দরজায় কড়া নাড়ছে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন জামাতের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। এবার কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষাবর্ষের সময় কম হলেও কমেনি পরীক্ষার সিলেবাসের পরিমাণ। তাই অল্প সময়ে দীর্ঘ এ নেসাব থেকে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার কলাকৌশল বিষয়ে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজন করেছে পরীক্ষা বিষয়ক শিক্ষাপরামর্শ ‘পরীক্ষার ভালো প্রস্তুতি ও সেরা ফলাফলের কৌশল’। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।
লিখছেন দারুল উলুম রামপুরা বনশ্রী মাদরাসার উস্তাযুল হাদিস, দারুল উলুম দেওবন্দের ফাজেল ‘মাসুম আবদুল্লাহ’।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন— ‘মহিমাময় তিনি, যার হাতে গোটা রাজত্ব। তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান। যিনি মরণ ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে—কর্মে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী ও অতি ক্ষমাশীল’।সুরা: মুলক, আয়াত: ১ ও ২
অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা বলেন— ‘আর আল্লাহ তায়ালা শিখালেন আদম আ.কে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে বস্তুসামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতপর বললেন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও। তারা বলল, আপনার সত্ত্বাই পবিত্র, আপনি আমাদেরকে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন, তার বাইরে আমরা কিছুই জানি না। প্রকৃত পক্ষে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মালিক তো কেবল আপনিই। আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে আদম! তুমি তাদেরকে এসব জিনিসের নাম বলে দাও। সুতরাং যখন তিনি তাদেরকে সেসবের নাম বলে দিলেন, তখন আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি? আমি আসমান ও যমিনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত রয়েছি এবং সে সব বিষয়ও জানি, যা তোমরা প্রকাশ করো আর যা তোমরা গোপন করো’? সুরা: বাকারা, আয়াত: ৩১-৩৩
ছাত্র বলতেই তাকে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। সে যে-কোনো বিষয়ের বা যে-কোনো লাইনেরই হোক। একজন ছাত্রকে পরীক্ষার হাতে ধরণা দিয়েই এগুতে হয়, আপন স্বপ্ন ছুঁতে হয়। নিজের আকাশকুসুম গন্তব্যে পৌঁছুতে হয় এর হাত ধরেই। আর এ পরীক্ষার ফলাফল ও কীর্তি অনুপাতেই ঘুরে তার বাহ্যিক জীবনচাকা। এর ওপর ভর করেই প্রত্যক্ষভাবে থিতু হয় সকল শিক্ষিতের কর্মজীবন। আর কেনই বা এমন হবে না! পরীক্ষর মাধ্যমেই তো পরখ করা যায় ব্যক্তির যোগ্যতা। এর মাধ্যমেই একজন ছাত্র মেলে ধরে আপন প্রতিভা ও সুপ্ত মেধা। যার মাধ্যমে সে নিজেকে করে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্টমন্ডিত। হয়ত একারণেই শিক্ষিত মহলে পরীক্ষা ও তার ফলাফলের এতো গুরুত্ব।
অতএব, ছাত্রজীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে নিজেকে শতভাগ কৃতকার্য ও সফল করতে আমাদের প্রয়োজন কিছু নিয়মকানুন মেনে চলার। সংক্ষিপ্ত ও অল্প পরিসরে হলেও আমাদের ছাত্রভাইদের কিছু দিকনির্দেশনা আয়ত্ত ও রপ্তে রাখা জরুরী। তালিবে ইলম ভাইদের বিশেষ ফায়দার প্রতি লক্ষ করে পরীক্ষার ভাল প্রস্তুতি ও সেরা ফলাফল করার কিছু কলাকৌশল ও কিছু দিকনির্দেশনা নিম্নে পেশ করা হলো।
গুনাহমুক্ত জীবন গড়ুন: সফলতা আসবেই
একজন মুমিনকে গুনাহমুক্ত থেকে সর্বদা আল্লাহ তায়ালার দিকে মুতাওয়াজ্জুহ থাকতে হয়। সবসময়ের মতো পরীক্ষা চলাকালেও একজন ছাত্রকে গুনামুক্ত থেকে আল্লাহ তায়ালার দিকে মুতাওয়াজ্জুহ হওয়া আরো বেশি জরুরি। কারণ—সবকিছুর নিয়ন্ত্রা তো তিনিই। পরীক্ষাসহ জীবনের সবকিছুর সহজ ও কঠিনকারী তো তিনিই। অবনতি ও উন্নতি তিনিই দান করেন। বান্দার সফলতা-বিফলতা ও ব্যর্থতা তারই হাতে। ইজ্জত-সম্মান, অপদস্ততা ও অপমান তার হাতেই। ভাগ্যের চাবি-কাঠি একমাত্র তারই নিয়ন্ত্রণে।
তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণে আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি না করে তার দিকে শতভাগ মুতাওয়াজ্জুহ থাকার বিকল্প নেই। আল্লাহর দয়া-অনুগ্রহ ছাড়া জীবন-মরণের কোনো বেড়া-ই পার হওয়া সম্বভ নয়। গুনাহগার ও নাফরমানের প্রতি আল্লহর দয়া-রহমত ধাবিত হয় না। গুনাহ-পাপসহ তাঁর দয়া-মায়া লাভ করা যায় না। তাই জীবন-মরণে যে-কোনো সফলতা লাভে গোনাহ মুক্ত জীবন গড়–ন। গোনাহ ও পাপ থেকে বেঁচে থাকুন। আল্লাহর দয়া আপনি পাবেন-ই। সফলতা আপনার পদচুম্বন করবেই ইনশা-আল্লাহ!
সঠিক চেষ্টা-তদবীর কাঙ্খিত ফলাফল এনে দেবে-ই
আরবীতে একটি প্রবাদ আছে— الدنيا بالوسائل لا بالفضائل
‘পার্থিব সফলতা অর্জিত হয় তদবীরে—মর্যাদা-বৈশিষ্ট্যে নয়’।
পৃথিবীর সব কিছুকে আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করেণ তার আপন অপার কুদরতে। যাকে আমরা দেখি প্রত্যক্ষ্য কোনো সুত্রে গাথাঁ হিসেবে। তাই একজন ছাত্রকে আল্লহর সাথে সুনিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি বাহ্যিক মেহনত ও মুজাহাদা চালিয়ে যেতে হবে গুরুত্বের সাথে। সঠিক চেষ্টা-তদবীর ও মেহনত মুজাহাদর মাধ্যম্যেই আপন জীবনের উন্মেষ ঘটার সব রুদ্ধদ্বার খুলতে হবে। এ মেহনতের পায়ে ভর করে নিমেষেই পৌঁছে যাবে একজন ছাত্র তার মনজিলে মকসুদে। সফলতার দ্বারপ্রান্তে। কাঙ্খিত ফলাফলের পর্বত চূড়ায়। জীবন উন্নতির কালজয়ি স্বপ্নিল ভুবনে। আর এমনটি ঘটবে আল্লাহরই দায়িত্বে। তাঁরই সাহায্য-সহযোগিতায়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে উপনিত করবো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন’। সুরা: আনকাবুত, আয়াত: ৬৯
তাছাড়া ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ প্রবাদটি তো সবারই জানা। কষ্ট-মেহনত-মুজাহাদা অনুপাতেই মানুষ মান-সম্মান লাভ করে। সফলতা ও ব্যার্থতার পিছনে অন্যসব কিছুর পাশাপাশি মেহনত ও ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনাই প্রধান নিয়ামক।
চেষ্টা-মেহনতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করুন
অল্প মেহনতে অধিক এগুতে চাইলে বা অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভবান হতে চাইলে ধারাবাহিক মেহনতের কোনো বিকল্প নেই। হঠাৎ-সঠাৎ জানতোড় মেহনত করে হাত-পা ছেড়ে দেয়া কিংবা অল্প কিছু দিন হাড়ভাঙ্গা মেহনত করে অসুস্থ হয়ে পড়ার চেয়ে উত্তম হলো অল্প অল্প করে ধারাবাহিকভাবে মেহনত করে যাওয়া। অল্প পড়াশোনাও যদি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া যায়। তবে এক সময়ে তা বিপুল ও বিশালতার রূপ নেবে বলে আশা করা যায়। প্রবাদটি তো কম-বেশি সবার জানা—বিন্দুতে বিন্দুতে সিন্দু হয়।
কোথাও যদি এক বালতি বা এক ড্রাম পানি একসাথে ভাসিয়ে দেয়া হয়। তবে তা একসময়ে শুকিয়ে যাবে। পরক্ষণে সেখানে হয়ত সে পানির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে না। পক্ষান্তরে এ পরিমাণ পানিই যদি প্রতিনিয়ত ফোঁটায় ফোঁটায় কোথাও ঝড়তে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে সেখানে পানি পড়ার দাগ এটে যাবে। অন্ততঃ পানি পড়তে পড়তে সে জায়গাটা শেওলাযুক্ত ফেকাশে সবুজ বা পিচ্ছিল হয়ে উঠবে।
তদ্রুপ কখনো অনেক মেহনত করা আবার মেহনত ছেড়ে দেয়া—এতে ভালো ফল পাওয়া মুশকিল। এর বিপরীতে অল্প হলেও ধারবাহিক মেহনত করা হলে অতি সহজে আশানুরূপ ফল পাওয়া নিশ্চিত বলা যায়। যেমনটি উপরি উক্ত উদারহরণ থেকে সুস্পষ্ট হলো। আর এ কারণেই হয়ত আল্লাহ তায়ালা ধারাবাহিক আমল পছন্দ করেন। যদিও তা অল্প ও সামান্য হয়। নবি করিম সা. ইরশাদ করেছেন— ‘(হযরত আয়শা রা. থেকে বির্ণত তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন)—নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল হলো—যা ধারাবাহিকভাবে করা হয়, অল্প হলেও’। বুখরী শরীফ, হাদীস নং ৫৫২৩
অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়— ‘হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন—রাসুল সা. এর একটি বিছানা-পাটি ছিলো। রাতের বেলায় তা দিয়ে কামরার মতো বানিয়ে তার ভেতরে তিনি নামায পড়তেন। অতপর লোকজন রাসুল সা.-এর সে নামায পড়া শুরু করে দেয়। সে পাটিটিকে দিনের বেলায় খুলে ফেলা হত। একদিন সেই নামাযে লোকজনের জমায়েত ঘটে। তখন নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি বললেন—লোক সকল! তোমরা তোমাদের সাধ্যের ভেতরের আমল করবে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা ততক্ষণ বিরক্ত হবেন না যতক্ষণ তোমরা বিরক্ত হও। আর আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো যা ধারাবহিকভাবে করা হয়—যদিও তা অল্প হয়। আর মুহাম্মদ সা.-এর পরিবারের লোকজন যখন কোনো আমল করা শুরু করতেন তখন তাঁরা তা ধারাবাহিকভাবে করেন’। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১৮৬৩
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে— ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন—তোমরা সে ব্যক্তির মতো হয়ো না, যে কিয়ামুল-লাইল করত অতপর কিয়ামুল-লাইল ছেড়ে দেয়। (বরং ধারাবাহিকভাবে কিয়ামুল-লাইল করবে।)’ শরহুস্-সুন্নাহ, বাবুল-মুদাওয়ামাতি আলাল আমল, খ: ১, পৃ: ২২৫
উপরি উক্ত বর্ণনাসমূহ, যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়- ধারাবাহিক মেহনত পরীক্ষাসহ জীবনের প্রতিটি সাধনাকর্মে সফলতার চাবিকাঠি ও আবশ্যকীয় ফর্মূলা। (চলবে)
-কেএল