সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার গুরুত্ব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মহিউদ্দীন ফারুকী।।

ভাষা আল্লাহ তাআলার অন্যতম সেরা দান। আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিআমতের মাঝে এক মহান নিআমত । কুরআনে কারীমে তিনি ইরশাদ করেন: (তরজমা) ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ-মণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। -সূরা রূম : ২২
সুতরাং এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা সকলের একান্ত কর্তব্য। এই নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি শুধু ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা নয়; বরং এই নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের সঠিক পদ্ধতি হল প্রত্যেকের নিজ নিজ ভাষাকে আপন করে নেওয়া এবং সেই ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা। লেখা ও বলায় সেই ভাষার বিশুদ্ধ রূপটি ব্যবহার করা। সুস্পষ্ট ও সুন্দর করে কথা বলা। অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।

সমস্ত নবী-রাসূল, সাহাবা, তাবেয়ীন এবং প্রত্যেক দেশের আলেম-ওলামা, জ্ঞানী-গুণীরা এভাবেই এই নিআমতের শুকরিয়া আদায় করেছেন। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছেন। বিশুদ্ধ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। সুন্দর ও সুস্পষ্ট বাচন-ভঙ্গি আর আকর্ষণীয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান বাণী সকলের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন।

বিশুদ্ধ ভাষাই পারে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। একজন মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ করে যেসব গুণ, সেগুলোর মাঝে বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলা অন্যতম। নেতৃত্বের অন্যতম গুণ বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা। কারণ এর মাধ্যমে শ্রোতা ও অধীনদের উপর সহজেই প্রভাব ফেলা যায়। মূলত বিশুদ্ধ ভাষা প্রাণ-মনকে দেয় তৃপ্তি আর চিন্তাচেতনাকে দেয় দীপ্তি।

বিশুদ্ধ ভাষায় খুতবা প্রদান করা, সুন্দর উচ্চারণে ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারা আমাদের নবীজীর অনুপম সুন্নত। আমাদের আকাবির ও আসলাফের ঐতিহ্য। তাদের আলোচনা, বক্তৃতায় বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজও বিদ্যমান। তাদের লেখনী ও রচনায় রয়েছে ভাষার সাহিত্য ও আলংকারিক উচ্চমান।

বিশুদ্ধ ভাষার সম্মোহনী শক্তি আর মন-মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তারের উচ্চমানসম্পন্ন ক্ষমতার বিষয়টির সত্যতা, ও বাস্তবতা বুঝে আসে যখন দেখতে পাই যে, আল্লাহ তাআলা সমস্ত নবী ও রাসূলকে তাঁদের আপন সম্প্রদায়ের ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন: (তরজমা) ‘আমি প্রত্যেক নবীকেই তার জাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি যাতে তাদের সামনে তারা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।’ -সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪

আর বাস্তবেই দেখা গেছে যে, নবী-রাসূলগণ তাঁদের স্বজাতির ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ সুভাষী হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। বাগ্মী ও সুবক্তা ছিলেন।
বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব আরো সুন্দর বুঝে আসে যখন দেখতে পাই মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর ভাইয়ের বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। (‘আমার ভাই হারুনের যবান আমার চেয়ে বেশি স্পষ্ট।’ -সূরা আলকাসাস ২৮ : ৩৪)

এ থেকে বোঝা যায় যে, নসীহত, ওয়ায ও প্রচারকাজে বিশুদ্ধ ভাষা, ভাষার প্রাঞ্জলতা ও প্রশংসনীয় বর্ণনাভঙ্গি কাম্য। আঞ্চলিক ও অশুদ্ধ ভাষা ছেড়ে এই গুণ অর্জনের চেষ্টা করা একটি মহৎ ও উচুঁমার্গের কাজ; একটি নববী আদর্শ।

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করতেন। আরবী ভাষায় তাঁর এমন দক্ষতা ও নিপুণতা ছিল যে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করতেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ শুদ্ধভাষী। তাঁর ভাষা ছিল বিশুদ্ধ, উচ্চারণ ছিল সুস্পষ্ট এবং বাচনভঙ্গি ছিল প্রাঞ্জল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইরশাদ করেছেন-أعطيت جوامع الكلم
অর্থাৎ ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৩

বিশুদ্ধ ভাষায় সুন্দর ও সুস্পষ্টভাবে কথা বলা আমাদের প্রিয় নবীর সুন্নাত। আমাদের বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। আলোচনায় সকলকে মুগ্ধ করতে বিশুদ্ধ ভাষার বিকল্প নেই।

সাহাবা-তাবেয়ীন ও আমাদের আকাবির বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। তালীম ও তাদরীসের ক্ষেত্রে সর্বদা অশুদ্ধ ভাষা বর্জন করতেন।
নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবনে ওমর রা. তাঁর সন্তানকে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কারণে প্রহার করতেন’। ইমাম বুখারী আল আদাবুল মুফরাদে ‘অশুদ্ধভাষা ব্যবহারে প্রহার’ অনুচ্ছেদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহ. বলেন-وكان السلف يؤدبون أولادهم على اللحن
‘পূর্বসূরীরা ভাষায় ভুল করলে তাদের সন্তানদের শাসন করতেন।’ -মাজমূউল ফাতাওয়া ৩২/২৫২

সাহাবায়ে কেরামসহ আমাদের আসলাফের নিকট সম্মান-অসম্মান, মান-মর্যাদা ও আভিজাত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড ছিল ভাষার ব্যবহার। প্রাচীন আরবদের মাঝেও বিশুদ্ধভাষীরাই ছিল বিশেষ আভিজাত্যের অধিকারী।

ইমাম যুহরী রাহ. বলেন- ما أحدث الناس مروءةً أعجب إليَّ من الفصاحة
‘আমার মতে বিশুদ্ধ ভাষার চেয়ে বড় আভিজাত্যের বস্তু আর কিছু নেই।’ -হিলইয়া ৩/৩৬৪; আলমুরুআ, আবু বকর মারযুবান, ৪৩

তিনি আরো বলেন, الفصاحة من المروءة
‘বিশুদ্ধ ভাষা আভিজাত্যের অন্তর্ভুক্ত।’ -বাহজাতুল মাজালিস ২/১/৬৪৩

ইবনুল মুবারক বলেন-
إقامة اللسانِ والسدادُ المروءةُ العظمى
অর্থাৎ ভাষার সংশোধন ও তার সঠিক ব্যবহার সবচেয়ে বড় আভিজাত্য। -আলমুরুআ,আবু বকর মারযুবান, ৭০
আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান তার সন্তান ওয়ালিদের মুখে অশুদ্ধ ভাষা শুনে অনেক ব্যথিত ও মর্মাহত হন এবং বলেন এটা ওয়ালিদের জন্য অশোভনীয়। তিনি আরো বলেন-اللحن في الكلام أقبح من التفتيق في الثوب، والجدري في الوجه
‘ভাষার ভুল কাপড়ের ছিদ্র বা ছিন্নতা ও মুখে গুটিবসন্তের চেয়েও জঘন্য’। -আলফাখরী, আলআদাবুস সুলতানিয়া, ১/৪৫

এরপর গ্রন্থকার নিজে বলেন-وكان اللحن عندهم في غاية القبح
‘অশুদ্ধ ভাষা তাদের নিকট অতি ঘৃণ্য বিষয় ছিল।’
একবার যিয়াদ তার সন্তান উবায়েদকে মুআবিয়া রা.-এর নিকট পাঠালেন। সার্বিক পর্যবেক্ষণের পর মুআবিয়া রা. যিয়াদের কাছে চিঠিতে লেখেন-إن ابنك كما وصفت، و لكن قوم من لسانه
‘তোমার ছেলে যেমন বলেছিলে ঠিক তেমনি, তবে একটু ভাষাটা ঠিক করে দিও।’ -আলবয়ান ওয়াত-তাবয়ীন ১/১৪৫

শায়খ আব্দুর রহমান সুদাইসি হারাম শরীফে জুমার খুতবায় বলেন-اللغةُ تُعلِي الرفيعَ عن الوضيع
‘ভাষা মানুষকে নিচু থেকে উঁচু শ্রেণীতে উন্নীত করে’।
অশুদ্ধ ভাষা এতই নিন্দিত যে, একে একপর্যায়ে রোগ বলা হয়েছে-
وقد أراد ابن السكيت مؤلف كتاب "إصلاح المنطق " أن يعالج أيضا داء " اللحن " والخطأ الذي كان قد استشرى وترسخ في لغة العرب التي هي لغة القرآن. (ترتيب إصلاح المنطق صـ٨)
পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরাম সাধারণ ও বিশেষ ব্যক্তিদের অশুদ্ধ কথনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ‘ইসলাহুল মানতিক’ ‘লাহনুল আওয়াম’ ‘তাকভীমুল লিসান’ ও ‘আলআখতাউশ শায়িআ’ শিরোনামে অনেক কিতাব রচনা করেছেন, যা মূলত বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝায় এবং এ ব্যাপারে তাদের কতটা সতর্কতা ছিল তা নির্দেশ করে।

ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণের জীবনী অধ্যয়নে দেখা যায়, তাঁরা সবাই বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ রাহ. ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী।

ভারত-পাকিস্তানে আমাদের আকাবির তাদের মাতৃভাষায় ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। যেমন লেখায় তেমন বক্তৃতায়। বিশুদ্ধভাষা ব্যবহারে এবং সাহিত্যের সর্ব শাখায় তাদের ছিল দৃপ্ত পদচারণা। মাওলানা শিবলী নোমানী, আব্দুল মাজেদ দরয়াবাদী, মাওলানা আব্দুল হাই, মুফতী মুহাম্মাদ শফী ও মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শুদ্ধভাষায় কথা বলার এ সুন্নতকে অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন। -সুত্র, আলকাউসার

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ