ফাহীম সিদ্দিকী
লেখক ও শিক্ষক
বিদআত রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের ঈমান আকীদা ও চিন্তাধারার মধ্যেও প্রবেশ করে বিকৃতি। দেওবন্দি মতাদর্শে বিদআত এবং কু-সংস্কারের কোন সুযোগ নেই। দেওবন্দিয়াত শরিয়তের অনুকরণ এবং সুন্নাহ থেকে ভিন্ন কোন বস্তু নয়।
হজরত আলকামা থেকে বর্ণিত, একবার সাহাবী হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, সেই সময়ে তোমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে যখন এমন দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় তোমাদের গ্রাস করবে যে, যুবক লোকটি এ বিপর্যয়ের মধ্যে বৃদ্ধে পরিণত হচ্ছে, ছোটরা বয়স্কে পরিণত হচ্ছে। যখন কোনো বিদআত ছুটে গেলে বলাবলি শুরু হবে যে, তুমি সুন্নাহ ছেড়ে দিয়েছ। শাগরিদরা বলল, কখন অবতরণ করবে এই বিপর্যয়? তিনি বললেন, যখন তোমাদের সামনে হক্কানী আলেমগণ বিদায় নিয়ে যাবেন। তাদের জায়গায় মূর্খদের প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি পাবে, তোমাদের মাঝে কারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে অথচ প্রাজ্ঞ ফকীহের সংখ্যা হ্রাস পাবে। নেতার সংখ্যা বেড়ে যাবে অথচ আমানতদার লোকের সংখ্যা কমে যাবে। যখন দুনিয়ার রুটি রোজগার তালাশ করা হবে আখিরাতের আমল দিয়ে এবং দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা হবে দুনিয়া কামাইয়ের উদ্দেশ্যে। (ইমাম দারেমী, আস সুনান ১/৬৪)
বর্তমানে কওমি মাদারিসে খতমে বুখারির নামে ভিন্নরকম অনুষ্ঠান মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে! দেওবন্দেও এক সময় তা ছিল, পরে কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করে দিয়েছে। সিরিয়াতেও এমন প্রথা ছিল, যা পরবর্তীতে শাইখ জামালুদ্দিন কাসেমি রহ. বন্ধ করে দেন।
২৪শে মার্চ ২০১৯ চট্রগ্রাম নজিরহাট বড় মাদরাসায় বুখারি শরিফের সমাপনী দরসে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম, মাওলানা আবুল কাসেম নুমানি (যীদা মাজদুহু) তার বয়ানে বলেছেন, আপনারা উম্মতের জন্য অনুসরণীয়। অতএব, আপনাদের প্রতিটি কদম হতে হবে খুবই সতর্কতার সাথে। আপনাদের পদস্খলন মানে জাতির পদস্খলন। এই যে বুখারি শরিফের খতম, কোথাও এর নজির নেই! দারুল উলুম দেওবন্দেও বুখারি শরিফ খতম হয়। কিন্তু কেউ জানে-ই না! কোন উসতাজ বা অন্য ক্লাসের ছাত্ররাও পর্যন্ত জানতে পারেন না। এমনকি মুহতামিম সাহেবও জানেননা! দাওরায়ে হাদিসের ছাত্ররাও বুঝতে পারে না যে, কখন সমাপ্ত হবে? আচমকা একদিন উসতাজ বলবেন, আজ শেষ করে দেব! ব্যস সে দিনই দুআর মাধ্যমে শেষ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তা বিদআত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে! অতএব, আপনারা সম্মিলিতভাবে এর লাগাম টেনে ধরুন এবং আস্তে আস্তে তা বন্ধ করে দিন।
দারুল উলুম দেওবন্দ স্রেফ একটি মাদরাসা নয় যে, সেখানে যারা পড়া-শোনা করবেন এবং শিক্ষকতা করবেন শুধু তারা-ই দেওবন্দি। বরং দারুল উলুম দেওবন্দ হচ্ছে একটি চেতনার নাম। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সমস্ত আকিদা লালন করে থাকে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের অধিবাসী, লণ্ডন, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রলিয়া বা অন্য দেশের। যদি সে এই আকিদা লালন করে, তাহলে সেও দেওবন্দি। সে দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র/শিক্ষক হোক বা না হোক। এছাড়াও পরদিন (২৫ মার্চ) জামেয়া পটিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে এই ধরনের আয়োজন থেকে বিরত থাকতে মাদরাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, জামেয়া পটিয়া বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এর অবশ্যই মূল্যায়ন আছে। সুতরাং আমি এই মারকাজ থেকে বাংলাদেশের সমস্ত মাদরাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি যে, দয়া করে ভবিষ্যতে বিদআতের শঙ্কাযুক্ত এসব অনুষ্ঠান থেকে আপনারা নিজেদের বিরত রাখুন।
দারুল উলুম দেওবন্দে খতমে বুখারির প্রথা শুরু হয়েছিল শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর শেষ যুগে।প্রথমদিকে খতমে বুখারির অনুষ্ঠানে বেশি লোকের সমাগম হত না। শুধু বড় বড় উলামায়ে কেরাম নসিহত পেশ করতেন এবং সহিহ বুখারির শেষ দরসের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হত। কয়েক বছর পর থেকে লোক সমাগমও বৃদ্ধি পেতে লাগল। অবস্থা এই দাঁড়াল যে, মহিলারাও বাচ্চাদেরকে নিয়ে আসতে শুরু করল। বেপর্দা নারীরা পুরুষের সাথে দুআ নেয়ার জন্য আসতে লাগল।
এ দিকে কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থাও করেনি। ফলে মহিলারা বাচ্চাদের পেশাব-পায়খানা মাদরাসার মাঠে-ই সারাতে লাগল! পরিস্থিতি এমন নাজুক হয়ে দাঁড়ায় যে, একদিন খতমে বুখারির অনুষ্ঠান হত এবং পরের তিনদিন পর্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য বন্ধ রাখতে হত। তখন মুহতামিম ছিলেন মাওলানা মারগুবুর রহমান বিজনুরি রাহিমাহুল্লাহ।
উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.সহ কয়েকজন আসাতিজা মুহতামিম সাহেবকে বললেন, হজরত! এ সব কী হচ্ছে? এগুলো গড়াচ্ছে কোন দিকে? একটু ভাবুন!
বারবার বলার পর এক সময় তার অন্তর প্রশস্ত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি এ জাতীয় খতমে বুখারির অনুষ্ঠান হবে না বলে ঘোষণা দেন এবং যার যার নেসাব শেষ করে অন্যান্য কিতাবের মতো সমাপ্ত করতে উভয় শাইখুল হাদিসকে বার্তা পাঠান। সেই থেকে এই প্রথা দারুল উলুমে বন্ধ রয়েছে।
মাওলানা তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ গত বছর দারুল উলুম করাচিতে বুখারির সমাপনী দরসে বলেন, বর্তমানে দীনি মাদারিসে খতমে বুখারির অনুষ্ঠান জৌলুসে পরিণত হয়েছে। অথচ এটা দেওবন্দিয়াতের খেলাফ। আমাদের আকাবিরদের সময়ে এসবের কোন অস্তিত্ব ছিল না। হজরত মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি রহ. এবং হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ.সহ কারো থেকে এমন আয়োজন প্রমাণিত নেই। আমাদের আব্বাজান রাহিমাহুল্লাহুর আমলেও আমরা তা দেখিনি। পরবর্তী সময়ে তা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে! সুতরাং আমাদের আকাবিরগণ যা করেননি, তা আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক বোঝার তওফিক দান করুন।
হজরত সাওবান রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের একটি দল সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে হকের উপর। শত্রুরা যাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হবে না। এ দলটি এভাবে হকের উপর থাকবে আল্লাহর নির্দেশ (কিয়ামতের প্রত্যক্ষ আদেশ) আসা পর্যন্ত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯৫০)।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
এমডব্লিউ/