তার পিতা একজন আলেম ও তার মাতা একজন দীনদার ধর্মপন্থী মহিলা ছিলেন। মাওলানা পাঁচ বছর বয়স থেকে কুরআন হেফজ করা শুরু করেন এবং দশ বছর বয়সে ফার্সি প্রাথমিক কিছু কিতাব পাঠের সাথে সাথেই হেফজ শেষ করেন এবং তারাবিতে শুনান। তিনি হেফজ শেষ করার পর মাত্র সতের বসর বয়সে নাহু, সরফ, বালাগাত, মানতেক, ফালসাফা, হাদিস, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ ও তাফসির শেষ করেন।
১২৭৭ হিজরীতে তার পিতার সাথে হায়দারাবাদে চলে যান। যেখানে নবাব সুজাউদ্দৌলা মুখতারুল মালিক তুরাবে আলী যুদ্ধের সেনাপতি অনেক সম্মান করলেন। ও মাদ্রাসায়ে নিজামিয়ায়ে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করে দেন। এখানে তার পিতার সাথে একাগ্রচিত্তে দুবছর বিভিন্ন বিষয়ের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করার সুযোগ পেলেন।
১২৭৯ হিজরীতে দুই মনীষী একত্রে হজ করার জন্য যান। পরে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তাকে দক্ষিণ হায়দারাবাদের মজলিসে শুরার সভাপতি বানিয়ে দেন। ১২৮৩হি: সনে মাওলানার পিতা দক্ষিণ নিজামি থেকে ফিরে আসার অনুমতি চাইলেন ও নিজ বাসিস্থানে এক বছর অবস্থান করলেন। ঐ সুযোগে মাওলানা আ: হাই এর বিবাহ দিলেন। সেই সময় তার বয়স ছিলো উনিশ বছর। মাওলানা তার সারা জীবন শিক্ষা-দীক্ষা রচনা সংকলনের মধ্যেই ছিলেন। এর মাঝেই তিনি মর্মান্তিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যার কারণে মানুষ তার জীবনের আশা ভরসা ছেড়ে দিয়েছিল।কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে আবার মহান কাজের সুযোগ দিয়েছেন।
এমনিভাবে বিভিন্ন কাজকর্মের ভিতর দিয়েও শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তার কিতাব ‘আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ’ এর মধ্যে এবং আল্লামা হিন্দ রহ. ফখরুল মুতায়াখখিরিন আ: হাই লাখনভি তার কিতাবের সংখ্যা একশতটি লিখেছেন। তার মধ্যে ছিয়াশিটি কিতাব আরবি ভাষায় লিখেছেন।
তিনি অগণিত কাজকর্মের মধ্যে ইলমি তাহকিকি এবং বিভিন্ন বিষয়ের কিতাবাদি লেখার সাথে সাথে তা শিক্ষা দেওয়ার পরে এই আলেমে রাব্বানী মাএ উনচল্লিশ বছর বয়সে ১৩০৪ হিজরি সনে আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিলেন। তার জানাজায় জনসাধারণের ব্যাপক সমাগমের কারণে তার জানাজা তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। এবং বাগে মৌলভী আনয়ারুল হক নামক স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। তার ছাত্র মৌলভী আব্দুল আলী আল মাদরাজির এই কবিতা হযরতের তরবিয়তে লিপিবদ্ধ করেন।
‘হে যিয়ারতকারি! একটু দাড়াও এই মাজারে সুরা ইখলাস, সুরা ফাতিহা ও দুয়া কালাম পাঠ করো। তাতে আছে আব্দুল হাই জগতের ইমাম। নিশ্চয় তিনি প্রত্যেক জ্ঞানের সঠিক পথিক। হযরতের অসংখ্য ছাত্র ছিল, যাদের সংখ্যা অনেক বেশি। এভাবে তার বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলী আছে, যা বিশ্বজুড়ে বহুল প্রসিদ্ব। যেগুলোর সংখাও অনেক। সেসব কিতাব থেকে কিয়মত অবধি মানুষ উপকৃত হতে থাকবে ইনশা আল্লাহ।
অনুবাদ: আবু বকর
সূত্র: আরমোগান বাংলা
এনটি