আমিনুল ইসলাম হুসাইনী।।
ইংরেজি বর্ষপঞ্জির হিসেবে আমরা এখন যে মাসটি অতিবাহিত করছি, তার নাম ফেব্রুয়ারি। আর ফেব্রুয়ারি মানেই ভাষার মাস। আমাদের মাতৃভাষার বিজয়ের মাস। তাই ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের মাঝে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা যায়। দেখা যায় একুশের চেতনায় আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার দৃশ্য। অথবা উদ্বেলিত হয়ে উঠার না না কসরত। ভাষার মাস নিয়ে, একুশের চেতনা নিয়ে সারাদেশে যেন বয়ে যায় আলোচনা, সেমিনারের জোয়ার। দেশের বুদ্ধিজীবী ও লেখকশ্রেণীরাও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন মিডিয়া পাড়ায়।
ফেব্রুয়ারি এলে এই যে আমাদের আবেগের মহাসাগরে ভাষাপ্রেম উথালে ওঠে, চেতনার গভীরে সৃষ্টি হয় আলোড়ন। এই প্রেম বা অালোড়ন কতটা শাশ্বত তার হিসাব না'ই বা করলাম। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে একুশের দামাল ছেলেদের পেছনে যাঁরা বা যে সংগঠনটি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে তাঁরা বা সেই সংগঠনটি কি আজীবনই আমাদের আড়াল হয়ে থাকবে? জ্বী, ঠিকই ধরতে পেরেছেন। আমি সেই তমদ্দুন মজলিশের কথাই বলছি। বলছি তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের কথা।
ভাষা আন্দোলনে বহু সংগঠন ও ব্যক্তির অবদান থাকলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিস ও তার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের অবদান ছিল অপরিসীম। অথচ আমাদের আজকের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস বলতে বা লিখতে গেলে এই ঐতিহাসিক সত্যকে চেপে যান।
তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শুরু করেন সালাম-রফিকের শহীদ হওয়া দিয়েই। অথচ ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের বছরেই ভাষা-আন্দোলন শুরু হয় তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে। আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবীরা কেন এই শাশ্বত সত্যকে চেপে যাচ্ছেন, তা তারাই ভালো জানেন। তবে আমাদের যা জানার দরকার, তা হচ্ছে তমদ্দুন মজিলস কী এবং কেন? মাতৃভাষা ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের অবদান কী ছিল?
তমদ্দুন মজলিশ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাশেম এটি গঠিত করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কুসংস্কার গতানুগতিকতা ও প্রগতিশীলতা দূর করে সুস্থ ও সুন্দর তমদ্দুন গড়ে তোলা। বাংলাদেশে এ সংগঠনটির নাম 'তমদ্দুন মজলিশ' পাকিস্তানে এর নাম ছিল পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ।
ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন ছিল এই সংগঠনের স্বপ্ন। তাই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সাথে যোগ হওয়া বাঙালিরা যখন বুঝতে পারে বৃটিশদের ভূত পাকিস্তানি শাসকদের ঘাড়েও চেপেছে। অর্থাৎ মুসলিম হয়েও পাকিস্তানিরা অপর মুসলিম বাঙালিদের উপর জুলুম অত্যাচার চালাচ্ছে, মাতৃ ভাষা বাংলাকে গলা টিপে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, তখনই তমদ্দুন মজলিশ নড়েচড়ে উঠে। কারণ তমদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ ছিলেন সাচ্চা মুসলমান। তারা জানতেন পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষাই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি।
তিনিই সকল ভাষার স্রস্টা। বৈচিত্র্যময়ী এইসব ভাষা মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে করে সমৃদ্ধ ও গতিশীল। কেন না এতে রয়েছে চিন্তকদের অনন্য উপাদান। পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ তায়ালা সে কথাই বলছেন, 'আর তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্যতা। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শনাবলী।' (সূরা রূম : ২২)
তাঁরা এও জানতেন যে, ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের কাছে তার মাতৃভাষার গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। কেন না যে ভাষার মাধ্যমে জীবনের প্রথম বাক্য স্ফূর্ত হয়েছে, যে ভাষার বর্ণালি ছটায় মানুষ তার মনের ভাব প্রাকাশ করছে প্রতিনিয়ত। সে ভাষার প্রতি প্রেম-ভক্তি থাকাই মানুষের সহজাত ধর্ম। আর যাদের মাঝে এই মাতৃভাষার প্রেম-ভক্তি নেই তারাই জাতির অকৃতজ্ঞ সন্তান। ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকে আখ্যায়িত করা হয় নাফরমান হিসেবে।
কারণ মাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। এ জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর পয়গাম্বরদের মাতৃভাষা ভাষী করেই পাঠিয়েছেন। এর প্রমাণস্বরুপ রয়েছে পবিত্র কোআনের ইরশাদ, 'আমি সব পয়গাম্বরকেই তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি। যেন তাদের পরিস্কার বুঝাতে পারেন।' (সূরা ইবরাহিম: ৪)
সুতরাং বাংলাভাষা চর্চা যে পাপের চর্চা নয়, তা তারা ভালো করেই জানতেন। আর জানতেন বলেই ১৯৪৭ এর ১৫ ই সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজিলশ ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ প্রকাশ করে। তার পর ১৯৪৭ সালে ১২ নভেম্বর
ফজলুল হক হলে সভা ডাকে। সেই সভায় নুরুল আমিন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রুপে বাংলাকে ঘোষণা করার কোনো প্রতিবন্ধক নাই বলে তিনি মনে করেন (বরাত : আজাদ, ১৫ নভেম্বর ১৯৪৭)
তমদ্দুন মজলিশ শুধুমাত্র পুস্তিকা প্রকাশ আর সভা সেমিনার করেই ক্ষান্ত থাকেনি। বরং সরকার পর্যন্ত তাদের দাবিদাওয়া পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। তমদ্দুন প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম ও তার সহযোগীরা মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্বাক্ষর নিয়ে ১৪ নভেম্বর ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে আলোচনা করে আশ্বাস লাভ করেন। যদিও পাকিস্তানি সরকার তাদের কথা রাখেনি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরে এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলে বসেন, 'পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।'
নাজিমুদ্দিনের এই বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ববাংলার জনতা ফুঁসে উঠে। এই ফুঁসে উঠার পেছনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে, যে সংগঠনটির মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে ওঠে, সেই তমদ্দুন মজলিসের কথাই আজকের বুদ্ধিজীবীদের কথায়, লেখায় ও আলোচনায় গুরুত্ব পায় না। গুরুত্ব পায় না অধ্যাপক আবুল কাসেমের অবদানও।
বলা বাহুল্য, ১৯৪৬ সালে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে বাংলা ভাষায় পদার্থবিদ্যার ক্লাসে লেকচার দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে বাংলা ভাষায় লেকচার দেয়ার মতো হিম্মত তৎকালীন সময়ে প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু অধ্যাপক আবুল কাসেম দৃঢ়চিত্তে এই দুঃসাহসিক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।
কারণ তিনি বুকে লালন করতেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তমদ্দুন মজলিস। আর সেই তমদ্দুন মজলিসের উৎসাহ উদ্দীপনাই বাংলার ছাত্র সমাজ পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানি অার্মির সামনে।
লেখক: ইমাম ও খতিব, কসবা জামে মসজিদ, রেলস্টেশন রোড, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
-এটি