মোস্তফা ওয়াদুদ: মাইনুদ্দীন আহমেদ। জেনারেল পড়ুয়া এক তরুণ যুবক। সম্প্রতি তিনি দাবি করেছেন তিনি একটি মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস দিয়েছেন। শেষ করেছেন ইফতাও। সেইসাথে আরব থেকে তিনি পড়েছেন অসংখ্য কিতাব। যার ফিরিস্তি অনেক লম্বা। এ সকল কিতাব যাদের কাছে পড়েছেন তাদের ফিরিস্তিও একেবারে ছোট নয়। শায়েখ মাইনুদ্দীন আহমেদ নিজেকে হাম্বলী মাযহাবের ইমাম বলে দাবি করছেন। তিনি বলেছেন আমি বাংলাদেশের হাম্বলী মাযহাব কে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার না আছে কোন পড়াশোনা? না আছে কোন একাডেমিক পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু তিনি খুলে বসেছেন একটি অনলাইন একাডেমি। সেখানে তাঁর কাছে দরস নিচ্ছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীরা।
যার কিনা নিজের একাডেমিক সার্টিফিকেট নেই কিংবা নেই কোন পড়াশোনার সনদপত্র। তিনি কিভাবে একটি একাডেমী পরিচালনা করেন? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। শায়েখ মাইনুদ্দীন আহমেদের বিপক্ষে এসেছে নানা রকম মন্তব্য। কিন্তু এর যুক্তি সংগত কোন জবাবই দিতে পারেননি তিনি।
তার বিষয়ে সর্বপ্রথম ‘উস্তাদ মাইনুদ্দীন আহমেদের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন’ শিরোনামে ‘জিম তানভীর’ নামক এক আইডি থেকে তার একাডেমিক বিষয়ে বেশ কিছু আপত্তি তুলে ধরেন। এরপরই সরগরম হতে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিষযটি একেেএক পোস্ট আসতে থাকে বিভিন্নজনের আইডি থেকে।
কী ছিলো জিম তানভীর আইডির আপত্তিমূলক লেখায়?
উস্তাদ মাইনুদ্দীন আহমেদরে ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন’ শিরোনামে ‘জিম তানভীর’ লেখেন, ‘অনেকেই মাইনুদ্দীন আহমেদের একাডেমিক সার্টিফিকেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ কারণে আমি মাইনুদ্দীন আহমাদের ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর করার চেষ্টা করেছি। খোঁজখবর করার পর যা পেয়েছি তার কারণে উনার ব্যাপারে আমার খুব সিরিয়াস কিছু সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
বিশেষত, তিনি একটা ইসলামি একাডেমি চালাচ্ছেন এবং অনেক শিক্ষার্থী সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে উস্তাদ মাইনুদ্দিন যেসব দাবি করেছেন সেগুলোর ব্যাপারে যেসব কারণে আমার সন্দেহ হচ্ছে, প্রথমে সেগুলো সংক্ষেপে বলছি।
১) অসঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ পড়াশুনার যে বিবরণ এবং টাইমলাইন তিনি দিয়েছেন তা মিলে না। ছয়/সাত বছরের মধ্যে ৩টি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের কোর্স, দুটি দাওরা, দুটি ইফতা, মাস্টার্স ইত্যাদির যে বিবরণ আছে তা প্রায় অবিশ্বাস্য।
২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রদানঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম, কোর্স, ধরণ ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেয়া পরস্পরবিরোধী তথ্য, এবং এধরণের বিভিন্ন পোস্ট ডিলিট করে দেয়া।
৩) তিনি আরবের যে দুটি একাডেমি থেকে কোর্স সম্পন্ন দাবি করেছেন তার মধ্যে একটি খুজে পাওয়া যায়নি। অন্য একাডেমিতে যতোটুকু সময় পড়লে আলিমদের পক্ষে থেকে সার্টিফিকেশন এবং রেকোমেন্ডেশান লেটার দেয়া হয় ততোটুকু সময় তার নিজের সাক্ষ্য অনুযায়ীই তিনি সেখানে পড়েননি।
৪) তিনি বিশ্বের বিভিন্ন আলিমের কাছ থেকে ইজাযাহ পাবার কথা বলেছেন, এছাড়া হানাফি ফিকহের ৫টি কিতাবের ওপর ইজাযাহ পাবার কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানে যতোটুকু সময় পড়ার দাবি করেছেন সেগুলো থেকে এই ইজাযাহগুলো পাওয়া সম্ভব না।
৫) সিলসিলাবিহীন ইলমঃ তার শিক্ষাগত যোগ্যতার তার একান্ত ঘনিষ্ঠ ভাই/ছাত্র ছাড়া আর কোনো সাক্ষী না থাকা। বারবার বলার পরও পাবলিকলি কোনো প্রমাণ না দেখানো। সাধারণত, একজন ছাত্রের উস্তায, সহপাঠী এবং সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে একটা সামাজিক গ্রুপ থাকে। অনলাইনে মাইনুদ্দিনের সাথে পড়াশুনার সূত্রে পরিচিত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এবার এ প্রতিটি পয়েন্টের ব্যাপারে আমি কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যারা এ পোস্ট পড়ছেন তাদের যে কেউ এই তথ্যগুলো যাচাই করতে দেখতে পারেন। বিস্তারিত পরে থাকছে।
২০১২-২০১৮ এই সময়ে উস্তাদের ব্যাপক পড়াশোনা
উস্তাদ মাইনুদ্দীন আহমাদ এর ব্যাপারে আমার প্রথম সন্দেহ হয় যখন দেখি তিনি ফেইসবুকে Work and Education সেকশনে ইলমি পড়াশোনার বিশাল একটি তালিকা দিয়েছেন। বেশ অল্প সময়ের ব্যবধানে ৩টি আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের পড়াশোনা, ২টি দাওরা, ২টি ইফতা, ১টি মাস্টার্সে ২ বছর ধরে এনরোলড হয়ে থাকা সহ আরো অনেক কোর্স -- এটাই প্রথম খটকার কারণ -- আদৌ কি এগুলো তিনি সম্পন্ন করেছেন? দেখা যাক, এই অল্প বয়সে তিনি যেসব দীর্ঘমেয়াদী ডিগ্রী নিয়েছেন এবং কখন নিয়েছেন?
১) Darul Uloom Online (DUO) থেকে ৫ বছর আলিম প্রোগ্রাম + ১ বছর দাওরা হাদীস কোর্স।
২) International Open University (IOU) থেকে ৪ বছর মেয়াদী ব্যাচেলর ইন ইসলামিক স্টাডিজ।
৩) আরবের দুইটি একাডেমি থেকে শরীয়াহ ও ফিক্বহ এর ওপর দুটি কোর্স – একটি ২ বছরের, আরেকটি ৪ বছরের।
এই দীর্ঘমেয়াদী এবং বেশ ইন্টেন্সিভ এই কোর্সগুলো তিনি করেছেন মোটামুটি একই সময়ে বা একইসাথে। তিনি দাবি করেন, DUO-তে ভর্তি হয়েছেন SSC পরীক্ষার পর এবং IOU-তে ভর্তি হয়েছেন HSC পরীক্ষা পর। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাক্রমে ৬ ও ৪ বছরের পড়াশোনা শেষ করেছেন ২০১৮ (DUO) ও ২০১৭ (IOU) সালে। সে হিসাব অনুযায়ী তিনি ২০১২-তে SSC এবং ২০১৪-তে HSC পরীক্ষা দিয়েছেন, তবে কিছুটা এদিক ওদিক হতেই পারে।
DUO এবং IOU – এ দুটো পড়াশোনা আন্ডারগ্র্যাড বা অনার্স লেভেলের পড়াশোনা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে ২০১৩ থেকে ২০১৭ - এ সময়ে তিনি DUO এবং IOU – এ দুটো আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের পড়াশোনা একসাথে চালিয়েছেন। বিষয়টা একদম অসম্ভব না হলেও, বেশ অস্বাভাবিক বটে।
অস্বাভাবিকতার মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন আমরা দেখবো আরবের দুটি অনলাইন একাডেমি থেকে ২ ও ৪ বছর মেয়াদী কোর্সগুলোও তিনি একই সময়ে করেছেন! তার ফেসবুক প্রোফাইল অনুসারে আরব একাডেমির এই কোর্সগুলো শেষ করেছেন ২০১৪ সালে। অন্যদিকে তিনি দাবি করেছেন SSC এর পরে মাত্র বেসিক লেভেলের ‘আল-আরাবিয়্যাতু লিন নাশিয়্যিন’ পড়া মাত্র শুরু করেছেন, সেটা আনুমানিক ২০১২ সালে। যদি ২০১২ সালে তিনি আরবি শেখা শুরু করেন, তাহলে প্রশ্ন উঠে, ২০১৪ সালের মধ্যে তিনি কীভাবে পরিপূর্ণ আরবি মাধ্যমে পড়ানো ৪ বছরের একটি কোর্স শেষ করতে পারেন?
এছাড়া তিনি দলীলপ্রমাণসহ আরও অনেক লেখা লিখেন। এরপর তিনি লিখেন, ‘দাওরা হাদীস ও ইফতায় পড়াশোনা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী তথ্য ও নাম বিভ্রাট’ নিয়ে।
এখানে তিনি লিখেন, ‘উস্তাদ মাইনুদ্দীন আহমাদ তার দাওরা হাদীস ও ইফতার মাদরাসার নাম, সময়কাল ও লোকেশন নিয়ে অনেকগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ ও সন্দেহজনক তথ্য দিয়েছেন। ‘জেনারেল থেকে যেভাবে ইলমের পথে আসলাম’ শীর্ষক পোস্টটি দেওয়ার এক সপ্তাহ পর (১৮ জুলাই, ২০১৯) দাবি করেছেন তিনি আবদুল্লাহপুর এর একটি মাদ্রাসায় ‘তাখাসসুস ফিল ইফতা’তে ভর্তি হয়েছেন। (এই পোস্টটিও তিনি ডিলিট করে দিয়েছেন)। এর ৮ মাস পর, ২০২০ এর মার্চ মাসে উস্তাদ ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়েছেন তার ইফতা পড়া শেষ হয়েছে এবং উস্তাদরা তাকে পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। আর এ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারির একটি পোস্টের কমেন্টে তিনি লিখেছেন যে, তিনি দাওরা হাদীস সম্পন্ন করেছেন আশুলিয়া ৩০০ ফিট এলাকার একটি মাদ্রাসা থেকে। পুরো বিষয়টায় অনেকগুলো পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে।
১) মাদ্রাসার নামে বিভ্রাট - তিনি ইফতা ভর্তি হয়েছেন আবদুল্লাহপুর এর মাদ্রাসায় (জুলাই ২০১৯), কিন্তু পাশ করেছেন কাওলা, বনরুপা রোড এর একটি মাদ্রাসা থেকে (মার্চ ২০২০)।
২) কোর্সের নামে বিভ্রাট - জুলাই ২০১৯ এর পোস্টে তার কোর্সের নাম ছিল ‘তাখাসসুস ফিল ইফতা’, কিন্তু মার্চ ২০২০ এ তার পাশ করা কোর্সটির নাম ফেসবুক পোস্ট অনুযায়ী ‘তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ ওয়াল ইফতা।'
৩) মান নিয়ে প্রশ্ন - কোর্সটির মেয়াদ মাত্র ৮ মাস। সাধারণত ইফতা করতে ১ বছর লাগে। ৮ মাসে ইফতা শেষ হওয়া অসম্ভব না যদিও, লো-কোয়ালিটির পড়াশোনা খুব দ্রুতই শেষ করা সম্ভব। যেমন লন্ডনে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে অনেক বাঙ্গালি কলেজ চালাতো, যেগুলাকে বলা হতো ভিসা কলেজ। তদ্রুপ্র বাংলাদেশেও হয়তো ৮ মাসে ইফতা শেষ করে দেওয়া অসম্ভব কিছু না, তবু মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। উস্তাদ তার পেইজে ইফতা শেষ করার ঘোষণা দিয়ে যে পোস্ট দিয়েছেন সেখানে একজন জিজ্ঞেস করেছেন, ইফতা ক'বছর লেগেছে। উস্তাদ উত্তর দেন, ইফতা ১ বছর। অথচ তিনি ইফতা শেষ করেছেন মাত্র ৮ মাসে। ১১ আগস্ট বলেছেন, ভর্তি হবেন। ১৮ আগস্ট বলেছেন, ভর্তি হয়েছেন। পরের বছর মার্চে বলেছেন, পাস করেছেন।
৪) ব্যাকরণ বিভ্রাট - যে মাদ্রাসা থেকে তিনি ইফতা করেছেন তার নাম তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন আল-জামিয়াতুল মুহাজিরীন। আরবি ব্যাকরণ অনুসারে এখানে ভুল আছে, এখানে ‘আল’ হবে না, সঠিক নাম হবে জামিয়াতুল মুহাজিরীন। ইফতা কোর্স করা এমন একটা মাদ্রাসায় এত বড় ভুল আছে - বিষয়টা সন্দেহ উদ্রেককারী।
৫) তিনি ফেব্রুয়ারি ২০২১ এর দেওয়া পোস্টের একটি কমেন্টে লিখেছেন দাওরা ও ইফতা – তিনি ভিন্ন দুটি মাদ্রাসা থেকে সম্পন্ন করেছেন, তবে মাদ্রাসা দুটোর নাম কাছাকাছি। তার পরিচালিত ওয়েবসাইট hanbalifiqh.com এর about সেকশনে তার প্রোফাইল আছে, সেখানে লেখা আছে, ‘আল-জামিয়াতুল মুহাজিরীন’ হতে তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ ওয়াল ইফতা’ ও ‘আল-জামিয়াতুল মুহাজিরীন আল-ইসলামিয়্যাহ’ হতে দাওরায়ে হাদীস’ দুটো নামই ব্যকরণগত ভাবে ভুল। এখানে ‘আল’ হবে না। তবে তিনি যখন তার প্রতিষ্টান Islamic Online Academy এর ওয়েবসাইটে তার মাদ্রাসার নাম লিখেছেন, সেখানে তিনি শুধরে নিয়েছেন, ‘আল’ মুছে দিয়েছেন। যদিও ২৩ মার্চ ২০২০ এর পোস্টের কমেন্টে তার দাবি, তিনি তার মাদ্রাসায় অনুরোধ করা সত্ত্বেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসার নাম সংশোধন করেনি। অন্যদিকে IOA ওয়েবসাইটে তিনি তার যোগ্যতায় লিখেছেন,
‘জামিয়াতুল মুহাজিরীন’ হতে তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ ওয়াল ইফতা’
‘জামিয়াতুল মুহাজিরীন আল-ইসলামিয়্যাহ’ হতে দাওরায়ে হাদীস’
৬) লোকেশন বিভ্রাট (১) - তার দেওয়া তথ্য অনুসারে ইফতা করা মাদ্রাসার নাম জামিয়াতুল মুহাজিরীন, যেটা কাওলা, বনরুপে রোডে অবস্থিত। এই নামে কাওলা, বনরুপা রোডে কোনো মাদ্রাসা কি আদৌ আছে? লোকমুখে শুনেছি, নেই, তবে আতিপাতি করে খুঁজে দেখলে একটা মাদ্রাসার দেখা মিলতেও পারে।
৭) লোকেশন বিভ্রাট (২) - তার দেওয়া তথ্য অনুসারে দাওরা হাদীস করা মাদ্রাসার নাম জামিয়াতুল মুহাজিরীন আল-ইসলামিয়্যাহ, যেটা অবস্থিত হবার কথা আশুলিয়া ৩০০ ফিট এলাকায়। qawmimadrasah.com নামে একটি ওয়েবসাইট আছে যেখানে ঢাকা, গাজীপুর আর নারায়ণগঞ্জ জেলার সমস্ত ক্বওমি মাদ্রাসার তালিকা আছে। ২০১৯ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করা। এই ডিরেক্টরি চেক করে আমি দেখেছি, ‘আল-জামিয়াতুল মুহাজিরীন নামে কোনো মাদ্রাসা কাওলা, বনরুপা রোডে নেই (ইফতার মাদ্রাসা)।
আল-জামিয়াতুল মুহাজিরীন আল ইসলামিয়্যাহ নামে কোনো মাদ্রাসা আশুলিয়াতে নেই (দাওরা হাদীসের মাদ্রাসা)।
অর্থাৎ, যে মাদ্রাসা দুটো থেকে তিনি ইফতা ও দাওরাহ শেষ করেছেন বলে দাবি করেছেন, তার কোনোটাই ডিরেক্টরিতে পাওয়া যায় নি।
৮) তবে হ্যাঁ, ‘জামিয়াতুল মুহাজিরীন’ -- এই নামে একটি মাদ্রাসা আসলেই ঢাকা শহরে আছে। তবে সেটা উস্তাদের তথ্য অনুযায়ী কাওলা, বনরুপা রোড কিংবা আশুলিয়া নয়, সেটা হচ্ছে ফায়দাবাদে (আবদুল্লাহপুরের কাছাকাছি)। এই মাদ্রাসার নাম উপরের ডিরেক্টরিতে আছে, বাস্তবেও এই নামে মাদ্রাসা আছে, তবে এই মাদ্রাসায় সম্ভবত ইফতা কোর্স নেই। থাকলেও কিছু আসে যায় না কারণ উস্তাদ ফায়দাবাদের মাদ্রাসা থেকে ইফতা বা দাওরাহ করেননি।
কাজেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বনরুপা, কাওলা এবং আশুলিয়া ৩০০ ফিটের আল জামিয়াতুল মুহাজিরীন এবং আল-জামিয়াতুল মুহাজিরীন আল ইসলামিয়া নামের এই দুটো মাদ্রাসা কি আসলেই অস্তিত্বমান? ডিরেক্টরিতে না-থাকা এই মাদ্রাসাগুলো বাস্তবে আসলে কোন কোয়ালিটির মাদ্রাসা? আর সেই পুরোনো প্রশ্ন - আদৌ কি তিনি এসব পড়াশোনা করেছেন?
৯) এখানেই শেষ নয়, তার ইফতা আবার একটা নয়, দুটো। একটা অফলাইন – হানাফি, যেটা মার্চ ২০২০ সালে শেষ করেছেন। আরেকটা অনলাইন - হাম্বলি। উস্তাদের মাস্টার্স ছাড়া সবকিছুই মিনিমাম ২টা করে।
পুরো বিষয়টা যদি আমি সারসংক্ষেপ করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে,
১) উস্তাদ মাইনুদ্দীন আহমাদ এর আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের পড়াশোনা ৩টি বা আরো বেশী। ক) IOU (৪ বছর) এবং খ) DUO (৬ বছর)। গ) আরবের দুটি একাডেমি থেকে তিনি ২ ও ৪ বছরের কোর্স করেছেন, সেটাকে কম্বাইন্ড করলেও একটা আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের পড়াশোনা ধরা যেতে পারে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ২০১৩-২০১৮ এই সময়টার মধ্যে তিনি মোটামুটি ৩টা আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেছেন।
২) তিনি দাওরা হাদীস করেছেন দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে ক)DUO (অনলাইন) এবং খ)আল জামিয়াতুল মুহাজিরীন আল-ইসলামিয়া (ডিরেক্টরিতে নাম খুঁজে পাওয়া যায় নি।)
৩) তিনি ইফতা করেছেন দুটো – ক) আল জামিয়াতুল মুহাজিরীন মাদ্রাসা থেকে অফলাইন ৮ মাসের হানাফি ইফতা (ডিরেক্টরিতে খুঁজে পাওয়া যায় নি, লোকমুখেও খুঁজে পাওয়া যায় নি) এবং খ) হাম্বলি ইফতা (অনলাইন, শেষ করেছেন কিনা লেখেননি)।
জিম তানভীরের লেখা বিষয়ে একটি লম্বা জবাব নিজের Mainuddin Ahmad নামক ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন তিনি। তাতে তিনি লিখেন, আলহামদুলিল্লাহ, সম্প্রতি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে বেশ কিছু আপত্তি তুলেছেন ফেসবুকে এক্টিভ এক ভাই। তিনি পোস্টে হাইলাইট করেছেন ‘উস্তায মাঈনউদ্দীন আহমাদের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন’।
২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত DUO থেকে ৬ বছরের কোর্স, IOU এর ডিপ্লোমা ও অনার্স, আরবের দুটি একাডেমী হতে কিছু কোর্স, সিকার্সহাবের কোর্স সম্পন্নি করেছি-এটা দেখলেই যদি কারও কাছে কারামত মনে হয়, তাহলে বলবো বহু মানুষের ‘কারামত’ হয়তো তিনি দেখেননি! অল্প কয়েকদিনে পুরো কুরআন হিফয করেছেন এমন ঘটনা বেশ শুনা যায়, তাই না? আমার জন্য যা অসম্ভব তা অন্যের জন্যও অসম্ভব, এমনটা ভাবা ভুল ও অন্যায়!
দেশীয় মাদ্রাসা থেকে দাওরা ও ইফতা পাশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি দাওরায় প্রথমে যেই মাদরাসায় ভর্তি হই, সেখানে আমার ভর্তির সময় মানযুরুল কারীম ভাই ছিলেন; পরবর্তীতে আমি সেখানে ক্লাস করতে পারিনি, বেশ দূর হওয়ার কারণে ও আমার অসুস্থতা, ক্লাসের রুটিন আমার দৈনন্দিন রুটিনের সাথে ম্যাচ না করার কারণে। তাই বাসার কাছাকাছি কাওলায় আল-জামিয়াতুল মুহাজিরিনে ভর্তি হই। এখানে আমি ও মানযুরুল কারীম ভাই তার পাশের এলাকায় একত্রে একই মাদ্রাসায় (মাদ্রাসাতুল ইমদালিল উলুম) এ ভর্তি হই। একত্রে একটি লাইব্রেরি থেকে বই কিনি। ভর্তির পর তিনি ও আমি কেউই রেগুলার হতে পারিনি, পরে অবশ্য তিনি সম্ভবত রেগুলার হয়েছেন ও সেখান থেকে বের হয়েছেন; কিন্তু আমি তখন আল-জামিয়াতুল মুহাজিরিনে ভর্তি হই।
তিনি এখানে মানযুরুল কারীম ভাই বলে যাকে উল্লেখ করছেন, ‘তিনি তার Manzurul Karim (منظور الكريم ) নামক ফেসবুক আইডিতে এ বিষয়ে লিখেন, সে (মাইনুদ্দীন আহমেদ) বাংলাদেশ থেকে দাওরা দিতে চেয়েছিল। আমি আমার মাদরাসা দারুল উলুম দক্ষিণখানে তাকে নিয়ে যাই৷ তারা দাখিলা দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে আমার উস্তাদ মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ (খতিব ও ইমাম কুড়িপারা জামে মসজিদ উত্তরখান) এর মাধ্যমে একটা লিংক পেয়ে উত্তরখান ফায়দাবাদের জামিয়াতুল মুহাজিরিনে নিয়ে যাই৷ সেখানকার নাযেম সাহেব তার দাখিলা নেন প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবার জন্য৷ সে যাবতীয় ফরমালিটিস পূরণ করে। তবে সেখান থেকে সে দাওরা দেয় নি৷ কেননা তার বক্তব্যমতে তার মা অসুস্থ ছিল। পরে সে আমাকে জানায় একটা মাদ্রাসা থেকে সে দাওরার সার্টিফিকেট নিয়েছে সেখানকার মুহতামিম তাকে মুহাব্বাত করে তিনি দিয়েছেন।কেননা তার তো DOU এর দাওরা আছেই। আমি আমার তাখাসসুসের মাদ্রাসায় তাকে ইফতায় ভর্তি হতে বলি৷ তবে সে এখানে থাকেনি। বলেছে দূর হয়ে যায়৷ পরে আমাকে জানায় যে একটা মাদ্রাসা থেকে ইফতা করেছে।’
এদিকে আরবের একাডেমীর বিষয়ে মাইনুদ্দীন আহমেদ লিখেন, আরবের যেই দুটি একাডেমীতে পড়েছি, সেগুলো বেশ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই সেগুলোর কিছুই ইন্টারনেটে নেই। কেবল ইজাযাহ, সনদ ও সার্টিফিকেট আমার কাছে আছে। এসব দেখেও কারও বিশ্বাস না হলে আমার কিছুই করার নেই।
তার এ বন্ধ হয়ে যাওয়া একাডেমীর বিষয়ে আহমাদ আব্দুল হামিদ নামক এক ভাই একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক দেন। যেখানে অনলাইনে থাকা কোনোকিছু মুছে গেলেও ফিরে পাওয়া যায়। মাইনুদ্দীন আহমেদ সেখানে কোনো মন্তব্যই করেননি।
সার্টিফিকেটের বিষয়ে মাইনুদ্দীন আহমেদ লিখেন, ‘আমি আগেই বলেছি, আমার সার্টিফিকেট যিনি দেখতে চান, আমার কাছে সরাসরি আসুন। আমি গুহায় বসবাসকারী তো নই! আমার ঠিকানা, নাম্বার সবই প্রকাশিত, তা সত্ত্বেও যারা সামনাসামনি এসে যাচাই না করেই অপবাদে বিশ্বাস করছেন, তাদের উচিত আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করা। সার্টিফিকেটের ছবি আপ্লোড করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে, তাই লাইভে এসে দেখাবো বলেছিলাম, তা দেখাবো ইন শা আল্লাহ। একটু সময় ও সুযোগের প্রয়োজন বি ইযনিল্লাহ।
এ পোস্টে তিনি লাইভে এসে পাবলিক প্লেসে সার্টিফিকেট দেখানোর কথা বললেও পরবর্তী পোস্টে তিনি শুধু ছাতত্রদের গ্রুপে লাইভে আসার কথা বলেন।
(তার বিষয়ে রয়েছে এমন অসংখ্য অভিযোগ। যার ফিরিস্তি কোনো অংশেই কম নয়। তিনি যেখান থেকে পড়েছেন বলে দাবী করছেন। তারাও তাকে চিনে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তার শাগরেদকে দেখানো সার্টিফেকেটগুলোও জাল বলে দিয়েছেন যে প্রতিষ্ঠানের নামে সার্টিফেকেট, সে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে তারা বিবৃতিও দিয়েছেন। তাদের বিবৃতিও তার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব-নিউজরুম এডিটর)
এমডব্লিউ/