কাজী একরাম।।
‘সিনেমা এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনােদন মাধ্যম ও শিল্প মাধ্যমই শুধু নয়, এ শতাব্দীর সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের এক প্রধান নিয়ামকও বটে। বিশ্ব ইতিহাসে আর কোন মাধ্যমই মানুষের চিন্তা-ভাবনা, সংস্কৃতি, মূল্যবােধ ও রুচির ওপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারেনি, যতখানি পেরেছে সিনেমা। সচল দৃশ্য, সংলাপ, শব্দ আর সঙ্গীত মিলে সিনেমা দর্শকের মধ্যে এক-প্রত্যক্ষ বাস্তবের বিভ্রম তৈরি করতে পারে, যা আজও অন্য কোন মাধ্যমের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিনেমা একই সঙ্গে বহু দেশে বহু জায়গায় বহু মানুষকে দেখানাে যায়, তাই এর আবেদন বিশ্বজোড়া। সিনেমা এক দেশের মানুষের কাছে আরেক দেশের জীবন প্রত্যক্ষ করার জানালা খুলে দিয়েছে এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।’ (শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার ঘটনা, আনু মাহমুদ সম্পাদিত)
এর অতিসাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দেখুন:
‘এই সিরিজটি আমাকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে, আমি এই সিরিজটি এ পর্যন্ত ৪ বার দেখেছি এবং এখন আমি এটি পঞ্চম বারের মতো দেখতে শুরু করেছি।’
‘দিরিলিস আরতুগ্রুল- এর চরিত্রগুলোর মতো জীবনযাপন করা এবং তাদের মূল্যবোধের মূল্যায়ন করা আমার কাছে গর্বের কারণ ছিল। যদিও আমি একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মহিলা ছিলাম, তবু আমি (ড্রামা সিরিয়াল দিরলিশ আরতুগ্রুল দেখার পরে) ইসলামের প্রতি খুব আগ্রহী হয়ে ওঠি। যখন আমার জীবনে এই সিরিজটি এসেছিল, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং আমার ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম।’
সিনেমায় দৃশ্যায়িত চরিত্ররা সাধারণত মানুষের কল্পিত আদর্শের প্রতিরূপ হয়ে থাকে। এবং তা দর্শকের মন-মতিস্ককে তাদের পথে পরিচালিত করে। দেখুন তার প্রমাণ :
‘নাটকটিতে এরতুগ্রুল, তারগুত এবং সেলজানের ভূমিকা আমার যথেষ্ট মনে ধরেছে!’
‘নাটকটিতে ইবনুল-আরবি আমার প্রিয় চরিত্র ছিলেন। তাঁর কথা আমাকে অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করেছিল এবং মাঝে মাঝে এমনকি আমার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত করে।’
উদ্ধৃত এই কথাগুলি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছোট্ট শহর উইসকনসিনের (Wisconsin) খাদিজা নামধারী একজন ৬০ বছর বয়সী নওমুসলিম মহিলার, যাকে দয়াময় আল্লাহ তার জীবনের শেষ দিনগুলিতে ড্রামা সিরিয়াল আরতুগুলের বদৌলতে ইসলামের মহান নেয়ামতে অভিষিক্ত করেছেন।
ভালো সিনেমা মানুষের জীবনে অকল্পনীয় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মানুষের জীবন ও জীবনদৃষ্টিকে আমূল বদলে দেয়। শুনুন খাদিজার জবানি–‘প্রতিদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, আমি আমার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় পূর্বক তার কাছে দোয়া করি যে, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আমি আরও একটি দিন পেলাম। অনেক মানুষই জানেন না যে এই জীবনটি কতটা ছোট। আমি লোকদের এই মেসেজ দিচ্ছি যে, তারা যেন জীবনকে নষ্ট না করে, যেভাবে আমি করে ফেলেছি! এমন একটি সমাজের অংশ হওয়ার চেষ্টা করুন, যা কেবলই আপনাকে আত্মসর্বস্ব না করে বরং কীভাবে অন্যের উপকারে আসা যায়, সে ব্যাপারে মনোযোগী করে তুলে।’
উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ শতাব্দীর আনাতোলিয়া, বর্তমানে আধুনিক তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ মুসলিম তুর্কিদের খ্রিস্টান বাইজেন্টাইনদের সাথে লড়াই, মঙ্গোল এবং ক্রুসেডারদের আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ ইত্যাদি কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক সিরিয়াল।
ছয়শ বছরের অধিককাল স্থায়ী, তিন মহাদেশের উপর শাসনপ্রভাব বিস্তারকারী উসমানী সালতানাতের (অটোম্যান সাম্রাজ্য) প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজীর পিতা আরতুগ্রুল গাজীর জীবনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই সিরিজটিতে তুর্কি উপজাতির দুই হাজার লোকের একটি সংখ্যালঘু কাঈ গোষ্ঠির লড়াই, বীরত্ব, স্বৈরাচার, স্বাধীনতা, নিপীড়ন, দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-বিরহ, মানবিকতা এবং সর্বোপরি সর্বত্র ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অনবদ্য ইতিবৃত্ত চিত্রিত করা হয়েছে এই সিরিয়ালে।
বস্তুত, যখন তথাকথিত আধুনিক সিনেমাগুলো আমাদের মা-বোনের মাথা থেকে শালীনতার ওড়না কেড়ে নিয়েছে, এর বদ আছরে তারা যখন প্রেম-পরকিয়ার অবৈধ পথে পা বাড়াচ্ছে, ঘরের ভেতর এক ভাইয়ের স্ত্রী অপর ভাইয়ের প্রেমে পড়ছে, যখন এর প্রভাবে ভাই এবং বোনের পবিত্র সম্পর্ক পর্যন্ত কলঙ্কিত হতে শুরু করেছে এবং মেয়েরা যত বেশি নগ্ন হতে পারে ততই তারা গর্বিত বোধ করছে, ফলে পরিবার, সমাজ, সভ্যতা সবকিছু উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
ব্যক্তি মানুষের চরিত্র, নৈতিকতা অবক্ষয়িত হচ্ছে। সর্বোপরি শাহাদাত ও দাওয়াতের জাতি, মানবজাতিকে সৎ ও সত্যের পথে আহ্বানকারী মুসলিমরা যখন নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে, নিজেদের সমৃদ্ধ সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুশীলন ও অনুশাসন ছেড়ে পশ্চিমের আধুনিকতা, প্রগতির নামে বিজাতীয় সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক রেওয়াজের হাতে নিজেদের সোপর্দ করে দিয়ে জাতীয় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, শিল্প-বিনোদনের নাম করে ঈমান-আমল বিধ্বংসী, চিন্তা ও কর্ম বিনষ্টকারী সিনেমার নোংরা নেশায় যখন বুদ হয়ে আছে মুসলিম যুবকরা, তেমন একটা সংকটাবস্থা ও নাযুক সময়ে দিরিলিস আরতুগুল’র মতো এমন শালীন, নৈতিকতাসম্পন্ন অথচ শিল্পসফল একটা সিনেমার প্রয়োজন কত বেশি ছিল, তা বিশদ করে বলার দরকার নেই।
সত্যি বলতে, বর্তমান হলিউড-বলিউডে আসক্ত মুসলিম তরুনপ্রজন্মকে দায়িত্বসচেতন করা, স্বীয় ঐতিহ্য চেতনা ও সাংস্কৃতিক বোধ তাদের হৃদয়ে জাগরুক করা এবং ইমান-আমল বিধ্বংসী শিল্প-সংস্কৃতির বিপরীতে একটা বিকল্প দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা, এ সময়ের অপরিহার্য দাবি ছিল বটে। বিশেষত, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সিনেমা-শিল্পের অস্ত্র ব্যবহার করে ক্রমাগত যে বিষোদগার ও প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে, তার উপযুক্ত জবাব রচনা ও এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছিল সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। দিরিলিস আরতুগুল সে দাবি পূরণ ও কর্তব্য পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং বলাইবাহুল্য, আশাতীত সাড়া ও সাফল্য পেয়েছে।
-কেএল